আমেরিকায় আমাদের নতুন প্রজন্ম – মিজান রহমান নিউইয়র্ক


ওহাইও সংবাদ প্রকাশের সময় : মে ১৯, ২০২৩, ৬:৫৭ অপরাহ্ণ /
আমেরিকায় আমাদের নতুন প্রজন্ম – মিজান রহমান নিউইয়র্ক

ধারাবাহিক-১১০
এদেশে বাংলাদেশী ইমিগ্রান্ট পরিবারগুলো, তথা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ান বা এশিয়ান-আমেরিকানরা তাদের পারিবারিক মূল্যবোধ রক্ষায় অনেক গুরুত্বারোপ করেন। তারা এদেশে তাদের সন্তানদের সাফল্যের ওপর দূরবীনের মত করে দৃষ্টি নিবদ্ধ রাখার প্রয়াস চালায়। কিন্তু তারা তা করতে গিয়ে অনেক সময়ই ভুলে যান যে এদেশে জন্মগ্রহণ করা তাদের ছেলেমেয়েদের বেড়ে ওঠার ক্ষেত্রে দুটি ভিন্নতর সংস্কৃতির ব্যবধানের টানাপোড়নের মধ্যে পড়তে হয়। মনোবিজ্ঞানীদের মতে এই ব্যবধান পূরণ করার উপায়গুলির মধ্যে রয়েছে খোলামনে ভালভাবে পারস্পরিক যোগাযোগ রক্ষা করা, একে অপরের দৃষ্টিভঙ্গির সাথে সহানুভূতিশীল হওয়া, পার্থক্যগুলো চিহ্নিত করা ও গ্রহণ করা। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো এই বিষয়ে পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও সম্মান দেখানো।

এখন প্রশ্ন আসতে পারে যে, আমরা কিভাবে আমাদের ছেলেমেয়েদের মাঝে এই বিষয়ে আরো ভাল করে বোঝাতে পারি? এর উত্তরে কয়েকটি বিষয় এখানে আলোচনা করা যেতে পারে। প্রথমত, আমাদের সন্তানদের সাথে আরও ভালভাবে যোগাযোগ প্রতিষ্ঠা করা ও রক্ষা করা। বাবা-মা হিসেবে আমরা এদেশে আমাদের সন্তানদের নিয়ম- শৃঙ্খলাগুলি ব্যাখ্যা করে বুঝাতে পারি এবং কেন সেগুলো মেনে চলা গুরুত্বপূর্ণ তাও তাদেরকে বুঝিয়ে বলতে পারি। উদাহরণস্বরূপ, তাদেরকে বুঝিয়ে বলা কেন স্কুল স্কিপ করা যাবে না, কারণ এটি তাদের শিক্ষা অর্জনের ক্ষেত্রে ক্ষতি করবে এবং শেষ পর্যন্ত তাদের একাডেমিক ও পেশাগত লক্ষ্য অর্জনকে নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করবে।

এদেশ সম্পর্কে, এদেশের সামাজিকতা সহ আরো অনেক বিষয়েই এদেশে জন্ম নেয়া আমাদের ছেলেমেয়েরা আমাদের চেয়ে বেশী জানবে ও বুঝবে। সুতরাং বাবা-মা হিসেবে আমরা তাদেরকে বিভিন্ন বিষয়ে প্রশ্ন করতে পারি, তাদের জীবনযাত্রার প্রতি আমাদের আগ্রহ দেখাতে পারি। আমরা ধৈর্য্য নিয়ে তাদের কথা শুনতে পারি, আমাদের মুখ খোলার আগে তাদেরকে কথা বলতে উৎসাহিত করতে পারি। আমাদের চিরাচরিত ভাবধারায় আমরা শুধু বলে যাবো আর তাদেরকে শুধু শুনতে হবে, যেটা হয়ত স্বদেশে আমাদের বাবা-মারা আমাদের শিখিয়েছিলেন, এই অভ্যাস আমাদের ত্যাগ করতে হবে ষ এবং তা করতে হবে এদেশে আমাদের ছেলে-মেয়েদের সাথে কার্যকরভাবে যোগাযোগ রক্ষা করার জন্য। তা না হলে ছেলেমেয়েরা যখনই সুযোগ পাবে তখন থেকেই আপনার সাথে কথা বলা বা যোগাযোগ রক্ষা করা কমিয়ে দেবে বা বন্ধ করে দেবে।

এদেশে আমাদের নতুন প্রজন্মের ছেলে-মেয়েদের এটাও বুঝতে হবে এবং বিশ্বাস করতে হবে যে তাদের পিতা-মাতার হৃদয়ে তাদের (ছেলে-মেয়েদের) জন্য অকৃত্রিম ভালোবাসা ও সর্বোত্তম নিঃস্বার্থ আকাঙ্খা রয়েছে। প্রতিটি বাবা-মাই তাদের সন্তানের মঙ্গল চায়। সন্তান নিরাপদে থাকলে, সুখে বা আনন্দে থাকলে, তাদের জীবন সাফল্যময় হলে, তাই বাবামায়ের সর্বোত্তম সুখ। বাবা- মায়েদের আরেকটি বড় দায়িত্ব হলো এদেশে ছেলেমেয়েদের আশ্বস্ত করা যে তারা (ছেলে-মেয়েরা) যেকোন বিষয়েই তাদের বাবা-মায়ের সাথে কথা বলতে পারে।

