স্বরাজ চক্রবর্তী,
কলম্বাস, ওহাইও
রণক্লান্ত নিবেদিতার ৪৪ তম জন্মের তারিখ ২৮ শে অক্টোবর, ১৯১১। চারিদিকের শুভাকাঙ্খীরা অনেক করে রাজি করিয়েছেন নিবেদিতাকে কিছুদিনের জন্যে কোথাও গিয়ে বিশ্রাম নিতে। বিবেকানন্দর মৃত্যুর পরে এই নয় বছর নিজের সর্বস্ব নিংড়ে দিয়েছেন এই বিপ্লবী মহীয়সী বিদেশিনী ভারতবর্ষের মুক্তির জন্য।
নিবেদিতার কর্মধারা বিবেকানন্দর মতোই বহুমুখী। এক পরাধীন জাতিকে কী করে স্বাধীনতায় উধ্বুদ্ধ করতে হয়, মেয়েদের মধ্যে শিক্ষার আলো পৌঁছে দিতে হয়, ভারতের ভাব মূর্তিকে বিদেশে কী করে স্বমহিমায় প্রকাশ করতে হয় বক্তৃতা ও লেখায়-তার জন্যে যে আগুন দরকার-বিবেকানন্দ খুঁজে পেয়েছিলেন তাঁর এই সিংহী মানসকন্যার মধ্যে।
ভারতবর্ষে অনেক মহিয়সী নারী জন্ম নিয়েছেন। কিন্তু যদি সবদিক বিচার করা যায়, ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে নারীদের মধ্যে ভগিনী নিবেদিতার অবদান অতুলনীয়। ভারতে এমন কোনো রাজনীতিক নেতা নেই যিনি নিবেদিতার দ্বারা স্বাধীনতা সংগ্রামে উদবুদ্ধ হননি। কি বলেছিলেন সুভাষ বোস, রবীন্দ্রনাথের “লোকমাতা” নিবেদিতা সম্পর্কে? “I loved India after reading Vivekananda and I could know Vivekananda after reading Nivedita.”
সেই নিবেদিতা আজ সত্যিই ক্লান্ত। রাজী হয়েছেন বোস (Jagadish Bose and Abala Bose) পরিবারের সাথে কয়েকদিন দার্জিলিঙে বিশ্রাম নেবেন। ঠিক হয়েছে কয়েকদিন দার্জিলিঙে থাকার পর ঘোড়ায় চড়ে Sanduk Fu peak যাওয়া হবে।
কিন্তু সবকিছু গুছিয়ে যাওয়া কি চাট্টিখানি কথা? অন্যান্য দিনের মতো ভোর চারটেতে উঠে স্কুল, লেখা, অগুনতি মানুষের প্রয়োজন মিটিয়ে বেলা দুটোয় যাবার প্রস্তুতি মনে পড়লো। প্রতি সপ্তাহে যে মা সারদাকে না দেখে থাকতে পারেন না, সেই নিবেদিতার মনে পড়লো যে মা সারদা তো এখন জয়রামবাটিতে, কলকাতায় নেই। তবে মায়ের বাড়ি যেতেই হবে যাওয়ার আগে।
বাড়িতে ঢুকেই যোগীন-মাকে দেখেই এ কী হলো নিবেদিতার? কয়েক মুহূর্ত নিষ্পলক দৃষ্টিতে যোগীন – মার দিকে তাকিয়ে “যোগীন – মা, আমার মনে হচ্ছে আমি আর ফিরবো না” যোগীন – মা: “সেকি ! তুমি মায়ের বড়ো আদরের খুকী, এসব কী বলছো” ? “আমি জানিনা যোগীন – মা। মনে হচ্ছে এই আমার তোমার সাথে শেষ দেখা”!
