সুচিত্রা সেনের ‘ছেলে’ মাস্টার তরুণ, প্রয়াত হলেন ওহাইওর মাটিতে


ওহাইও সংবাদ প্রকাশের সময় : ডিসেম্বর ১৩, ২০২২, ১:১৩ পূর্বাহ্ণ /
সুচিত্রা সেনের ‘ছেলে’ মাস্টার তরুণ, প্রয়াত হলেন ওহাইওর মাটিতে

বিনোদন ডেস্ক : সুচিত্রা সেন অভিনীত ‘হসপিটাল’ (Hospital Movie Child Artist) ছবির গল্পটা মনে পড়ে? ডক্টর শর্বরী এবং ডক্টর শৈবাল, দু’জনেই এক হাসপাতালের ডাক্তার, একসঙ্গে ডাক্তারি পড়েছেন। বন্ধুত্ব থেকে প্রেম। দু’জনের বিয়েও হবে। কিন্তু বিয়ের আগে ঘুরতে গিয়ে গাড়ি খারাপের কারণে এক রাত্রে আটকে পড়েন তাঁরা। আর সেই রাতের পরেই শর্বরীর গর্ভে চলে আসে তাঁদের ভালবাসার সন্তান।

কিছুদিন পরে শৈবাল সেই কথা শর্বরীর থেকে জানতে পেরে কিছুতেই সেই সন্তানকে মেনে নিতে পারেন না। সমাজ-সংসারের দায়ে বিয়ের আগে এই সন্তান তাঁর কাছে অনাগত হয়ে ওঠে। তিনি শেষ করে দিতে বলেন সেই শিশুকে। কিন্তু শর্বরী বলেন, তাঁর সন্তান মাথা উঁচু করেই পৃথিবীর আলো দেখবে, এক মায়ের পরিচয়ে।
এই শর্বরীর ভূমিকায় অভিনয় করেই সিঙ্গেল মাদারের রোলে সে যুগে তাক লাগিয়ে দেন সুচিত্রা সেন। রোম্যান্টিক নায়িকার চেনা ছক ভেঙে খানখান করে দেন তিনি।

সেই ‘হসপিটাল’ ছবিতে সুচিত্রা সেনের ছেলের ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন মাস্টার তরুণ (Master Tarun)। সেই শিশুশিল্পীর নাম তরুণ চট্টোপাধ্যায়। গত ৮ নভেম্বর ২০২২, ওহাইওর মাটিতে আচমকা হৃদরোগে প্রয়াত হলেন (Passed Away) সেই অভিনেতা-পরিচালক তরুণ চট্টোপাধ্যায়। আমেরিকার ওহাইও শহরে থাকতেন তিনি। বয়স হয়েছিল ৬৯ বছর।

কলকাতার সুকিয়া স্ট্রিটে আদি বাড়ি তরুণ চট্টোপাধ্যায়ের। বাবার সঙ্গে টালিগঞ্জ স্টুডিও পাড়ায় যেতেন অভিনয়ের জন্য। কোনও ফিল্মি পরিবার থেকে না এসেও সহজাত প্রতিভার জোরেই ফিল্মে সুযোগ পান তিনি। একের পর এক ল্যান্ডমার্ক ছবিতে শিশুশিল্পীর চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন।

সেইভাবেই সুশীল মজুমদার পরিচালিত ‘হসপিটাল’ ছবিতে সুচিত্রা সেন ও অশোক কুমারের ছেলের চরিত্রে অভিনয় করেন মাস্টার তরুণ। তপন সিনহার ‘ক্ষণিকের অতিথি’ ছবিতেও রুমা গুহঠাকুরতার ছেলের ভূমিকায় মাস্টার তরুণ আইকনিক।

