এ বাড়িতে আমার রুমটা পুবদিকে। এ দিকে দুটো বড় জানালাও আছে। আমি সুযোগ পেলেই জানালা দিয়ে আকাশটা দেখি। আকাশ আর সমুদ্রের বিশালতা আমাকে ভীষণভাবে টানে। আনন্দে কী বিষাদে সব অবস্থাতেই মনে হয় এভাবে জানালার কাছে অথবা খোলা জায়গায় দাঁড়িয়ে আকাশ দেখি। এই বিশালতার কাছে নিজেকে সমর্পণ করি। রঙ বদলানো আকাশটাকে এক এক সময় এক এক রকম মনে হয়! ভোরের নরম গোলাপি আকাশ,
দুপুরের সোনাঝরা আকাশ, বিকেলের সাদাকালো মেঘের পাহাড়ে ছাওয়া আকাশ আর সন্ধের আবির ছড়ানো আকাশটা আমার দারুণ লাগে!
আমি কিছুক্ষণের জন্যে হলেও হারিয়ে যাই ওই অনন্ত আকাশের মাঝে।
আমি থাকি কলম্বাস শহরে। এখানে বছরের সাতমাসই ঠাণ্ডা। বাকি সময়টাতে শীতের প্রকোপ কম থাকলেও আমাদের দেশের মতো গরমের আধিক্য নেই। এ সময়টাতে আমার ভালোই লাগে। বসন্তকে উপভোগ করি পুষ্পিত গাছের দিকে তাকিয়ে। পত্রহীন গাছগুলো ফুলভারে নত। বিচিত্র তাদের রঙ! সে রঙ শুধু চোখই ধাঁধায় না! মনকেও ধাঁধায়! আমাদের পেছনের বাড়িটার পেছনের আঙিনায় গোলাপি ম্যাগনোলিয়া ফুটেছে। তারই অনতিদূরে ফুটেছে সাদা আর বেগুনি চেরি। আমার রুমের পাশেই আছে লাইলাক। কুঁড়িতে ভরে গেছে গাছটা। শীতের কারণে আমি এখনও গাছটার কাছে যাই নি। তবে অপেক্ষায় আছি কবে ফুটবে—-কবে সৌরভ ছড়াবে! সৌরভ আর সৌন্দর্য দুটোই তো সমান মূল্যবান! এ দেশে সীমানা প্রাচীর নেই বলে পাশের বাড়ির গাছগুলোও আমাদের আঙিনার গাছ বলেই মনে হয়!
সৌন্দর্য এক সূক্ষ্ম অনুভূতি। তাই নিজেদের আঙিনা বা অন্যের আঙিনা হোক সৌন্দর্যের এই সূক্ষ্ম অনুভূতিগুলি আমাকে ছুঁয়ে যায়।
রোজা প্রায় শেষ। সম্ভবত আর দুটো রোজা বাকি আছে। হাতে কোন কাজও নেই। ইদের অপেক্ষায় আছি। মাঝে মাঝে নতুন উপন্যাসের দুএক পাতা লিখি। এবার লেখাটা এগোচ্ছে না! বুঝতে পারছি কেন! ভাবছি আমি কি অলস হয়ে পড়ছি! অথবা রোজার ক্লান্তি আমাকে ঘিরে ধরলো! উত্তরটা অবশ্য তেমন সিরিয়াসলি খুঁজি নি।
আমার নতুন উপন্যাসের নাম ‘একা’। পতিতালয়ে বেড়ে ওঠা একটা মেয়ের জীবন কাহিনি। আমাকে এ জন্য অবশ্য একটু পড়াশুনা করতে হচ্ছে।
যা বলছিলাম, প্রায় একমাস রোজার কারণে রোজাগুলি বেশ কষ্টকর মনে হচ্ছিল। শেষের দিকে এমনই মনে হয়। আবার মন খারাপের ছোঁয়াও ছিলো। মন খারাপের ছোঁয়া বলছি এ কারণে, রোজা শেষ হয়ে গেলো। আগামি বছর কী হবে তা জানি না! কথাগুলি ভাবতে ভাবতে অভ্যেসমত আকাশের দিকে তাকালাম। মেঘ জমেছে আকাশে! ধূসর আকাশটাকে কেন যেন বুড়ো বলে মনে হলো।
না, আকাশটা বুড়ো না, আমার মন খারাপই আকাশকে বুড়ো বানিয়েছে! মেঘাচ্ছন্ন আকাশে অনেক সময় মন খারাপের ছোঁয়া থাকে! এ সময় কখনও কখনও পুরোনো কথা মনে পড়ে যায়! আমি ইচ্ছে করেই জানালা থেকে সরে এলাম। ফোনটা হাতে নিয়েই দেখলাম একটা ম্যাসেজ এসেছে। রিতার ম্যাসেজ। এইচ, বি, রিতা।
