ফেরা – রাশিদা কামাল


ওহাইও সংবাদ প্রকাশের সময় : এপ্রিল ৯, ২০২৩, ১০:০১ অপরাহ্ণ /
ফেরা – রাশিদা কামাল

ঢাকা থেকে ফিরেছি কয়েক দিন হলো। এখনও মন খারাপের বলয় থেকে বের হতে পারি নি। বিষণ্ণতা লেপটে আছে আমার অস্তিত্ব জুড়ে। এ পরিস্থিতি কাটিয়ে উঠতে চেষ্টা করেও কাটাতে পারছি না। সবার কথা ভীষণভাবে মনে পড়ছে। তাছাড়া ভৌগলিক কারণে ঘুমের সমস্যা তো হচ্ছেই। যখন তখন ঘুমিয়ে পড়ছি। আবার যখন তখন জেগেও উঠছি! শরীর কোন নিয়মের ধার ধারছে না! রথী রূপম দুজনেই বলছে দিনে একটু কষ্ট করে জেগে থাক তাহলে নিয়মটা ফিরে আসবে। কথাটা আমিও জানি! তবুও ঘুমটাকেই প্রশ্রয় দিচ্ছি। প্রশ্রয় দিতে কেন যেন ভালো লাগছে! দিন রাতের হিসেব না করে ঘুম পেলেই ঘুমিয়ে পড়ছি! আমার প্রাত্যহিক জীবনের রুটিনটা তাই এখনও এলোমেলো!
আমি এলোমেলো জীবনে অভ্যস্ত নই! গুছিয়ে চলা আমার স্বভাব! অথচ এই আমিই আমাকে কেন প্রশ্রয় দিচ্ছি তা ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না! আমার হাতে অনেক কাজ! কাজ ফেলে রাখাটা আমার স্বভাববিরুদ্ধ তা আগেই বলেছি!
কিছু লেখা কয়েক জাগায় পাঠাতে হবে! ঘুম ভাঙলেই মনে হয় লেখাগুলি নিয়ে এখনও বসি নি! লন্ডন থেকে ‘কৃষ্ণচূড়া’ পত্রিকার সম্পাদক প্রসূন তাড়া দিচ্ছে লেখা পাঠানোর জন্য! পাঠাব পাঠাব করেও পাঠাচ্ছি না! ঘুমের সাথে আমার ভালোলাগা আর ভালোবাসার কেমিস্ট্রিটা এমনভাবে জমে উঠেছে যে অন্য কথা ভাবার সময়ই পাচ্ছি না! কিন্তু ভাবতে তো হবেই! নিদ্রা-জাগরণের এই দোলায়মান পরিস্থিতিতে লিটন কবীরকে ফোন দিলাম। লিটন কবীর ‘ওহাইও সংবাদ’ এর সম্পাদক। লেখা পাঠানোর কথা জানতে চাইলাম। লিটন একটা গল্প পাঠাতে বলল। আমি বললাম শরীরের এ অবস্থায় গল্প লিখতে পারব না। অন্যকিছু পাঠাই! লিটন আপত্তি করলো না। লিটনের এটা একটা মস্তবড় গুণ! মানুষকে বুঝতে পারা! ওর সাথে কথা বলে মনটা ভালো হয়ে গেলো। শুধু এবার না, যখনই প্রয়োজনে বা অপ্রয়োজনে কথা বলি তখনই মনটা ভালো হয়ে যায়! খুব মন দিয়ে কথা শুনে তারপর সমাধান দেয়।
লিটনকে কথা দিলাম অন্যকিছু লিখব। কিন্তু কী লিখব তা মাথায় আসছে না! ঘুরে ফিরে কেবল ঢাকার কথাই মনে পড়ছে। দেশ থেকে ঘুরে এলে আমায় স্মৃতিকাতরতায় পেয়ে বসে। আর তা কাটিয়ে উঠতে অনেকটা সময় লাগে। তাছাড়া কিছু স্মৃতি আমি কাটিয়ে উঠতে চাইও না! ধরা থাক এসব স্মৃতি —- আমার হৃদপিণ্ডের মধ্যে বাজুক কিছু চেনা সুর! আমাকে ছুঁয়ে থাকুক স্মৃতিরা আমৃত্যু।