বাড়িতে ফিরে বোস পুকুর লেন এ সবার দিকে তাকিয়ে নিবেদিতার বুকের ভিতর টা যেন মুচড়ে উঠলো। সবসময়ের প্রাণবন্ত নিবেদিতা যেন অস্বাভাবিক ভাবে চুপচাপ, আত্মস্থ।
দার্জিলিঙে পৌঁছে দিন দুয়েক বিশ্রাম। বোস পরিবার তৈরী দার্জিলিং ছেড়ে পরের দিন hiking এ যাবার জন্য। হঠাৎ নিবেদিতা ভোরে অসুস্থ। ডাক্তার পরীক্ষায় জানালো blood dysentry! নিবেদিতা নিজেই কতো রুগীকে এই অসুখের সেবা করেছে। এই বুদ্ধিমতী মহিলা জানেন এই altitude এ এই রোগের কোনো চিকিৎসা নেই। তার উপর শরীর অত্যন্ত দুর্বল, সমতলে যাওয়া অসম্ভব।
এই বিচক্ষণ মহিয়সী বোস পরিবারকে শান্ত করিয়ে কয়েকটা দরকারী কাজ করে নিলেন। উইল করে তাঁর সর্বস্ব ভারত মাতাকে দান, মেয়েদের ভবিষ্যতের পড়াশোনার planning, নিজের জন্মস্থানে বিলেতে সামান্য অসুস্থতার খবর দেওয়া – সব কিছু জাগতিক কর্তব্য নিঃশব্দে সম্পন্ন করলেন।
প্রায় ছয় দিন অসুস্থ। অবলা বোস সর্বক্ষণ নিবেদিতার সাথে। কাঞ্চনজঙ্গা তুষারাবৃত, হয় বৃষ্টি, নয় অন্ধকার, সূর্যের দেখা নেই। কয়েকদিন আগে Buddhist প্রার্থনা যা নিবেদিতা নিজেই অনুবাদ করেছিলেন, তাই শোনাতে বললেন “Let all things that breathe, without enemies, without obstacles, overcoming sorrow, and attaining cheerfulness, move forward freely, each in his own path ……”.
বিবেকানন্দের দেওয়া প্রিয় রুদ্র মন্ত্র বারবার ধ্বনিত হলো নিবেদিতার কন্ঠে: “From the Unreal lead us to the Real! From darkness lead us to light. From death lead us to immortality. Reach us through and through ourselves, and evermore, O Though Terrible! Protect us from ignorance, by thy sweet compassionate face”.
১২ঐ অক্টোবর, শারীরিক অবস্থার আরো অবনতি। অথচ হটাৎ যেন meditation থেকে জেগে উঠে মুখে এক অনাবিল আনন্দ। “আমি দেখতে পাচ্ছি ”
অবলা: “কী দেখছো নিবেদিতা?”
নিবেদিতা: “ভোরের আলো।”
কিন্তু বাইরে অন্ধকার ও বৃষ্টি। শুধু নিবেদিতা দেখতে পাচ্ছেন তাঁর ব্রত, সাধনা, তপস্যায় ভারতের স্বাধীনতার সূর্য্য !
খুব কাছে ডেকে নিলেন অবলাকে। ১৩ ই অক্টোবর তখনো ভোরের অন্ধকার: নিবেদিতা অবলার কানে whisper করলেন “The frail boat is sinking, but I shall yet see the sunrise.”
হলোই তাই। ছদিন পর জানলার দিকে নিবেদিতা তাকিয়ে – এক চিলতে সূর্যের রশ্মি এসে পড়লো। আস্তে আস্তে সূর্য উদয় হলো। মনে হলো দুষ্কৃতীর মেঘ হালকা হয়ে অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে, আর সুকৃতির জোতির্ময় সূর্য উঠেছে। পরম তৃপ্তিতে নিবেদিতার শেষ নিঃশাস পড়লো। দিব্যচোখে কোটি কোটি ভারতবাসীর মুক্তির ছবি নিবেদিতা আগাম জানিয়ে দিয়ে গেলেন। ঠিক যেমন তাঁর গুরু এক শিষ্যকে পঞ্চাশ বছর আগে জানিয়ে গিয়েছিলেন ভারতের স্বাধীনতার দিনক্ষণ।
৪৪ বছরও পূর্ণ হোলনা। কিন্তু গুরুর আদেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করে গেলেন। Parlimentarian সমর গুহ যথার্থই বলেছেন “Vivekananda made the pedestal for revolution and Nivedita ignited the fire”.
পাঠক, দার্জিলিং বেড়াতে গেলে নিবেদিতার স্মৃতিস্তম্ভে ক্ষণিক দাঁড়াতে ভুলবেন না “Here repose the ashes of Sister Nivedita, who gave her all to India.”
আপনার মতামত লিখুন :