‘ প্রথম আলো ‘ পত্রিকার সাহিত্য সম্পাদক ( নিউইয়র্ক শাখা )।
ও লিখেছে ইদের আগের রাতে জুম ইদ আড্ডা হবে। আমাকে সে আড্ডায় যুক্ত হতে বলেছে।
রিতাকে কখনও সামনাসামনি দেখি নি। তেমন কথাও হয় না। লেখালেখির মাধ্যমেই পরিচয়। তবুও রিতাকে আমার ভালো লাগে। দারুণ দারুণ সব কবিতা লেখে। ওকে না দেখেও বুঝতে পারি ও খুব গুণের মেয়ে। সেইসাথে খুব কাজেরও।
জুম আড্ডায় কথা বলতে গিয়ে আমার কিছুটা অজান্তেই আমার শৈশবকে কাছে নিয়ে এলাম। আর এ পর্যায়ে আমি বেশ কিছুটা আবেগপ্রবণও হয়ে উঠলাম। শৈশবের ইদ ছিলো নির্মল আনন্দে মোড়া। যাকে বলে দায়িত্বহীন আনন্দ। ইদের আগের রাতে উত্তেজনায় ঘুম আসতো না। নিদ্রা আর জাগরণের মাঝেই ভাঙা ভাঙা স্বপ্নে দেখতাম আমার সেই বহু আদরের, বহু কাঙ্ক্ষিত লুকিয়ে রাখা জামাটা পরেছি! স্বপ্নেও সাবধান থাকতাম ভোর হবার আগে জামাটা যেন কেউ দেখে না ফেলে! নতুন জামাটা পরে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে নিজেকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে দেখতাম। তবে এখন এ কথা মনে করে হাসি পেলেও স্বপ্নটা কিন্তু নিছক স্বপ্ন ছিলো না! এটাই করতাম! নতুন জামা পরে বন্ধুদের নিয়ে ঘুরতে বের হতাম। আমাদের দলে শুক্লা সরকার নামে এক বন্ধু ছিলো। ও ভোরেই আসতো আমাদের বাসায়। মা খুব যত্ন করে আমাদের সাথেই ওকে খেতে দিতো। ও যে অন্য ধর্মের মানুষ তা কখনও ভাবতাম না। এখনও ভাবি না। এসব সার্বজনীন উৎসবে সবারই সমান অধিকার আছে এ কথাটা ছোটবেলা থেকেই শিখেছি। সে এক দারুণ সময় ছিলো আমাদের!
এখন টেবিল ভর্তি কত্ত রকম খাবার থাকে। আমাদের সময় এতো কিছু মনে হয় হতো না। খাবারের প্রধান আকর্ষণ ছিলো কোরমা-পোলাও আর সেমাই। আমরা এ সব খাবারই আগ্রহের সাথে খেতাম।
আড্ডা দিতে গিয়ে এক সময় আবেগে আমার গলাটা আটকে এলো। খাবারের প্রসঙ্গে মার কথা ভীষণভাবে মনে পড়তে লাগলো। কোথায় হারিয়ে গেলো আমার মা! কী করলে, কোথায় গেলে মাকে আবার দেখতে পাব! আবার কাছে পাব! সেই মুহূর্তে কেবল একটি কথাই মনে হতে লাগলো মাকে যদি আবার দেখতে পেতাম ——
এ সময় আমার মনে হলো পত্রিকার সম্পাদক ইব্রাহিম চৌধুরী আমার মনটাকে ঘুরিয়ে দেবার জন্য আমাকে অন্য প্রশ্ন করলেন। আমি বুঝলাম ব্যাপারটা! আর তখনই ইব্রাহিম চৌধুরীকে খুব কাছের মানুষ বলে মনে হলো। যদিও ওঁকে আমি সামনাসামনি দেখি নি! লেখালিখির মাধ্যমেই পরিচয়। ওঁর কারণেই আমার যন্ত্রণাটা আর বাড়তে পারলো না। এক অদ্ভুত প্রশান্তিতে ছেয়ে গেলো মন। নিজেকে সান্ত্বনা দিলাম এ কথা বলে মা আর কোনদিনও আসবে না! আসতে পারে না! এটাই জগৎসংসারের অমোঘ নিয়ম! তবুও সেই মুহূর্তে আমার আবেগপ্রবণ মনকে-আমার বুকের ভেতর দুলে ওঠা নদীটাকে শান্ত করার জন্য আমি ইব্রাহিম চৌধুরীর কাছে কৃতজ্ঞ। মনে মনে বলি ভালো থাকবেন আপনারা —- আপনি, রিত !
