আমেরিকায় আমাদের নতুন প্রজন্ম – মিজান রহমান নিউইয়র্ক
ওহাইও সংবাদ
প্রকাশের সময় : জুন ১৫, ২০২৩, ১০:১৫ অপরাহ্ণ /
০
ধারাবাহিক- ১১১
এই সংখ্যায় বাংলাদেশী তথা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ান পরিবারগুলোর সাথে এদেশের আমেরিকান ও অন্য পরিবারগুলোর যে পার্থক্য পরিসংখ্যানভাবে, তা নিয়ে কিছুটা আলোচনা করব। সেই প্রেক্ষিতে আমাদের ছেলেমেয়েরা কিভাবে তাদের ভিন্নতাকে মূল্যায়ণ করে এবং খাপ খাওয়ানোর চেষ্টা করে সে বিষয়েও কিছুটা আলোকপাত করব।
সমষ্টিগত মূল্যবোধঃ আমাদের প্রথাগত মূল্যবোধের মধ্যে অন্যতম হলো যে আমরা পরিবার, সম্প্রদায় এবং কমুনিটির চাহিদাকে প্রাধান্য বা অগ্রাধিকার দিয়ে থাকি আমাদের ব্যক্তিগত চাহিদা বা চাওয়া-পাওয়াকে অনেক সময় উপেক্ষা করে। আমেরিকান সমাজে জীবনযাত্রার একটা প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো ব্যক্তি স্বাধীনতা ও ব্যক্তিগত চাওয়া-পাওয়াকে প্রাধান্য দেয়া।
পারিবারিক দৃষ্টিকোণ বা পারিবারিক সম্মানবোধঃ আমরা এদেশেও আমাদের ছেলেমেয়েদের লালন-পালন করার ক্ষেত্রে পারিবারিক দৃষ্টিভঙ্গিকে খুবই গুরুত্ব দিই। আমরা আশা করি যে আমাদের ছেলেমেয়েরা মুরুব্বিদের কর্তৃত্ব মেনে চলবে এবং বৃহত্তর কমুনিটির কাছে পরিবারকে ভালোভাবে সম্মানজনক অবস্থানে রেখে উপস্থাপনা করবে। সামাজিক নিয়ম-কানুন, পরিবার ও কমিউনিটি বা নিজস্ব সম্প্রদায়ের প্রতি আনুগত্যের ওপর জোর দিয়ে এদেশে আমরা আমাদের ছেলেমেয়েদের বড় করে তোলার চেষ্টা করি।
সন্তান-সন্ততি জন্ম থেকে শুরু করে বিয়ে এবং কর্মজীবনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশী তথা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ান আমেরিকানদের মূল্যবোধ এবং আচরণের একটি স্বতন্ত্র ধারা রয়েছে। পিউ রিসার্চের গবেষণা অনুযায়ী সামগ্রিকভাবে আমেরিকার জনসংখ্যার সাথে তুলনা করলে, বাংলাদেশী তথা এশিয়ানদের বিয়ে করার এবং পরিবার গঠন করার প্রবণতা বেশি। এবং দক্ষিণ এশিয়ান-আমেরিকান তরুণীদের অবিবাহিত অবস্থায় মা হওয়ার আশংকা খুবই কম। যেটা আমাদের জন্য অবশ্যই একটা আশার কথা।
তবে বাংলাদেশী তথা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ান পিতামাতারা এদেশে তাদের ছেলেমেয়েদের কর্মজীবন এবং বৈষয়িক সাফল্যের ওপর আমেরিকানদের চেয়ে অনেক বেশী গুরুত্ব দেয়। যেখানে প্রায় ৬০% আমেরিকান বাবা-মা তাদের সন্তানদের স্কুলে ভাল করার জন্য যথেষ্ট চাপ দেয় না বলে জানায়; সেখানে মাত্র ৯% এশিয়ান হেরিটেজ অভি-ভাবকরা একই কথা বলে।
যদিও জাতিগত বা সম্প্রদায়গত নির্বিশেষে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়া এবং পরিবার গঠন করাটা কার্যত সমস্ত আমেরিকানের কাছেই একটি কেন্দ্রীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কিন্তু সাম্প্রতিক দশকগুলিতে ব্যাপক সামাজিক পরিবর্তন বিয়ে এবং সন্তান প্রতিপালনের সামাজিকভাবে স্বীকৃত প্রতিষ্ঠানগুলিতে আঘাত হেনেছে। আমেরিকাতে প্রাপ্তবয়স্কদের একটি অংশ এখন ঐতিহ্যগতভাবে বিবাহিত জীবন যাপন করে বর্তমানে তা ৫১%, যেটা ১৯৭০ সালে ছিল ৬৯%।
এদেশে বর্তমানে বিয়ের বাইরে অনেক শিশু জন্ম নেয়। ক্রমাগতভাবে কম সংখ্যক ছেলেমেয়ে বর্তমানে দুইজন অবিবাহিত পিতামাতার পরিবারে বেড়ে উঠছে। বাংলাদেশী-আমেরিকান জনগোষ্ঠীসহ এদেশে অধিকাংশ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ান-আমেরিককানরা এবং সামগ্রিকভাবে মেইনস্ট্রিম আমেরিকান জনসাধারণ ব্যাপকভাবে একমত যে সন্তানের পিতৃত্ব বা প্রতিপালনের নিমিত্তে বিবাহিত জীবন প্রতিষ্ঠা করা ‘সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলির’ তালিকার শীর্ষে রয়েছে। এশিয়ানদের মধ্যে অন্যান্য অগ্রাধিকারযোগ্য বিষয়গুলোর মধ্যে কর্মজীবনের সাফল্য, একটি বাড়ির মালিকানা অতি গুরুত্বপূর্ণ বলে গণ্য করা হয়। কিন্তু প্রয়োজনে অন্যদের সাহায্য করার বিষয় বিবেচনা করাটা সেই তালিকায় অনেক নিচে বা অনেকটা অগুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচিত হয়।
