শান্ত হাতে ফোনটা তুলল রুমকি। ভাইয়াকে খবরটা এখন দিতে হবে। রাত অনেক হয়েছে। এ সময় বাবা বাসায় থাকে। অথচ আজ এ নিয়মের ব্যতিক্রম। বাবনকে স্কুল থেকে বাসায় পৌঁছে দিয়ে বাবা কোথায় যে গেছে এখন পর্যন্ত কোন খবর নেই !
শান্ত হাতে ফোনটা তুললেও ওর মনটা সত্যিই অশান্ত। এতবার ফোন করেও লাভ হচ্ছে না! ফোনটা বাবা ধরছেই না! কী হতে পারে! এসব ঝামেলা আর ভালো লাগে না! মা চলে যাবার পরই ঝামেলার শুরু। একটু ভাবলো রুমকি। না, মা চলে যাবার পর ওর বরং সুবিধে হয়েছে। বাবা এখন ওর কাছেই থাকে। আর এ কারণে ও এখন খুব নিশ্চিন্ত।
‘ হ্যালো ভাইয়া, শোন, বাবা সেই দুপুরে বেরিয়েছে এখন পর্যন্ত ফেরে নি! ‘
‘ বলিস কী! ফোন দিস নি! ‘
‘ দেই নি আবার! কতবার দিয়েছি! এখনও দিচ্ছি! কিন্তু —— ‘
‘ কিন্তু কী! ‘
‘ ধরছে না ফোন! বাবা তো এ রকম করে না! সব কাজে যে বাবা খুব সিনসিয়ার তা তো তোর জানা। ‘
‘ কিন্তু এত রাত অবদি কোথায় থাকতে পারে! ফোনই বা ধরছে না কেন! ‘
‘ আমিও তো তাই ভাবছি! আমার খুব চিন্তা হচ্ছে রে ভাইয়া! ‘
‘ থানায় জানিয়েছিস ? ‘
‘ না, তোকে না জানিয়ে থানা-পুলিশ কিছুই করি নি। ‘
‘ হাসপাতালে একটা খবর নিতে হবে। কিন্তু এত রাতে —–
‘ শোন ভাইয়া, তুই এখানে চলে আয়। তারপর দুজন মিলে দেখি কী করা যায়!’
‘ এত রাতে আসব! ‘
‘ আসতে তো হবেই! বাবা যদি সারা রাতেও না ফেরে! ‘
‘ বাবন কিছু জানে ? ‘
‘ না, ও কিছু জানে না। তবে ওর
ধারনা বাবা ওকে নামিয়ে দিয়েই চলে গেছে। ও বাবাকে বাসায় ঢুকতে দেখে নি। ‘
‘ তোকে বাবা আজ কিছু বলেছে ? ‘
‘ নাহ্! ‘
‘ তোর সাথে বাবার আজ কখন দেখা হয়েছে ? ‘
‘ সকালে। বাবনকে স্কুলে নামিয়ে দিয়ে বাবা এ সময় নাস্তা খায়। আজও খাচ্ছিলো। এ সময় তো আমার অফিসের তাড়া থাকে! একটু পরেই আমাকে বেরুতে হয়েছে! ‘
‘ এরপর আর কথা হয় নি ? ‘
‘ নাহ্! অফিসে থাকলে জরুরি কথা না থাকলে আমি ফোন দেই না! ‘
‘ ছোটচাচাকে জানিয়েছিস ? ‘
‘ বললাম না কাউকেই জানাই নি! ‘
‘ বাবার বন্ধু নসুকাকাকে একটা ফোন দিবি নাকি! বাবা তো মাঝে মাঝে ওখানে যায়! ‘
‘ এখন কাউকেই জানাতে চাইছি না! তুই আগে আয়! তারপর বুদ্ধি–পরামর্শ করে যা হয় কিছু করা যাবে। ‘
‘ সারাদিন অফিস করে এসব ঝামেলা আর ভালো লাগছে না! ‘
‘ আমারও কি ভালো লাগছে! এখন মনে হচ্ছে বাবাকে এখানে না আনলেই ভালো হতো! বাবা
নিজের বাড়িতে থেকে নিজের মতো করে চলতো! আমরা মাঝে মাঝে খবর নিতাম সেটাই ঠিক হতো! বেশি দাদায়িত্ববান হতে গিয়েই ঝামেলায় পড়েছি!
তুই আসবি তো আয় ভাইয়া!