পরের দিন ইদ ববি কাজে চলে গেলো। আমি আমার বেয়ান জাকিয়া সুলতানা, দীবা সুলতানা আর সারোয়ার বেয়াইয়ের সাথে নামাজ পড়তে গেলাম। রথীর ছুটি ছিলো। বাসায় ফেরার পর রথী বলল, আমরা লিটন কবীরের বাসায় যাব। আমরা গেলাম তানিয়া আর লিটন দম্পতির বাসায়। ইদের এলাহি খাবারের বর্ণনা দেব না! তবে ওর বাসায় গিয়ে মনটা প্রশান্তিতে ভরে গেলো। সারা ঘর ভর্তি নানা রকম গাছের ছড়াছড়ি। আমি মুগ্ধ চোখে তা দেখতে লাগলাম।
গল্পে গল্পে অনেকটা সময় কেটে গেলো ওখানে। বিকেলে আমরা সবাই মিলে গেলাম বাবু আর আঁখিদের বাসায়। খাওয়াদাওয়ার পাশাপাশি গল্পে জমে গেলাম আমরা। বেশিক্ষণ অবশ্য বসতে পারলাম না। সন্ধের পর যাব এরিনা আর শিবলিদের বাসায়। ও বাসায়ও এলাহি কাণ্ড-কারখানা! কথা বলতে বলতে একটা জায়গায় আমার চোখ আটকে গেলো! কম বয়সী মেয়েদের আসর ছিলো সেটা! ওদের বিচিত্র রঙের পোশাক আর নয়নাভিরাম সাজসজ্জা আমাকে মুগ্ধ করলো। না, আমি ওদের বিরক্ত করলাম না! কেবল মুগ্ধ চোখে চেয়ে রইলাম। চেয়ে থাকতে থাকতে এক সময় মনে হলো ওরা ওরা যেন একঝাঁক প্রজাপতি নয় তো পরি অথবা স্বর্গের অপ্সরী। ভুল করে ওরা এখানে চলে এসেছে! সে এক মনোরম দৃশ্য!
এরিনা আর শিবলি খুব ব্যস্ত। আমাদের আপ্যায়ন করছিলেন এরিনার আম্মা মানসুরা আপা।
ইদের দ্বিতীয় দিনে লিটা আর হাবিবের বাসায় দাওয়াত। ওরা আমার খুব কাছের মানুষ। আমার ‘বয়ে যায় বেলা ‘বইয়ে ওদের কথা লিখেছি। ওখানে দেখলাম বিশাল আয়োজন। কী নেই মেনুতে! আমি খাবারের দিকে গেলাম না! মানসুরা আপা আর বেয়ান জাকিয়া সুলতানার সাথে গল্পে বসে গেলাম। রাত করে বাড়ি ফিরলাম। ইদের তৃতীয় দিনে গেলাম পিনুর আর নীপার বাসায়। এখানেও গল্পের আসর বসেছে। পিনু আমাদের ওই আসরেই গান শোনালো। এভাবেই চলে গেলো ইদের তিনটে দিন।
সোমবার থেকে সবার কাজ। ভোরেই চলে গেলো সবাই। আমি গোত্তা খাওয়া ঘুড়ির মতো পড়ে রইলাম একা। তবুও প্রাত্যহিক অভ্যেসগুলিকে জোর করেই কাছে টেনে আনলাম। মনটাকে শাসন করলাম শক্ত হাতে।
আমাদের সবারই একটা অতীত আছে। সে অতীত পড়ে যাওয়া বা উঠে দাঁড়ানোর গল্পে ভরা। অতীতে আমার জীবনটা ছিলো কর্মমুখর । এখন অলস সময় পার করছি। অতীতের সেই কর্মময় জীবনটা মাঝে মাঝেই হানা দেয়! তবে এ কথাটাও সত্যি যে, আমি যাকে অলস জীবন বলছি তা আসলে আমার অবসর যাপন! এরও তো প্রয়োজন রয়েছে জীবনে! আমি জানি জীবনের কিছু কিছু ঘটনা মানুষকে পৌঁছে দেয় লক্ষ্যে আবার কিছু কিছু ঘটনা এক সময় মানুষকে থামিয়েও দেয়! এটাই তো জীবনের ধর্ম!
