গবেষক ও বিজ্ঞানী ডক্টর এনাম আহমেদ চৌধুরী


ওহাইও সংবাদ প্রকাশের সময় : মার্চ ১৪, ২০২৩, ১২:০০ পূর্বাহ্ণ /
গবেষক ও বিজ্ঞানী ডক্টর এনাম আহমেদ চৌধুরী

গ্রন্হনা ও উপস্থাপনা : সারওয়ার খান

জ্ঞানের গবেষনা ও প্রমানের ভিত্তিতে তার পদ্ধতিগত উপস্থাপনা হলো বিজ্ঞান। সভ্যতার অগ্রগতিতে বিজ্ঞানীদের গবেষনা লব্ধ জ্ঞানের বাস্তব প্রয়োগে মানব জীবন হয়েছে সাচ্ছন্দ্যময়, গতিশীল ও সুন্দর।
বিজ্ঞানের গবেষনায় যেমন প্রয়োজন একাগ্রতা, নিষ্ঠা, তেমনি জানার আগ্রহ ও অদম্য ইচ্ছা একজন ব্যাক্তিকে সফল বিজ্ঞানী হতে সহায়তা করে।

ওহাইও ষ্টেট ইউনিভার্সিটি এর সহকারী অধ্যাপক ডক্টর এনাম আহমেদ চৌধুরী একজন নিষ্ঠাবান সফল গবেষক। তার কাজ মূলত লেজার নিয়ে। LASER – Light Amplification by Stimulated Emission of Radiation. একটু সহজ করে বলতে গেলে, লেজার এমন একটি ডিভাইস যার দ্বারা অনুস্হ ইলেকট্রন উদ্দিপীত হয়ে শক্তি সনঞ্চয় করে নির্দিষ্ট তরঙ্গ দৈর্ঘের তীব্র সংকুচিত আলো বিচ্ছুরিত করে, সাধারন ভাবে ঐ প্রক্রিয়ায় আলোক রশ্মির বিকিরনকেই লেজার বলা হয়।

অধ্যাপক ডক্টর এনাম আহমেদ চৌধুরী ওহাইও ষ্টেট ইউনিভার্সিটির ম্যাটারিয়াল সাইন্স বিভাগের সহকারী অধ্যাপক। একই সাথে তিনি ঐ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইলেকট্রিক্যাল ও কম্পিউটার ইন্জিনিয়ারিং এবং পদার্থ বিদ্যা বিভাগেরও সহকারী অধ্যাপক।

ডক্টর এনাম আহমেদ চৌধুরীর পরিচালনায় বিজ্ঞানীরা তীব্র ও অতিতীব্র লেজার এর প্রক্ষেপনে পদার্থের অবস্হার কি পরিবর্তন (Interaction) হয় তা পর্যবেক্ষন করেন। এই Interaction প্রক্রিয়ার সময় লেজারের তীব্রতা পৃথিবী পৃষ্ঠে সূর্যের আলোর তীব্রতার দশ হাজার কোটি কোটি গুন বেশী তীব্রতা সম্পন্ন অবস্হার সৃষ্টি করা হয়। এই Interaction প্রক্রিয়ায় পদার্থের দ্রুত রুপান্তর ঘটে এবং এই পর্যবেক্ষণ প্রক্রিয়ার জ্ঞান মৌলিক বিজ্ঞান ও ভবিষ্যৎ শিল্প গবেষনার বিভিন্ন বাস্তব প্রয়োগে যেমন ক্যানসার থেরাপি, প্ল্যানেটারি সাইন্স, এষ্ট্রোফিজিক্স ইত্যাদির গবেষনায় সহায়ক হবে।

ডক্টর এনাম চৌধুরীর তত্বাবধানে ঐ গবেষনায় সাইন্টিস্ট, ইন্জিনিয়ার ও গ্রাজুয়েট স্টুডেন্টদের সমন্বয়ে গঠিত গ্রুপ ওহাইও ষ্টেট ইউনিভার্সিটির পদার্থ বিদ্যা গবেষনাগারে SCARLET লেজার সিস্টেম তