ক্লিভল্যান্ডে বিশেষজ্ঞ বাংলাদেশীদের মিলনস্থল


ওহাইও সংবাদ প্রকাশের সময় : এপ্রিল ৯, ২০২৩, ১০:৪৮ অপরাহ্ণ /
ক্লিভল্যান্ডে বিশেষজ্ঞ বাংলাদেশীদের মিলনস্থল

শফিউল ভূইয়াঁ
উত্তর আমেরিকায় আসার আগে বহু মানুষের কাছে শুনেছি যে, আমেরিকা কানাডায় বাংলাদেশিরা শুধু ট্যাক্সি চালায় অথবা ফ্যাক্টরিতে শ্রমিকের কাজ করে অথবা ফার্স্ট ফুডের দোকানে কাজ করে। ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার কোনো ব্যাপার না; সবারই একই দশা। আমি যখন বাংলাদেশের একটি সরকারী প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতার চাকরী ছেড়ে কানাডায় পাড়ি জমাচ্ছিলাম, তখন আমার আশেপাশের শুভাকাঙ্খীরা স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে আমাকে পরামর্শবানে জর্জরিত করে একেবারে কাবু করে ফেলে।

আমিও মনে মনে এতটাই ভয় পেতে শুরু করেছিলাম যে, আমার মনের কোনে কানাডায় যাওয়ার চিন্তা বাদ দেয়ার পরিকল্পনা আসতে থাকে। যাই হোক বৌয়ের পীড়াপীড়িতে, আমাদের আনোয়ারুল আজিম (আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন ভাইস চ্যান্সেলর) স্যারের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে এক সমুদ্র অনিশ্চয়তার বোঝা মাথায় নিয়ে কানাডার উদ্দেশ্যে পাড়ি জমাই। এসেই আমাদের এক বুয়েটের বড় ভাইয়ের সাথে দেখা। উনি গদ গদ করে কয়েক বস্তা উপদেশের ঝুলি নিয়ে আমার সামনে হাজির। উনি বলতে লাগলেন, “কানাডা আমেরিকায় উচ্চশিক্ষা করে কোনো লাভ নেই, উচ্চশিক্ষা করলেও শ্রমিকের কাজ করতে হয়। অতএব এদিক ওদিক ভেবে সময় নষ্ট না করে এখনই ফ্যাক্টরির কাজে লেগে যাও। বড় ভাই হিসেবে আমিই তোমার কাজের ব্যবস্থা করে দিচ্ছি” ইত্যাদি ইত্যাদি। বুয়েটের একজন বড় ভাইয়ের কাছে এ রকম কথা শুনে আমার কান্না পাবার অবস্থা। কোন রকম নিজেকে সামলে নিয়ে আবারো নিজের পরিকল্পনায় অবিচল থেকে মাস্টার্স করা শুরু করলাম। দেখলাম যে না, বুয়েটের সেই শুভাকাঙ্খী বড়ভাইয়ের কথা ১০০% মিথ্যা প্রমান করে মাস্টার্স শেষে সাথে সাথেই চাকরী পাওয়া গেলো। তারপর থেকে আর পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি।

চাকরীর সুবাদে ২০১৩ সালে আমেরিকার ওহাইও রাষ্ট্রের ক্লিভল্যান্ডে পাড়ি জমালাম। সেই থেকে ক্লিভল্যান্ডেই আছি। ক্লিভল্যান্ডে এসে প্রথম যেই কমিউনিটি প্রোগ্রামে অংশ নেই, সেখানেই আমার আহসানুল্লাহ হলের এক বড় ভাইয়ের সাথে দেখা। প্রথম দেখাতেই আমরা দুজন দুজনকে চিনতে পারি। আমরা দুজন একই ফ্লোরে থাকতাম এবং সেই ফ্লোরেই আমাদের হলে মসজিদ ছিল। নামাজের সুবাদে দিনে কয়েকবার উনার সাথে দেখা হত। উনি আমাকে বেশ কয়েকজন বুয়েটিয়ান সহ অনেকের সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন। সেই থেকে আমি ক্লিভল্যান্ডের বাংলাদেশী কমুনিটির সাথে একেবারে মিশে গিয়েছি। এখানে আমাদের বাংলাদেশিদের মধ্যে করোনা বিশেষজ্ঞ, পেডিয়াট্রিক সার্জন, মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ, শিশু বিশেষজ্ঞ মেডিসিন বিশেষজ্ঞ, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, তড়িৎ, যন্ত্র, পুর কৌশলী, মেটেরিয়াল সাইন্স বিশেষজ্ঞ সহ কি নেই এখানে। এখানে বাংলাদেশিদের মধ্যে নাসার গবেষক যারা কিনা মঙ্গল গ্রহ নিয়ে গবেষণা করেন, তারাও রয়েছেন। মোটকথা সমস্ত বাংলাদেশী বিশেষজ্ঞ পর্যায়ের ভাইবোনদের সহঅবস্থান এই ক্লিভল্যান্ড বাংলাদেশী কমিউনিটি।

এখানে রয়েছে খুবই উঁচু মানের কবি, সাহিত্যিক, গল্পকার, সংগীতশিল্পী সহ অনেক মিউজিক বিশেষজ্ঞ। সহজ কথায় বলতে গেলে সব রকম বিশেষজ্ঞ পর্যায়ের মানুষজন আমাদের ক্লিভল্যান্ড বাংলাদেশী কমুনিটির অন্তর্ভুক্ত। এখানে রয়েছে আমাদের একটি অলাভজনক প্রতিষ্ঠান, বাংলাদেশ এসোসিয়েশন অফ নর্থ ইস্ট ওহাইও (BANEO)। সকলের সহযোগিতায় এই প্রতিষ্ঠানটি আয়োজন করে বাহারী রকমের সব অনুষ্ঠান, যেমন একুশে ফেব্রুয়ারী, স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস পহেলা বৈশাখ, ঈদ পুনর্মিলনী, পিঠা উৎসব, বর্ষ বিদায়/বর্ষবরণ ইত্যাদি ইত্যাদি।

এই BANEO এর সুবাদে মন থেকে আমরা একে অপরের খুব কাছাকাছি অবস্থান করি। বছরে চার পাঁচবার কমিউনিটি প্রোগ্রাম উপলক্ষে সবার সাথে দেখা সাক্ষাৎ আমাদেরকে একটা অন্যতম আন্তরিকতাপূর্ণ জনগুষ্ঠিতে রুপান্তরিত করেছে। ক্লিভল্যান্ডের আশেপাশে মুটামুটি ১০০ কিলোমিটারের মধ্যে যত বাংলাদেশী থাকেন তারা সবাই আমাদের কমিউনিটির সদস্য। আমরা একসাথে হাসি, একসাথে কাঁদি, একসাথে গান গাই। এ যেন সমগ্র উত্তর আমেরিকার মধ্যে একটুকরো বিশেষজ্ঞ বাংলাদেশীদের মিলনস্থল।