প্রতিটা জিনিসেরই একটা শেষ থাকে। লেখার যেমন থাকে উপসংহার! কিন্তু আমি আজকের লেখার উপসংহার দিতে পারছি না! কী লিখব উপসংহারে! জীবনটা তো বহতা নদী—বয়ে চলে নিরন্তর! কোথায় কীভাবে এর শেষ লেখা আছে তা তো আমরা জানি না! বহতা নদীর কী উপসংহার থাকে!
জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। না, আকাশটাকে আজ বুড়ো মনে হলো না! তারুণ্যে ভরা সোনালি আকাশ! নীলাভ আকাশটাকে এখন অন্যরকম লাগছে! কী রকম তা বলতে পারছি না।
এখানে দুপুরে মেপেল গাছের পাতার আড়ালে কী যেন একটা পাখি ‘টুই টুই’ করে ডাকে। পাখিটার নাম জানি না। তবে এ ডাকটা শুনলে মনে একটা চেনা সুর বেজে ওঠে। বাংলাদেশেও এ রকম একটা পাখি ডাকে!
‘টুই টুই’ শব্দটা মনের ভেতরে ধরে রাখার চেষ্টা করি। আর তখনই আমার উত্তরার বাড়ির পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া তুরাগ নদীটা আমার কাছে এসে দাঁড়ায়! আমার দৃষ্টিতে তখন মেপেল গাছটা হয়ে যায় ঘন পল্লবে ছাওয়া কাঁঠাল আর মেহগিনি গাছ। যার পাতার আড়ালে ‘টুই টুই’ করে পাখিটা ডাকে অথবা সাথীকে ভালোবাসা জানায়! চেনা সুরটা তখন গভীর থেকে গভীরতর হয়ে বুকে বাজে। আর আমি তখন হারিয়ে যাই দিগন্তরেখার সবুজ প্রান্তে। নদীর পাড়ের সবুজ ঘাসজমিতে দেখতে পাই কিছু শালিখ ওড়াউড়ি করছে। দারুণ লাগে তখন! কাঁঠাল আর মেহগিনির পাতা কাঁপিয়ে মৃদুমন্দ বাতাস বয়ে যায়। তখন মনে হয় আমি তো একা নই! এরাও তো আছে আমার সাথে!
আমি তখন নাম না জানা বুনোফুলের গন্ধ পাই!
আজকের লেখাটার নাই বা থাকলো উপসংহার! তবুও তো আকাশের দিকে তাকিয়ে আমি খুঁজে পাই ক্ষীণস্রোতা নদীটাকে, নদীর ওপারের দিগন্তরেখাকে। পাতার আড়ালে মিশে যাওয়া ‘টুই টুই’ পাখিকে। আর ঘাসজমিতে বিচরণরত শালিখের ঝাঁককে! এক সময় বিকেলের আলোয় অন্ধকার মেশে। গাছে লাগে ধূসর রঙ। ছায়া ছায়া ধূসর রঙ আমাকে আমার রঙিন শৈশব আর সোনাঝরা তারুণ্য ফিরিয়ে দেয়! তখন বুকের ভেতর একটা পাখি না, হাজার পাখির ‘টুই টুই’ শব্দ শুনতে পাই! ওদের উর্মিল আবেদন আমাকে বেঁচে থাকার—স্বপ্ন দেখার আশ্বাস দেয়!
আপনার মতামত লিখুন :