এত কথা বলতে ভালো লাগছে না! তাছাড়া আমি একা কিছু করতে পারব না! এ দায়িত্ব তো তোরও! তুই আসতে চাইছিস কেন! এড়াতে চাইছিস দায়িত্ব ? ‘
‘ বাবা তো আমার বাসায় থাকে না! তাই আমার দায়িত্বের কথা তুলছিস কেন! ‘
‘ ও! আমার কাছে থাকে বলেই তুই দায়িত্বমুক্ত হতে চাইছিস! বাবা যদি কোন বিপদে পড়ে থাকে তবে সেটাও বলবি আমারই দোষ! ‘
‘ আমি সেটা বলি নি! ‘
‘ তবে কী বলতে চাইছিস ? ‘
রুমকি এখন অসহিষ্ণু।
‘ তোর কাছে থাকে। তাই দায়িত্বও তোর! কথাটা তো আর অস্বীকার করতে পারবি না! ‘
‘ অস্বীকার করতে চাইছিও না!
কিন্তু বাবা তো আমার একার না! সমস্ত দায়িত্ব তুই কেমন করে আমার ওপর ছাড়ছিস! আশ্চর্য! ‘
‘ আশ্চর্য হবার কিছু নেই রুমকি! বাবা তোর কাছে থাকে! কোথায় যায়, কী করে
সেটা দেখার দায়িত্ব কি আমার!
বাবার শরীর খারাপ হলে বা কোন কিছুর প্রয়োজন হলে সে দায়িত্ব না হয় নিতে পারি! কিন্তু তোর বাসা থেকে কোথায় গেলো, কী কারণে ফিরছে না সেটা তো আমার জানার এখতিয়ারে পড়ে না! ‘
‘বেশি এখতিয়ার দেখাস না ভাইয়া! এখতিয়ারের কথা যদি বলিস তবে মা চলে যাবার পর বাবার দায়িত্ব তুই আমার ওপর ছাড়লি কেন ? তখন তো চুপ করে ছিলিস! মনে হয়েছিল তুই বেঁচে গেলি! ‘
‘ তুই তো আগ বাড়িয়ে বলেছিলিস বাবা তোর কাছেই থাকবে! এখানে একা থাকতে পারবে না! মার স্মৃতি বাবাকে কষ্ট দেবে!
কী বলিস নি এসব কথা? ‘
‘ ভাইয়া, এসব কথা এখন থাক। কথান্তরে গিয়ে লাভ নেই! বাবাকে খুঁজে না পেলে কী ভয়ংকর বিপদ সামনে তা বুঝতে পারছিস ? ‘
‘ কিন্তু আসব কী করে! একটু আগে জানালে ড্রাইভারকে ছাড়তাম না! ‘
‘ আমি তোকে বিরক্ত করতে চাই নি! ভেবেছিলাম দেরি হলেও বাবা ঠিক চলে আসবে!
ভাইয়া, এক কাজ কর। তুই তো গাড়ি চালাস! আস্তে আস্তে চালিয়ে চলে আয়! ‘
‘ ভাবছি তাই করব। না হলে একটা ট্যাক্সি ডেকে নেব। তবে আজ রাতের ঘুম হারাম হলো এই যা! ‘
‘ হারাম তো আমারও হলো! তাই তো বলছি বাবার দায়িত্ব নেয়া আমার মস্ত বড় ভুল হয়েছে। সুযোগ বুঝে তুইও আজ কত কথা শোনাচ্ছিস! ‘
‘ কথা প্যাঁচাশ না রুমকি। ‘
মাথাটা গরম হয়ে আছে রুমকির। ভাইয়ার প্রত্যেকটা কথার জবাব চলে আসছে মুখে! কিন্তু এখন না! বাবা আসার পরে সব হবে। নিজেকে শান্ত করলো রুমকি।
‘ ভাইয়া, তুই কি এখন বের হবি ? ‘
‘ হতে তো হবেই। তা না হলে তুই কি ছাড়বি! ‘
এ কথাটাও হজম করলো রুমকি। বিপদে ধৈর্য হারাতে হয় না! বাবাই শিখিয়েছে কথাটা।
অমিয় একা আসে নি! সাথে নিপাকেও এনেছে। ওদের দেখে রুমকি উঠে দাঁড়ালো।
‘ ভাবি, তুমিও এসেছ! ‘
‘ না এসে আর কী করি! এত রাতে তোমার ভাইয়াকে তো একা ছাড়তে পারি না! ‘
