গ্রন্হনা ও উপস্থাপনা : সারওয়ার খান।
স্কুলের গন্ডি পার হওয়ার আগেই রাজনীতিতে হাতে খড়ি। ‘৫২ এর ভাষা আন্দোলন পরবর্তী কর্মসূচি পালনের উদ্দিপনায় তরুন তোফাজ্জল হোসেনকে রাজনীতির প্রাথমিক পাঠে উদ্ভুদ্ধ করে। ১৯৬৮ সালের ৬ই ডিসেম্বর বায়তুল মোকাররম এর দক্ষিন প্লাজায় মজলুম জননেতা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর জনসভা পরবর্তী মিছিল ও রাজনৈতিক কর্মকান্ডে অংশ গ্রহনের মধ্য দিয়ে তোফাজ্জল হোসেনের আনুষ্ঠানিক রাজনৈতিক কর্মকান্ড শুরু। পরবর্তীতে ভাসানী ন্যাপ এর একজন একনিষ্ঠ কর্মী হয়ে আব্দুল মান্নান ভূইয়ার সহচর হিসাবে পথ চলা।
‘৬৮ সালে বায়তুল মোকাররমের ঐ জনসভা শেষে জননেতা ভাসানীর নেতৃত্বে বিশাল মিছিল বের হয়। সেই মিছিলে জনাব আব্দুল মান্নান ভূইয়ার সাথে জনাব হায়দার আনোয়ার খান, সেন্টু মোল্লা, তোফাজ্জল হোসেন, তোফাজ্জল হোসেন ভুইয়া, তোফাজ্জল হোসেন শাহজাহান ছিলেন। সেই মিছিলে পুলিশ লাঠি চার্জ করে। প্রতিবাদে পরদিন ঢাকা শহরে সকাল সন্ধা হরতাল আহ্বান করা হয়। স্বতঃস্ফূর্ত হরতালের ঐ দিনে গুলিস্তানে হরতালের পক্ষে মিছিল চলা কালে পুলিশের গুলিতে একজন নিহত ও বহু সংখ্যক আহত হন। এই মিছিলেও তোফাজ্জল হোসেন ও আব্দুল হান্নান ভূইয়া (পিপি) উপস্হিত ছিলেন।
জননেতা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী অনুধাবন করতে পেরেছিলেন যে, সরকারের পতন ঘটাতে হলে শুধু শহর কেন্দ্রিক আন্দোলন করলে হবে না। আন্দোলনকে সারা দেশে ছড়িয়ে দিতে হবে। তাই ১৯৬৮ সালের ২৯শে ডিসেম্বর গ্রাম বাংলার হাট বাজারে সকাল সন্ধা হরতালের ডাক দেন।
হরতালের সমর্থনে মনোহরদির হাতিরদিয়া ও আশেপাশের এলাকায় ব্যাপক গণসংযোগ করেন তোফাজ্জল হোসেন, তোফাজ্জল হোসেন ভুইয়া, তোফাজ্জল হোসেন শাহজাহান, সেন্টু মোল্লা, প্রফেসর আব্দুল মান্নান খান, শহীদ আসাদ। ২৯শে ডিসেম্বর হরতাল এর পক্ষে মিছিল করা কালীন অতর্কিত পুলিশি আক্রমনে তোফাজ্জল হোসেন, তোফাজ্জল হোসেন শাহজাহান, সেন্টু মোল্লা সহ আরও অনেক নেতৃবৃন্দ গ্রেফতার করা হয়।
এই ঘটনায় শহীদ আসাদ আহত হয়েও গ্রেফতার এড়াতে সমর্থ হন। ঐ দিন দুপুরে গ্রেফতারকৃতদের মুক্তির দাবিতে জনতা আবারও সংগঠিত হয়ে থানা ঘেরাও করলে পুলিশের সাথে সংঘর্ষ হয়। পুলিশ গুলি ছুড়লে সিদ্দিক মাস্টার, চাঁন মিয়া ও হাসান আলী শহীদ হোন।
এ হত্যাকান্ডের পর পরই শহীদ আসাদ ঢাকায় চলে যান। ঢাকায় পৌছে বিস্তারিত জানালে পরদিন দেশী বিদেশী বহু সংবাদ মাধ্যমে ফলাও করে পুলিশি হত্যাকান্ডের খবর প্রচারিত হয়। আন্দোলনে নতুন মাত্রা যোগ হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র নেতারা পরবর্তিতে সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠন করে ১১ দফা কর্মশুচি দিয়ে আন্দোলনকে আরও বেগবান করে তোলেন।
‘৬৮ সালের ডিসেম্বর এর শেষ দিকে শিবপুর, মনোহরদি ও কাপাসিয়া এলাকার রাজনৈতিক উত্তেজনা ও বিভিন্ন কর্মসূচী পালন করতে যেয়ে তোফাজ্জল হোসেনকে ১১ দিনের কারাবাস করতে হয় নারায়নগঞ্জের কারাগারে।
ছাত্র সমাজের ১১ দফা আন্দোলন তীব্রতা পেলে ‘৬৯ এর জানুয়ারি থেকে লাগাতার আন্দোলন শুরু হয়। পরবর্তীতে আইয়ুব সরকারের পুলিশের গুলিতে ২০শে জানুয়ারী সহযোদ্ধা আসাদ শহীদ হন। এ ধারাবাহিকতায় ‘৬৯ এর ২৫শে মার্চ আইয়ুব সরকারের পতন হয়।
