ধারাবাহিক-১১২
এই সংখ্যায় ইমিগ্র্যান্ট বাবা-মায়েদের ঘরে এদেশে জন্ম নেয়া আমাদের নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের লালন-পালন ও তাদের বেড়ে ওঠার ক্ষেত্রে তাদের ওপর যে মানসিক চাপের সৃষ্টি হয় তার প্রভাব এবং ফলাফল নিয়ে কিছুটা আলোচনা করবো। যাকে আমরা বাবা-মায়ের চাপের প্রভাব বলে উল্লেখ করতে পারি। এর সুফল এবং কুফল দুটোই আছে।
মনোবিজ্ঞানের ভাষ্য অনুযায়ী ছেলেমেয়েরা যখন তাদের পিতামাতাকে খুশি করার জন্য ক্রমাগত চাপ অনুভব করে, তখন এটি তাদেরকে আবেগগতভাবে, সামাজিক, মানসিক এবং শারীরিকভাবে প্রভাবিত করতে পারে। কোন- কিছু অর্জন করার ব্যাপারে পিতামাতার দ্বারা প্রত্যাশিত টাইমলাইন, নিজেদের ওপর চাপ অনুভব করা, আত্মবিশ্বাস কমে যাওয়া এবং তাদের বাবা-মা কিভাবে তাদের। সাফল্যকে সংজ্ঞায়িত করে বা বিচার করে এসবের টানাপোড়েনের মধ্যে অনুভব করতে পারে তারা যেন অনেকটা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে।
আগেই উল্লেখ করেছিলাম যে বাংলাদেশী-আমেরিকান বা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ান তথা এশিয়ান আমেরিকানদের মধ্যে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক এবং ধর্মীয় ঐতিহ্যের অনেক বৈশিষ্ট্য প্রায় এক রকম। যেমন সমষ্টিগত চিন্তাধারা, ইত্যাদির দ্বারা পরিবারের বিভিন্ন সদস্যের প্রত্যাশাগুলি যেন পরিবার এবং কম্যুনিটির জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভিত্তি হিসেবে গণ্য হয়।
যদিও কয়েক প্রজন্ম ধরে শক্তিশালী একটা পারিবারিক বন্ধন সম্প্রসারণ হওয়া এবং অন্তর্ভুক্ত হওয়ার মাধ্যমে আত্মবিশ্বাস অর্জনের একটি উৎস হতে পারে যেসব ছেলেমেয়ে বাবামায়ের আদর-যত্ন ও ভালোবাসা পেয়ে বেড়ে ওঠার সুযোগ পায়, পরবর্তীতে তাদের জীবনে সাফল্য লাভ বা সুখী হওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেড়ে যায়।
কিন্তু যখন কোন অপ্রত্যাশিত ঘটনা এই বন্ধনগুলিকে ব্যাহত করে তখন এটি গভীর একটি যন্ত্রণা এবং মানসিক আঘাতের উৎসও হয়ে দাঁড়াতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, কোন সদস্য যখন পরিবারের কঠোর বা কাঙ্খিত প্রত্যাশা উপেক্ষা করে বা ভেঙে তথাগত ঐতিহ্য থেকে দূরে সরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় তখন তা প্রত্যেক সদস্যের মধ্যেই ব্যক্তিগতভাবে একটি সংকট তৈরি করতে পারে।
আমাদের নতুন প্রজন্মর ছেলেমেয়েদের অনেককেই এদেশে তাদের বেড়ে ওঠার ক্ষেত্রে দুটি ভিন্ন সংস্কৃতির টানাপোড়েনে পড়ে প্রচন্ডভাবে পারিবারিক এবং সামাজিক চাপের সম্মুখীন হতে হয়, এবং ‘ব্যর্থ’ না হয়ে একই সময়ে দুটি ভিন্ন সংস্কৃতির অন্তর্গত হওয়ার প্রত্যাশার ভারসাম্য বজায় রাখার জন্য চেষ্টা চালায়।