‘ ংড়ৎৎু ! ঊীঃৎবসবষু ংড়ৎৎু ! এত রাতে তোমাকে কষ্ট দিচ্ছি! ‘
‘ এখন এসব কথা থাক! কী করতে চাও তাই বলো! ‘
‘ বুঝতে পারছি না! তোমরা বলো কী করা যায়! ‘
‘ আমি বলি আগে থানায় যাও! মিসিং ডায়রি করো! ‘
‘ আমিও তাই ভেবেছি! ‘
অমিয় এতক্ষণে বলল,
‘ রুমকি, এসবকিছুর আগে বাবার রুমটা একবার দেখলে হয় না! ‘
‘ দেখে কী হবে ? ‘
‘ কী হবে জানি না। তবুও দেখতে তো অসুবিধে নেই! ‘
‘ চল দেখি! ‘
বাবার রুমটা আজ অন্ধকার। বাবা অন্ধকার পছন্দ করে না। ঘুমোনোর আগে বাবা নরম নীলাভ আলোটা জ্বালিয়ে দিতো। রুমকি রুমের কাছে এসে বড় লাইটটা জ্বালালো। অমিয় ঢুকলো রুমে। বাবার রুমে ও তেমন আসে না। বাবা নিজের কাজ নিজেই করে। মা থাকতে বাবাকে কিছুই করতে হতো না। মা বলতো সারাদিন অফিসে এত কাজ করার পর আবার ঘরের কাজ কেন! রুমকি দেখলো বাবার বিছানার চাদরটা একদিকে ঝুলে আছে।
বিছানা গুছালেও মার মতো হয় নি! পাশের টেবিলটার দিকে চোখ গেলো। সেটাও এলোমেলো। পানির গ্লাসটা ঢাকনাহীন। বাসায় পরা চটির একপাটি উল্টে আছে। রুমকির মনটা খারাপ হয়ে গেলো। আজ বাবা ফেরে নি বলে ও এই রুমে পা রেখেছে। একবারও তো এ রুমে আসার কথা ওর মনে হয়
নি! দেখে নি বাবা কী অবস্থায় আছে! বাবাও কখনও কোন কিছু জানায় নি! এ দুবছরে বাবার কি কখনও শরীর খারাপ হয় নি! প্রাত্যহিক খাবারের বাইরে বাবার কি কিছু খেতে ইচ্ছে করে নি! বাবার তো বয়স হয়েছে! বয়সের কিছু অসুখ তো হতেই পারে! রাতে ভালো ঘুম হয় নি বলে ভোরে উঠতে পারে নি—–পারে নি বাবনকে সময়মতো স্কুলে পৌঁছে দিতে!
শুধু বাবনকেই পৌঁছে দেওয়া না, নিয়মিত বাজার করতে হয় বাবাকে। এ কারণে মাসুকের সাথে ওর ঝগড়াও কমে গেছে।
মাসুক বাজার করতে চায় না! অফিস ফেরত রুমকিকেই কাজটা করতে হতো! রুমকি অবশ্য মাসুকের ওপর এর ঝাল ঝাড়তে ভুল করতো না! বাবা থাকাতে রুমকি এখন নিশ্চিন্ত। মাসুকের সাথে বেশ মাখোমাখো ভাব ওর।
বাবা কী সুন্দর গুছিয়ে বাজার করে। যা যা বলা হয় তার সবই আনে। বাবা মাকেও এভাবে গুছিয়ে বাজার এনে দিতো। মা যত্ন করে রান্না করতো। বাবার পাতে যখন খাবারটা তুলে দিতো বাবা তৃপ্তির সাথে খেতো। সারাদিন বাবার মুখে ওই তৃপ্তির হাসিটা লেগেই থাকতো। বাবা তো ওকেও বাজার এনে দেয়। কই ও তো কখনও খোঁজ নেয় নি বাবা খেয়েছে কি না! এ কথাটা ওর মনেই আসে নি!
ছোটবেলা থেকে বাবাকে কখনও খুব একটা অসুস্থ হতে দেখে নি। তবে মাঝে মাঝে জ্বর হলে মাকে দেখতো বিছানায় শুইয়েই মা বাবার মাথায় পানি দিতো, গা মুছিয়ে দিতো। খাটের পাশেই একটা টেবিল এনে ওখানেই খাবার দিতো। বাবাকে উঠতে দিতো না!