এবার ঢাকা যাবার একটা অন্যতম কারণ ছিলো বইয়ের মোড়ক উন্মোচন। এ কাজে খুব ব্যস্ত ছিলাম। প্রথমে ব্যস্ত ছিলাম প্রেসের দিলিপ আর সাঈদ ভাইয়ের সাথে। এরপর ব্যস্ত হলাম ‘চিত্রক গ্যালারি’ এর পপি আর মনিরুজ্জামানের সাথে। তবে এ কথা নির্দ্বিধায় স্বীকার করতে হয় যে ওদের দুজনের কাছ থেকে আমি অভাবনীয় সহযোগিতা পেয়েছি। খুব আন্তরিকতা আর যত্নের সাথে ওরা গ্যালারির কাজগুলো করে ফেলল। আমাকে কিছুই ভাবতে হয় নি। শুধু ওরা দুজন কেন ওদের সাথে ছিলো ওদের ছেলে অপার জামানও। মনিরুজ্জামান ‘চিত্রক গ্যালারির
এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর, পপি ওখানের কিউরেটর। আর অপার লন্ডনের ‘রয়্যাল কলেজ অফ আর্ট’ থেকে ভাস্কর্যে MFA ডিগ্রি শেষ করে বর্তমানে বাংলাদেশে আছে। বাবামার সাথে একই গ্যালারিতে কাজ করছে। অনুষ্ঠানের দিন আমার সাথেই ছিলে অনেকক্ষণ। ওকে পেয়ে আমার আনন্দ হচ্ছিল। গ্যালারিতে উপস্থিত হবার পর দেখলাম অনেকেই এসেছেন।
খুব ভালো লাগলো এ কথা ভেবে যে আমারই জন্য সবাই কাজ ফেলে যানজট পেরিয়ে এখানে উপস্থিত হয়েছেন। উদয়ন স্কুলের প্রাক্তন ভাইস প্রিন্সিপ্যাল রাশিদা মামুন অনেক অসুস্থতা সত্ত্বেও এখানে ছুটে এসেছেন। এসেছেন জহুরা বেগম (বর্তমান প্রিন্সিপ্যাল), কিরণ বৈরাগী, আইভি জামান, সালমা পারভীন, মেহজাবিন আলম চৌধুরী, রাজিয়া আবেদীন। অনেকদিন পর দেখলাম আমার আদরের ছাত্র ধীমান আর অলককে। ধীমান জাহাঙ্গীরনগর ইউনিভার্সিটির শিক্ষক। কত্ত ছোট দেখেছি ওদের। ওরা এখন বড় হয়ে শিক্ষকতা করছে। এ ছাড়াও আত্মীয়-স্বজন, বন্ধুবান্ধব দিয়ে ভরা ছিলো গ্যালারি। এদের ভালোবাসার ছোঁয়ায় আমি আপ্লুত হয়ে পড়েছিলাম। এদের ভুলে থাকি কী করে!
রবীন্দ্রনাথের কথায় বলতে ইচ্ছে করে,
ভরা থাক স্মৃতিসুধায় বিদায়ের পাত্রখানি।
এখানে অবশ্য বিদায়ের পাত্রখানি না বলে মিলনের পাত্রখানি বলাই শ্রেয়।
এখানে চলে আসার দিন আবার ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। মন খারাপের কথা কাউকে বুঝতে দিলাম না। ইমিগ্রেশন পার হয়ে লাইনে দাঁড়িয়ে আছি। এ সময় একটা মেয়ে আমার কাছে জানতে চাইলো আমি কোথায় যাচ্ছি। বললাম, শিকাগো।
মেয়েটা হাসিমুখে বলল,
Wow ! আমিও ওখানে যাচ্ছি।
খুশি আমিও হলাম। কারণ দূরের পথে সহযাত্রী সাধারণত পাওয়া যায় না। মেয়েটা আমার বোর্ডিংপাস দেখলো। একটু দূরে হলেও একই লাইনে আমাদের সীট। আমরা ওয়েটিং লাউঞ্জে বসলাম। মেয়েটির সাথে ওর বড়বোনও আছে। আমরা তিনজন জমিয়ে গল্প করছি। আমি আমার প্লেন ফোবিয়া কাটাতে চাইছি। আমাদের পেছনে আরও একটা মেয়েকে দেখলাম মুঠোফোনে ব্যস্ত। এক ফাঁকে মেয়েটা উঠে এলো আমাদের পাশে। ও বলল ও শিকাগোতেই যাচ্ছে। ওখান থেকে ওহাইও। আমি বেশ উত্তেজিত হয়ে পড়লাম। বললাম, আমিও ওহাইও যাব।
হুইলচেয়ারকে অবলম্বন করে আমার আসা-যাওয়া। প্লেন ল্যান্ড করার আগেই হোস্টসদের মনে করিয়ে দেই হুইলচেয়ারের কথা। উত্তেজনায় এ কথাটাও তখন ভুলে গেলাম।
মেয়েটি বলল, কোথায় থাকেন আপনি ?