ছেলেমেয়েদের এটাও বুঝতে হবে যে তাদের ইমিগ্র্যান্ট বাবা-মায়েরা তাদের কাছ থেকে অনেক কিছুই শিখতে পারে। সুতরাং এটা তাদের একটা দায়িত্ব হিসেবে নিতে হবে যে তারা তাদের বাবা-মাকে এই আধুনিক বিভিন্ন ইলেট্রনিক্স মিডিয়া বা সোশ্যাল মিডিয়া সম্পর্কে জ্ঞান দেয়া। যেমন, মাইনক্র্যাফট ভিডিও গেমস, ডিস্কর্ড, টিকটক, স্ন্যাপচ্যাট, টুইটার বা ইনস্টাগ্রাম ইত্যাদি যে ক্ষতিকর নয় এমনভাবে ব্যবহার করা যেতে পারে সে সম্পর্কে তাদের জ্ঞান দেয়া বা আশ্বস্ত করা।

মনোবিজ্ঞানীদের মতে ‘পুট ইউরসেলফ ইন ইচ আদার’স শুজ এবং সেইভাবে পরস্পরের অবস্থান বা দৃষ্টিভঙ্গি বোঝার চেষ্টা করাটা একটা ভালো কৌশল হিসেবে গ্রহণ করা যেতে পারে। ইমিগ্র্যান্ট বাবা-মায়েদের উচিত আমেরিকান সমাজ ও সংস্কৃতি সম্পর্কে যতটা সম্ভব ওয়াকেবহাল হওয়া এবং তাদের সন্তানদের কাছ থেকে কী আশা করা হয় সে সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান অর্জন করা। আপনার সন্তানদের ফিট-ইন করতে বা হতে সাহায্য করুন। আপনার নিজস্ব সংস্কৃতির বিভিন্ন উৎসবগুলোর পাশাপাশি আমেরিকান ছুটির দিনগুলি উদযাপন করার কথা বিবেচনা করুন। ছেলে-মেয়েদের সাথে আমেরিকান খেলাধূলা, আমেরিকান সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের এক্সপোজার হওয়ার কথা বিবেচনায় রাখুন। শুধুমাত্র দিক-নির্দেশিকা নয় বরং তাদেরকে মানসিকভাবেও সমর্থন প্রদান করার চেষ্টা করুন। এর মানে এই নয় যে ছেলেমেয়েদের তাদের নিজস্বতাকে বিলিয়ে দিতে হবে, বা আমেরিকার সব সামাজিকতার মাঝে হারিয়ে যেতে হবে, তা কিন্তু নয়। তারা তাদের পারিবারিক মূল্যবোধ, ধর্মীয় বিশ্বাস, সংস্কৃতি ও ভালো আচার-আচরণগুলো ধরে রেখেই আমেরিকার অনেক কিছু সম্পর্কে ধারণা নিতে পারে বা শিখতে পারে, এমনকি চর্চাও করতে পারে।

আপনি যদি ‘একসেপ্ট এন্ড রেস্পেক্ট দ্য ডিফারেন্স’ এই কৌশলটি কার্যকরভাবে বহাল করতে পারেন আপনার ছেলে-মেয়েদের সাথে তাহলে এদেশে আপনার এবং তাদের মধ্যে একটি ভারসাম্যময় জীবন যাপনের নিশ্চয়তা অনেকগুণ বেড়ে যাবে এবং সার্বিক পারিবারিক শান্তি, সমৃদ্ধি ও সফলতা অর্জন সহজতর হবে। প্রথমত ইমিগ্র্যান্ট বাবা-মা হিসেবে আমাদের এটা বুঝতে হবে যে এদেশে জন্ম নেয়া আমাদের সন্তানদের বাড়তি অনেক বোঝা বা চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়ে বেড়ে উঠতে হয়, শুধুমাত্র তারা কোন ইমিগ্র্যান্ট পরিবারে জন্ম নেয়ার কারণে।

সাংস্কৃতিক দৃষ্টিকোণটি বাদ দিয়ে, ইমিগ্র্যান্ট পিতামাতা এবং এদেশে জন্ম নেয়া আমাদের নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের মধ্যে সর্বদাই কিছু পার্থক্য থাকবে। বিশেষ করে যখন ছেলেমেয়েরা তাদের কৈশোর এবং বয়ঃসন্ধি- বয়সে পরিণত হয়। ইমিগ্র্যান্ট বাবামা হিসেবে আমাদেরকে তা যেমন বুঝতে হবে, একইভাবে এদেশে জনগ্রহণ করা আমাদের ছেলেমেয়েদেরও বুঝতে হবে যে তাদের বাবা- মায়েরা (আমরা) সম্পূর্ণ ভিন্ন একটা পরিবেশে থেকে বেড়ে উঠেছিলাম। সুতরাং পরস্পরের প্রতি সংবেদনশীল হয়েই উভয়কে একটা সমঝোতা নিয়ে চলার মানসিকতা তৈরী করতে হবে।

পরবর্তী সংখ্যায় বাংলাদেশী তথা দক্ষিণ- পূর্ব এশিয়া বা এশিয়ার পরিবারগুলোর সাথে এদেশের মেইনস্ট্রিম আমেরিকান ও অন্যান্য পরিবারগুলোর মধ্যে যে পার্থক্য পরিসংখ্যানভাবে সর্বজ্ঞাত তা নিয়ে কিছুটা আলোচনা করার ইচ্ছা রইলো। সূত্র: সাপ্তাহিক বাঙালী, নিউইয়র্ক, অক্টোবর ১৫, ২০২২