মানুষ হিসেবে আমাদের জীবনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় কি? এই প্রশ্নের আলোকে পিউ রিসার্চ সম্প্রতি একটি জরীপ চালায়। ঐ জরিপে উত্তরদাতাদের জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল যে জীবনের ছয়টি প্রধান নির্ণায়ক উত্তরদাতাদের কাছে ব্যক্তিগতভাবে কতটা গুরুত্বপূর্ণ। ঐ জরিপ অনুযায়ী এশিয়ান-আমেরিকানরা একজন ভালো বাবা-মা হওয়াকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেয়। প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ (৬৭%) বলে যে এটি তাদের জীবনের ‘সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলির মধ্যে একটি’ এবং আরো ২৭% বলে যে এটি ‘খুব গুরুত্বপূর্ণ তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলির মধ্যে একটি নয়’। শুধুমাত্র ৫% বলেছে যে একজন ভাল পিতামাতা হওয়া ব্যক্তিগতভাবে তাদের কাছে ‘কিছুটা গুরুত্বপূর্ণ’ বা ‘তেমন গুরুত্বপূর্ণ নয়’।
২০১০ সালের পিউ রিসার্চের আরেকটি জরিপে আমেরিকার মেইনস্ট্রিমের জনসাধারণের কাছে একই রকম প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল। এবং সেই সময় জনসাধারণও একজন ভাল অভিভাবক হওয়াকে শীর্ষ অগ্রাধিকার হিসাবে স্থান দিয়েছে। যাই হোক, মাত্র ৫০% উত্তরদাতা বলেছেন যে এটি (একজন ভালো বাবা-মা হওয়া) তাদের জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তের মধ্যে একটি। মেইনস্ট্রিম আমেরিকান প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে আরো ৪৪% বলেছে যে একজন ভাল পিতামাতা হওয়া তাদের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ কিন্তু সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয়।
পারিবারিক ঐতিহ্য, সংস্কৃতি এবং মূল্যবোধের তারতম্যের কারণে এশিয়ান আমেরিকান এবং আমেরিকানদের মধ্যে এই তফাৎগুলো পরিলক্ষিত হয়। পিতামাতার পরিবারে বেড়ে ওঠা ছেলেমেয়েদের পরিসংখ্যান অনুযায়ী এশিয়ান-আমেরিকানদের মাঝে ৮০%, সেই তুলনায় মেইনস্ট্রিম আমেরিকানদের মাঝে মাত্র ৬৩%। এশিয়ান-আমেরিকানদের মধ্যে কয়েক-প্রজন্মের একসাথে একই হাউসহোল্ড হিসেবে একটি বৃহত্তর পারিবারিক পরিবেশে বসবাস করার প্রবণতা বেশি, যেমন বর্তমানে তা প্রায় ২৮%।
অন্যান্য উল্লেখযোগ্য পরিসংখ্যানের মধ্যে এশিয়ান-আমেরিকানরা এদেশে অধিক হারে সফল বিবাহিত জীবনযাপন করে, যেমন ৫৪% বনাম মেইনস্ট্রিম আমেরিকানদের মধ্যে তা মাত্র ৩৪%। দাম্পত্য জীবনের শুরুতেই একটি বাড়ির মালিক- ৩২% বনাম ২০%। একটি উচ্চ বেতনের কর্মজীবনে সফল হওয়ার ক্ষেত্রে ২৭% বনাম ৯%। সুতরাং পরিসংখ্যানগতভাবে বাংলাদেশী তথা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ান-আমেরিকান পরিবারগুলো সামাজিকতার অনেক দিক থেকে বিভিন্ন বিষয়েই ইতিবাচকভাবে এগিয়ে আছে বা এদেশে এগিয়ে চলছে। কিন্তু তাদের ছেলেমেয়েরা অনেক ধরণের ভোগান্তির সম্মুখীন হয়। আমাদের ছেলেমেয়েদের এদেশে জন্মগ্রহণ করা সত্ত্বেও তাদের ভিন্নতা নিয়ে মেইনস্ট্রিমের সমবয়সীদের সাথে খাপ খাওয়াতে প্রচন্ড চাপের মুখে থাকতে হয়।
নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের তাদের মূলধারায় লেখাপড়া এবং সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ উভয় ক্ষেত্রেই সাফল্যের জন্য তাদের ইমিগ্রান্ট বাবামায়েদের প্রত্যাশা পূরণে কাহিল হতে হয়। অথচ খুব কম বাবা-মা তা অনুধাবন করতে সক্ষম।
পিতামাতার প্রত্যাশা পূরণে সম্ভাব্য ব্যর্থতা ছেলেমেয়েদের পরবর্তীতে কঠিন স্ট্রেসের মধ্যে ফেলে দেয়। ফলে এইসব ছেলেমেয়ে পরে মানসিক যাতনায় ভুগতে পারে। পরবর্তী সংখ্যায় এ বিষয়গুলো নিয়ে আরো কিছুটা আলোচনার ইচ্ছা রইলো। সূত্র: সাপ্তাহিক বাঙালী, নিউইয়র্ক, অক্টোবর ২২, ২০২২
আপনার মতামত লিখুন :