এছাড়াও ঋত্বিক ঘটকের ‘সুবর্ণরেখা’ ছবিতে অভিনয় করেন তিনি অভি ভট্টাচার্য ও মাধবী মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে। এমন তিনটি কালজয়ী ছবিতে অভিনয় করা ক’জন শিশুশিল্পীর ভাগ্যে হয়! তিন কিংবদন্তী পরিচালকের সঙ্গেও তাঁর কাজ করা হয়ে যায় সেই শিশু বয়সেই। বহুবার ঋত্বিক ঘটকের নানা ফিল্ম ফেস্টিভ্যালেও তিনি অংশগ্রহণ করেছেন। এছাড়াও ষাটের দশকে বেশ কিছু ছবি করেছেন তিনি। সব ছবির প্রিন্টও আর পাওয়া যায় না।
মাস্টার তরুণ বড় বয়সে আর কোনও ফিল্মে অভিনয় করেননি। যৌবনে আমেরিকার নিউ জার্সিতে চলে যান এবং সেদেশেরই নাগরিকত্ব নিয়ে নেন। তবে সেখানে একটি ছোট নাট্যদলে অভিনয় ও পরিচালনা করতেন তিনি। তাঁদের নাট্যদল নিউ ইয়র্কে শো করেছিল বেশ কিছু।

বড় বয়সে মাস্টার তরুণ কেমন হলেন, সে খবর আর কখনও সামনে আসেনি। দর্শকের কাছে তাঁর ছোটবেলার মুখটাই ধরা ছিল। শিশুশিল্পীরা তো এইভাবেই আড়ালে রয়ে যান। অথচ তিনি সুচিত্রা সেন, পাহাড়ি সান্যাল ও ছবি বিশ্বাসের মতো লেজেন্ডারি অভিনেতার সঙ্গে স্ক্রিন শেয়ার করেছিলেন একসময়ে।

নিউ জার্সিতে তরুণ চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে গভীর আলাপ হয়েছিল কলকাতা শহরের বিখ্যাত ফটোগ্রাফার সুজিত সরকারের। সুজিত বাবু ‘দ্য ওয়াল’কে টেলিফোনে জানালেন, “তরুণদা ভীষণ হাসিখুশি মানুষ ছিলেন। হাসি মুখ ছাড়া ওঁকে কখনও দেখিনি। ওঁর মুখের মধ্যে বা কথার স্টাইলে ছোটবেলার মাস্টার তরুণকে খুঁজে পেতাম। নিউ জার্সিতেই ওঁর সঙ্গে আলাপ। আমরা মজা করে তরুণদাকে বলতাম, ‘সুচিত্রা সেনের কোলে, তরুণদা দোলে। চলো মুনমুন সেনের কোলেও তোমার ছবি তুলে দি।’ তখনই তরুণদা বলতেন ‘এই মারব কিন্তু।’

ওঁর এই বলার স্টাইলটা ছিল একদম ছোটবেলাকার মতো। যখন ‘হসপিটাল’ ছবিতে ছবি বিশ্বাস বলেছেন তরুণকে, ‘এই কে রে, আমার ল্যাবরেটরিতে ঢুকেছিস!’ সেই একই মুখের অভিব্যক্তি তরুণদার। তরুণদার সঙ্গে অনেক নাটক দেখতেও গেছি। কলকাতায় কখনওসখনও আসতেন। ওঁর সঙ্গে আড্ডাগুলো মিস করব।”

২০১০ সালে তরুণ চট্টোপাধ্যায় কলকাতায় ফিরেছিলেন পরিচালক রুপে। ঋতুপর্ণা সেনগুপ্তকে নিয়ে তিনি তৈরি করেন ‘অভিসন্ধি’ নামে একটি ছবি। এই ছবিতে কল্যাণ রায়, অপর্ণা সেনের স্বামী, একজন গ্যাংস্টারের চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন। ছবিটি অন্যধারার, সেভাবে চলেনি। তাই কলকাতায় বাংলা ছবি করার জন্য তরুণ বাবু আর ঝোঁকেননি। তবে ঋতুপর্ণার সঙ্গে ওঁর ভাল সম্পর্ক গড়ে ওঠে। কল্যাণ রায়ও ছিলেন তরুণ বাবুর প্রিয় বন্ধু।
শেষ বছরগুলি তরুণ চট্টোপাধ্যায় ওহাইও শহরেই থাকতেন। সেখানেই রয়েছেন তাঁর স্ত্রী পায়েল ও এক পুত্র সন্তান।