ঐতিহ্যগতভাবে কম্যুনিটির এবং পারিবারিক মূল্যবোধগুলি প্রায়শই মূলধারার আমেরিকান সংস্কৃতির ধারার সাথে বিরোধপূর্ণ হতে পারে বা সংঘর্ষ সৃষ্টি করতে পারে। নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা অনেকেই মনে করতে পারে যে তারা তাদের পরিবারকে হতাশ করবে নাকি এদেশে তাদের মেইনস্ট্রিমের সহপাঠী বন্ধু-বান্ধব বা বৃহত্তর সমাজের সাথে একীভূত হবে। এই দুই টানাপোড়েনের মুখোমুখি হয় তারা।
ন্যাশনাল এলায়েন্স অন মেন্টাল ইলনেসের (এন.এ.এম.আই.) সাম্প্রতিক এক গবেষণা অনুযায়ী ইন্টার- জেনারেশনাল কালচারাল কনফ্লিক্ট (আই.সি.সি.) হল এদেশে আমাদের নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের জন্য একটি উল্লেখযোগ্য স্ট্রেস। ঐ গবেষণায় আরো উল্লেখ করা হয়েছে, যদিও ভিন্নতর সাংস্কৃতিক পটভূমি থেকে আসা পরিবারগুলিকে কালের পরিবর্তনের সাথে সাথে তাদের পরিবর্তিত আচরণ এবং এদেশে জন্মগ্রহণ করা ছেলেমেয়েদের সাথে তাদেরকে বিভিন্ন দ্বন্দ্বের সম্মুখীন হতে হয়।
বাংলাদেশী-আমেরিকানসহ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ান বা এশিয়ান-আমেরিকানদের মধ্যে এই জাতীয় কিছু মতবিরোধ বা দ্বন্দ্বের কিছু উৎস এতো গভীরভাবে জাতিগত, ধর্মীয় বা ব্যক্তিগত, যা তাদের পরিচয়কে প্রভাবিত করে। এটি তরুণ প্রজন্মের মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে।
অধিকন্তু আমাদের মধ্যে দীর্ঘদিনের প্রচলিত ধারণা অনুযায়ী অল্পবয়সী মেয়েদের বেলায় প্রায়ই আশা করা হয় যে তারা তাদের ছোট ভাইবোন বা বয়স্কদের যত্ন প্রদান করবে। এদেশে আমাদের নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের প্রায়শই তাদের ইমিগ্র্যান্ট পিতামাতার কাছ থেকে স্পষ্ট কথা শুনতে হয় যে তাদের বাবা-মারা তাদের (ছেলেমেয়েদের) এদেশে থাকার জন্য অনেক ত্যাগ স্বীকার করেছেন। যদিও এইসব বাবা-মায়েদের এদেশে আসার ব্যাপারে ঐ ছেলেমেয়েদের কার্যত কোন ভূমিকা ছিল না বা থাকার কথা নয়। কেননা সেইসব ইমিগ্র্যান্ট বাবামারা এদেশে এসেছে ঐ ছেলেমেয়েদের জন্মের আগে।
বাবা-মায়েদের দ্বারা অর্পিত সেই অযৌক্তিক দায়ভার যেন অনেকটা বাধ্য করে ছেলেয়েদের বুঝতে যে, পরিবারের ভবিষ্যত যেন অনেকটা তাদের কঠোর পরিশ্রম এবং কৃ তিত্বের ওপর নির্ভর করবে। এই ধরনের চাপের বাধ্যবাধকতা গভীর ক্ষত তৈরি করতে পারে এদেশে আমাদের নতুন প্রজন্মের ছেলেমেদের মধ্যে। শেষ পর্যন্ত এই জাতীয় চাপ তাদের অনেকের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর গভীর প্রভাব ফেলতে পারে। পরবর্তী সংখ্যায় এদেশে আমাদের নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের মধ্যে বিয়ে বা সম্পর্ক তৈরি করার কিছু চ্যালেঞ্জ নিয়ে আলোচনা করার ইচ্ছা রইলো। সূত্র: সাপ্তাহিক বাঙালী, নিউইয়র্ক, অক্টোবর ২৯, ২০২২
আপনার মতামত লিখুন :