রুমকি মনে করার চেষ্টা করলো, এখানে আসার পর বাবার জ্বর হয়েছিলো কি না! মনে পড়লো—–হয়েছিলো। একবার বৃষ্টিতে ভিজে বাবনকে স্কুল থেকে আনার পর বাবা জ্বরে পড়েছিলো। পরের দিন বাবাই আবার বাবনকে স্কুলে পৌঁছে দিয়েছিলো। ও তো একবারও বলে নি, বাবা জ্বরো শরীরে তোমাকে আজ যেতে হবে না! আমরাই বাবনকে পৌঁছে দেব! এমন কী অফিস থেকে ফিরে বাবার খবরও ও নেয় নি! এসব কথা ওর মনেই পড়ে না।
শূন্য ঘরে ঢুকে আজ কেন এসব কথা মনে পড়ছে! কেন মনের ভেতরের শুকনো ভাবটা বাইরে আসতে চাইছে! কেন আজ ও অদ্ভুত কষ্ট অনুভব করছে! কেনই বা মনে হচ্ছে এ বাড়িতে অযত্নে অবহেলায় পড়ে থাকা মানুষটা আর হয়তো ফিরে আসবে না!
‘ রুমকি, দাঁড়িয়ে রইলি কেন ?
আলমারিটা খোল! ‘
‘ কী দেখবি ওখানে ? ‘
‘ কিছু লিখে রেখে গেছে কি না——রুমকি পায়ে পায়ে এগিয়ে গিয়ে একটা পাল্লা খুলে দিলো।
‘ দেখ কী দেখবি! আমার ধারনা
বাবা কিছু লিখে রেখে যায় নি। ‘
অমিয় আলমারির মধ্যে কিছু একটা খুঁজতে লাগলো। না, কিছুই পেল না!
‘বাবা এভাবে আমাদের বিপদে ফেলবে তা ভাবতেও পারি নি রুমকি!’
কথাটা বলে অমিয় এবার বাবার ভাঁজ করা কাপড়ে হাত দিলো। উল্টে পাল্টে দেখতে লাগলো। বাবার কাপড়চোপড় তেমন নেই। বাবাই কিনতে চাইতো না। বলতো, আমি আর এখন যাই কোথায়! কাপড় দিয়ে কী হবে! শুধু শুধু পয়সা নষ্ট!
বাবার শেষের কথাটায় কষ্টের ছোঁয়া থাকতো—- মা চলে যাবার কষ্ট!
অমিয় আলমারির ড্রয়ার খুলে চমকে উঠলো।
‘ রুমকি, তুই বাবাকে ফোন দিয়েছিলিস না! ‘
‘ কতবার দিয়েছি! কিন্তু ধরে না।’
‘ ধরবে না তো! ‘
‘ কেন!
এই দেখ বাবা ফোন বন্ধ করে ড্রয়ারে রেখে চলে গেছে। ‘
‘ মানে! ‘
‘মানে কিছুই না! বাবা ঠাণ্ডা মাথায় এখান থেকে চলে গেছে।’
‘চলেই যদি যাবে তো বলে যেতে পারতো! আমি তো আটকে রাখি নি! মা নেই! বাবার কষ্টের কথা ভেবেই এখানে, আমার কাছে এনেছিলাম! ‘
রুমকির কাছে নিজের গলার স্বরটা ন্যাতানো মনে হচ্ছে। আগের তেজটা কোনভাবেই ফিরে পাচ্ছে না।
‘ রুমকি, থানায় গিয়ে মিসিং ডায়রি করতে হবে। অন্য কোথাও খুঁজে লাভ নেই। এটা বাবার পরিকল্পিত চলে যাওয়া।
পুলিশ যেভাবে পারে খুঁজে বের করবে। ‘
রুমকির মুখটা থমথমে। এভাবে চলে যাওয়াটা কি বাবার প্রতিবাদ না প্রতিশোধ ! না, বাবামা কখনও প্রতিশোধপরায়ন হয় না ! তাহলে কী প্রতিবাদ!
অথবা নিজের মতো করে বাঁচার জন্যই কি বাবা চলে গেলো ওদের জীবন থেকে! রুমকির কাছে হঠাৎই হিসেবটা এলোমেলো মনে হচ্ছে।
‘রুমকি থানায় যেতে হবে!’
‘আমাকেও যেতে হবে?’
‘ না, আমি যাচ্ছি।”
ডোরবেলটা বেজে উঠলো। সবাই চমকে তাকালো দরজার দিকে। বাবা কি তাহলে ফিরে এলো! অথবা বাবার কোন খারাপ খবর নিয়ে কেউ এলো!
অমিয় এগিয়ে এসে বলল,
‘ কারোর যেতে হবে না। আমি দেখছি।’
(গল্পের শেষ অংশ পরবর্তী সংখ্যায় প্রকাশিত হবে)
আপনার মতামত লিখুন :