মিজান রহমান নিউইয়র্ক
আগেই উল্লেখ করেছিলাম, অনেক বাংলাদেশী তাদের অতি আবেগ-প্রবণতা এবং নিজেদের মধ্যে বিভাজনতার ধারাগুলি এদেশেও জীবন যাপনে বয়ে চলেছে।
এদেশে যদিও বাংলাদেশী বাঙালির সংখ্যা অত্যন্ত কম। কিন্তু সংস্কৃতি ও বাংলাদেশের বিভিন্ন জাতীয় দিনগুলো উদযাপনে তারা অত্যান্ত উৎসাহী। এটা অত্যন্ত আশার কথা। বাংলাদেশীদের রয়েছে শতাধিক সংগঠন।
তবে এ ব্যাপারে তারা এদেশে জন্ম নেয়া আমাদের নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের এ বিষয়গুলোতে কতটা আগ্রহ সে বিষয়ে তাদের তেমন মনোযোগ দেয়া প্রয়োজন বোধ করেন না। সুতরাং তারা অনেকটা জোর করে তাদের ছেলেমেয়েদের এইসব অনুষ্ঠানের সাথে সম্পৃক্ত রাখতে চান। এর ফলাফল কি দাঁড়াচ্ছে? কিছু ব্যতিক্রম বাদ দিলে, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ঐ ছেলেমেয়েরা যখনই বেড়ে ওঠে বা সাবালক হয় তখন তারা এসব থেকে দূরে সরে যায়।
ইমিগ্রান্ট বাবা-মা হিসেবে আমাদের এটা বোঝা উচিত যে আমরা যেমন বাংলাদেশে জন্মগ্রহণ করার পর, বাংলাদেশেরই জলবায়ু, আবহাওয়া, সামাজিক রীতিনীতি, ভাষা ও সংস্কৃতি এবং খেলাধূলায় কোনো বাধার মুখোমুখি হতে হয়নি অথবা আমাদের বাবা-মায়েরা জবরদস্তি করে আমাদের ওপর চাপিয়ে দেননি। মনে করে দেখুন তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানীরা যখন ‘উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্র ভাষা’ এই ঘোষণা দেয় তখন কি আমরা তা মেনে নিয়েছিলাম? না, আমরা নিইনি এবং তার প্রতিবাদ করতে গিয়ে সুদীর্ঘ সংগ্রামের মাধ্যমে শেষ অবধি আমরা একটা স্বাধীন দেশ হিসেবে নিজেদেরকে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছি।
আমরা একটি কম্যুনিটি হিসেবে অনেক কিছুই একসঙ্গে করতে পারি না। এমনকি বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবস উদযাপনের জন্য বা একুশে উদযাপনের জন্য, এমনকি বিজয় দিবস উদযাপনের জন্য এদেশের একই শহরে কয়েক ডজন করে অনুষ্ঠান হয়।
এদেশে জন্ম নেয়া আমাদের ছেলেমেয়েদের অধিকাংশেরই বাঙালি ও আমেরিকান সংস্কৃতির গ্রহণ-বর্জনে দোলাচলে অত্যন্ত চাপের মধ্যে শৈশব অতিবাহিত করতে হয়। তাদের মানসিকতা অনেক ক্ষেত্রে আমরা বুঝতে চেষ্টা করি না। অথচ আমরা ভুলে যাই এদেশে আমাদের আসার ব্যাপারে বা আমাদের সিদ্ধান্ত নেয়ার ব্যাপারে এদেশে জন্মগ্রহণ করা আমাদের ছেলেমেয়েদের কোনই ভূমিকা ছিল না। কেননা আমরা নিজেরাই আমাদের সমৃদ্ধ জীবন যাপনের লক্ষ্যে এদেশে আসার সিদ্ধান্ত নিয়েছি এবং তা করেছি তাদের জন্মের আগে।
বাংলাদেশে আমরা যেমন, হাডুডু বা ফুটবল (সকাল বল) বা ক্রিকেট খেলার জন্য আগ্রহী হতাম, খেলতে বা খেলা দেখে তা উপভোগ করতাম, এদেশের ছেলেমেয়েরাও তাদের বেড়ে ওঠার ক্ষেত্রে এদেশের জনপ্রিয় খেলাধূলো নিয়ে আগ্রহী হবে সেটাই স্বাভাবিক। যেমন আমেরিকান ফুটবল, বাস্কেটবল, বেসবল, হকি, টেনিস, গলফ ইত্যাদি।
সাপ্তাহিক ছুটির দিনগুলোতে আমেরিকান বাবা-মায়েরা যখন তাদের ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের নিয়ে বিভিন্ন স্পোর্টস কমপ্লেক্সে যায়, খেলার মাঠে যায়, সমুদ্রে যায়, তখন আমাদের বাংলাদেশী-আমেরিকান বাবা-মায়েরা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তাদের ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের জোর করে বা ধমকে-ধামকে বিভিন্ন কম্যুনিটি পিকনিক বা কোন গানের আসরে বা কারো বাড়িতে তারা নিজেদের মধ্যে গল্প-গুজব করতে নিয়ে যায়। তারা তাদের ছেলেমেয়েদের পছন্দ-অপছন্দের ধার ধারে না বা তার কোন প্রয়োজনীয়তা আছে বলে মনে করে না। এই জাতীয় অনেক সমাবেশে, পিকনিকে বা দাওয়াতের জায়গায় ঐ ছোট ছেলেমেয়েদের জন্য উপযোগী খাবার-দাবারেও তেমন কোন ব্যবস্থা থাকে না। এটা যে ইমিগ্রান্ট বাবা-মায়েদের তাদের ছেলেমেয়েদের প্রতি অযত্ন ও অসম্মান তাও তারা বুঝতে পারেন না।
আবার ছেলেদের তুলনায় মেয়েদের অবস্থা আরো ভয়াবহ। ছেলেরা তাদের বাবা-মায়েদের শাসনের সবকিছুর প্রতি ততটা ভ্রƒক্ষেপ না করে হয়তো কিছু কিছু কাজ তাদের পছন্দের মত করতে পারে বা তাদের অস্বীকৃতি জানাতে পারে। বিশেষত তরুণ বা সদ্য যুবক ছেলেরা। কিন্তু মেয়েদের ব্যাপারে তা ঘটার সম্ভাবনা অনেক কম। কেননা অনেক বাংলাদেশী ইমিগ্রান্ট বাবা-মা সাধারণত তাদের মেয়েদের অনেক বেশী কড়া শাসনে বা নজরদারিতে রাখতে চান। এমনকি অনেক ক্ষেত্রে তাদেরকে তাদের পছন্দের কোন পোশাক-আশাকও পরার অনুমতি দেননা। আমাদের মেয়েদের তাদের ছোটবেলা থেকেই এদেশে তাদের চলাফেরার ক্ষেত্রে অনেক নিষেধাজ্ঞা থাকে। এই নিষেধাজ্ঞা তাদের স্বাধীনভাবে বিকাশের ক্ষেত্রে কি ইতিবাচক?
এদেশে নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের ওপর বর্তানো এইসব নিষেধাজ্ঞার সুদূর প্রসারী ফলাফল কি দাঁড়াতে পারে তার ওপরও কিছুটা আলোকপাত করার ইচ্ছা রইলো।
সূত্র: সাপ্তাহিক বাঙালী, নিউইয়র্ক, অক্টোবর ৮, ২০২২
আপনার মতামত লিখুন :