বললাম, হিলিয়ার্ডে।
ও আবার বলল, ওখানে আমার পরিচিত একজন থাকে। আমরা একই মেডিকেল থেকে পাশ করেছি।
আমি কৌতূহলী হয়ে বললাম,
কী নাম ?
তানীম ভাই আর ববি আপু। আমি অবশ্য ওদের জুনিয়র। আমার সাথে ববি আপুর কথা হয়।
আমি শুধু হাসলাম। মেয়েটি বলল, আপনি কি তানীম ভাইয়ের আম্মা ?
আমি মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ বললাম।
ওরা দুবোন একসাথে বলে উঠলো, পৃথিবীটা আসলেই ছোট।
প্লেনে উঠে দেখলাম ডাক্তার মেয়েটা আমার কাছাকাছিই বসেছে। ওর নাম তনিমা। কিছুক্ষণ পর পর মেয়েটা আমার কাছে এসে আমার খবর নিচ্ছে। এত ভালো লাগলো ব্যাপারটা যা প্রকাশ করার ভাষা আমার নেই। তনিমার সাথে আমার আর দেখা হবে কিনা জানি না! তবে ভালোবাসার এই বিনিসুতোর মালাটা ছিঁড়বে না কখনও। আমিই ছিঁড়তে দেব না!
আমি যেহেতু হুইলচেয়ার নেই তাই তনিমার সাথে আমার আর দেখা হয় নি। দোহা থেকে শিকাগো লম্বা জার্নি। পরিচিত কাউকে দেখতে পেলাম না। একাকীত্বে পেয়ে বসলো আমাকে। হঠাৎ দেখি একজন বাঙালি মেয়ের হুইল চেয়ার আমার পাশে থামলো। মেয়েটার বয়স বেশি না। হুইলচেয়ারে বসার কথা না। কিছুক্ষণ পর লক্ষ করলাম ওর পায়ে ব্যথা। খুব কষ্ট পাচ্ছে ও। দোহায় আমরা পাশাপাশি বসে গল্প করতে লাগলাম। ওর মা খুব অসুস্থ। কেমো চলছে। ও মাকে দেখতে এসেছিলো। চলে যাচ্ছে তবে মন খুব খারাপ।
কথা বলতে বলতে আমরা এতটাই কাছে চলে এলাম যে ওকে আমার ছোটবোন মনে হচ্ছিল। আমার ইচ্ছে হচ্ছিলো কোন যাদুর ছোঁয়ায় ওকে আর ওর অসুস্থ মাকে সুস্থ করে তুলি! পরের দিন শিকাগো এয়ারপোর্টে ওর সাথে আবার দেখা। অদ্ভুত শিহরণ অনুভব করলাম আমি! মনটা দুলে উঠলো মুহূর্তে। আমার শুকনো ভাবটা উড়ে গেলো শুধু ওকে দেখে! মনের ভেতরে বয়ে যাওয়া মরা নদীটায় পানির তোড় অনুভব করলাম।
কেন করলাম জানি না! জীবনের অনেক কিছুই জানা হয় না! এ ঘটনাটাকেও এভাবেই নিলাম। কোথা থেকে এত আবেগ এসে আমাকে ছুঁয়ে থাকলো তা আমি জানতে চাইলাম না! শুধু চাইলাম আবেগটা আমাকে ঘিরেই থাকুক। ওর নামটা বলা হয় নি। ওর নাম শামিমা। এখানে এসে আমরা বিচ্ছিন্ন হলাম। কারণ শামিমা যাবে কানাডা। না, মন থেকে বিদায় দিলাম না! মনের মধ্যে হাজার পাখির ভিড়। ওরা গান গাইছে শুধু ওরই কারণে! ওকে বিদায় দেবার সাধ্যি কই আমার!
বাসায় এসে পরের দিন ওকে ফোন দিলাম। মার জন্য মন খারাপ। খুবই স্বাভাবিক! তবুও তো এর মাঝেই বেঁচে থাকতে হয়! ওর জন্য অদ্ভুত কষ্ট অনুভব করলাম। ওর মা ভালো থাকুক, সুস্থ থাকুক কথা বলতে ইচ্ছে হলো। ইচ্ছরাও তো ভালেলাগার অংশ! বললাম ভালো হয়ে যাবেন তোমার মা! ওর সাথে কথা বলতে গিয়ে আবারও অনুভব করলাম বুকের ভেতর হাজার পাখির ভিড়। ওরা গান গাইছে মধুর সুরে! এই সুরটা ছুঁয়ে থাকুক আমাকে সারা জীবন।