বাঙালিদের উৎসবের শেষ নেই। দেশের বাইরে সুনাম আছে বাঙালিদের উৎসবপ্রিয়তার। সেসব উৎসব যে কেবল উদ্্যাপিত হয় তা নয়, রীতিমতো সমারোহের আয়োজন থাকে উদ্্যাপনে। বাংলার ছয় ঋতু। ছয় ঋতুকেই বাক্সময় করে তুলেছেন কবি-সাহিত্যিকেরা তাদের কবিতায়, শিল্প-সাহিত্যে। এর মধ্যে বর্ষা ও বসন্ত সব ঋতুর চেয়ে এগিয়ে। নোবেল পুরস্কারজয়ী বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাব্যে, সাহিত্যকর্মে বর্ষা ও বসন্তকে কতভাবে যে রূপে-রসে বর্ণময়তায় তুলেছেন, তার ইয়ত্তা নেই। বাংলার ছয় ঋতুও বিশেষ সুস্পষ্ট বৈশিষ্ট্য নিয়ে নিজেদের প্রকাশ করে। লোকসাহিত্যেও ছয় ঋতুর বিশেষ জায়গা রয়েছে। ঋতুর বর্ণময় উৎসবের পাশাপাশি রয়েছে আরো কিছু উৎসব, যার সঙ্গে ঋতুর সম্পর্ক নেই। কিন্তু বাঙালির লড়াই-সংগ্রামের বীরত্বগাথা জড়িয়ে আছে। জড়িয়ে আছে দেশের জন্য, স্বাধীনতার এবং মুক্তির ইতিহাস।
লাখো মানুষের জীবনদানের মধ্য দিয়ে সেসব অর্জিত হয়েছে। বিশেষ কটি মাসে এসব উৎসবের আধিক্য লক্ষ করা যায়। ফেব্রুয়ারি মাস ভাষার মাস। মায়ের মুখের ভাষা বাংলাকে হায়েনাদের গ্রাস থেকে উদ্ধার করতে গিয়ে বাঙালিদের স্বাধীন পাকিস্তানে লড়াইয়ের এবং আত্মত্যাগের শুরু। ছাত্র-জনতার রক্তে রঞ্জিত হয়েছিল ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি। আদায় হলো মায়ের ভাষার রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি। জন্ম হলো আত্মত্যাগীদের জন্য নিবেদিত অমর গান ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’। বাঙালির অর্জনের ইতিহাসে আরো আছে মার্চ মাসে স্বাধীনতা দিবসের উদ্্যাপন।
৩০ লাখ মানুষের জীবনদান এবং লাখ লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে অর্জিত হয় সেই স্বাধীনতা। যা কেবল বাঙালিদেরই আরাধ্য নয়, বিশ্বের সব দেশ এবং মানুষেরই স্বপ্নÑস্বাধীনতা। বাঙালিরা সেই স্বাধীনতা অর্জন করেছে নয় মাসের সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ করে, দখলদার পাকিস্তানি বাহিনীকে পরাজিত করে এবং আত্মসমর্পণে বাধ্য করে। আছে নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধ শেষে ১৬ ডিসেম্বর, বিজয় দিবসের উৎসব। চলছে এপ্রিল মাস। এই এপ্রিলের ১৪ তারিখেও বাঙালিরা বাংলা নববর্ষ উদ্্যাপনে উৎসবে মেতে ওঠে। এই উৎসবে সব দীনতা, হীনতা, জড়তা, আবর্জনা ঝেড়ে ফেলে, নবোদ্যমে জীবন ও দেশ গড়ার সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ার সংকল্প গ্রহণ করে বাঙালির কণ্ঠে কণ্ঠে গীত হবে রবীন্দ্রনাথের ‘এসো হে বৈশাখৃ’ গান। গীত হবে ‘জীর্ণ পুরাতন যাক ভেসে যাকৃ’।
এবার অবশ্য উৎসবের আয়োজনে অনেক খামতি দেখা যাবে পবিত্র রমজান মাসের জন্য। কেউ কেউ ১৪ এপ্রিলের অনুষ্ঠান ওইদিন আয়োজন করলেও অনেকেই রমজান এবং ঈদ পার করে পহেলা বৈশাখের আয়োজন করার পরিকল্পনাও নিয়েছে। রোজার মধ্যে আবার মাসজুড়ে বিভিন্ন সংগঠন ও দলের চলছে ইফতার পার্টি। ঈদের পরে ঈদ পুনর্মিলনী। শীত বিদায় নিলেই শুরু হয়ে যাবে বাঙালিদের বনভোজন উৎসব। আর আছে বছরজুড়ে রাজনীতির উৎসব। কথায় বলে : ‘বাঙালিরা যেখানে যায়, রাজনীতিকে সঙ্গে নিয়ে যায়।’
মধ্যপ্রাচ্য, ইউরোপ-আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া-এমন কোনো অঞ্চল নেই, যেখানে বাঙালি আছে, কিন্তু রাজনীতি নেই! বাংলাদেশে যে দল আছে, অন্য কোথাও তার শাখা না থাকলেও যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে সেই দলের শাখা দেখা যাবে। এবং রাজনীতি যেমন আছে, তেমনি দল-উপদলও আছে। অন্তঃকলহ, রাজনৈতিক কলহ, হিংসা-প্রতিহিংসা যেমন আছে, তেমনি সম্প্রীতি, সহানুভূতিও আছে। নিউইয়র্ক থেকে প্রায় দেড় ডজন সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশিত হয়। অনলাইনে অসংখ্য। সবকিছুতেই দেশের এবং একই সঙ্গে প্রবাসের রাজনীতির খবর মিলবে।
সবকিছু নিয়েই প্রবাসে এখন আমরা স্বদেশের মতোই আছি। প্রবাসীদের মধ্যে দেশপ্রেমেরও কিছু কমতি নেই। বাঙালিত্ব নিয়ে আর আশি-নব্বই দশকের মতো হাহাকারে ভোগে না কোনো প্রবাসী বাঙালি। তবু দেশ দেশই। দেশ নিয়ে সব প্রবাসীর বুকের মধ্যেই চিনচিন করে।
আপনার মতামত লিখুন :