১৯৭০ এর সাধারন নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদে নিরংকুশ সংখ্যা গরিষ্ঠতা নিয়ে বিজয়ী হয়। কিন্তু পরবর্তীতে জুলফিকার আলি ভুট্টো ও ইয়াহিয়া খানের ষড়যন্ত্রে পাকিস্তান সেনাবাহিনী জনতার রায়কে অগ্রাহ্য করে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতা হস্তান্তরে অস্বীকার করে। জনগনের সঃতস্ফুর্ত আন্দোলন সর্বাত্মক অসহযোগ আন্দোলনে রুপ লাভ করে। পরবর্তীতে ২৫শে মার্চ কালো রাতের অধ্যায়। নির্বিচারে বাঙ্গালি হত্যার নীল নকশার বাস্তবায়ন।
মান্নান ভূইয়ার নেতৃত্বে শিবপুরের জনগনকে সংগঠিত করে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের কর্মকান্ডে তোফাজ্জল হোসেন সক্রিয়ভাবে অংশ গ্রহন করেন। তাদের কর্মকান্ড ভৈরব, কিশোরগঞ্জ, ডেমরা পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। ১২ই ডিসেম্বর নরসিংদির পাকিস্তানি আর্মি ক্যাম্প আক্রমন ও দখল করার যুদ্ধে তোফাজ্জল হোসেন সরাসরি অংশ নেন। পরবর্তীতে ১৬ই ডিসেম্বর এর চুড়ান্ত বিজয়।
১৯৪৯ সালের পহেলা জানুয়ারি তোফাজ্জল হোসেনের জন্ম। শিবপুর হাই স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাশ করে ‘৬৯ সালে নরসিংদী কলেজ থেকে ডিগ্রি পাশ করেন। ১৯৭৩ সালে আজিজা বেগমের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন।
১৯৭০ সাল থেকেই তোফাজ্জল হোসেন শিক্ষকতার সাথে জড়িত হন ও তার স্ত্রী আজিজা বেগম ১৯৭৬ সালে বাসাবো গার্লস স্কুলে শিক্ষকতা শুরু করেন। পুনরায় ৭৭ সালে নরসিংদী মোহর পাড়া শিবপুর পাইলট হাই স্কুলে ফিরে আসেন তোফাজ্জল হোসেন। ততদিনে জনাব তোফাজ্জল হোসেনের নামের শেষে মাষ্টার যোগ হয়ে গেছে। ২০০৮ সালে শিবপুর পাইলট হাই স্কুল থেকে অবসর গ্রহন করেন।
দুই মেয়ে, নুসরাত সুলতানা ও জাকিয়া সুলতানা এবং ছেলে ওয়ালী হোসেন তনয় কে নিয়ে সাধারন সুখী পরিবার। বর্তমানে ছোট মেয়ে জাকিয়া সুলতানা ও জামাই বিশিষ্ট ব্যবসায়ী গোলাম রহমান সুমন এর সাথে ডাবলিন ওহাইওতে বসবাস করছেন। সারা জীবন রাজনীতি করে, দীর্ঘ সময় মান্নান ভূইয়ার সহচর থেকেও তোফাজ্জল হোসেন থেকে গেলেন সেই সাধারনের কাতারে। মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে প্রাপ্ত ভাতা এর প্রায় সবটুকুই ব্যায় হয়ে যায় ছোট্ট একটা বাসার বিপরীতে ব্যাংক লোনের কিস্তি পরিশোধে।
বর্নাড্য রাজনৈতিক ক্যারিয়ারে ১৯৮৪ ও ১৯৮৮ সালে ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান হিসাবে নির্বাচিত হন। দীর্ঘ প্রায় পাঁচ দশকের রাজনৈতিক গুরু, সার্বক্ষনিক পথ প্রদর্শক মান্নান ভূইয়া এক সময় বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদি দলের মহাসচিব নির্বাচিত হন। রাজনৈতিক কুটচালে ১/১১ পরবর্তী সময়ে নরসিংদী ৩ নং আসনে গুরূ মান্নান ভূইয়ার বিপরীতে এম পি ইলেকশন করতে বাধ্য হয়েছিলেন তোফাজ্জল হোসেন মাষ্টার। ২৮ বছর ছিলেন নরসিংদী জেলা বি এন পি এর সেক্রেটারী। দীর্ঘ সময়ের সত, ত্যাগী, নির্ভীক রাজনীতিবিদ জনাব তোফাজ্জল হোসেন মাষ্টার বর্তমানে অবসর জীবন যাপন করছেন।
আপনার মতামত লিখুন :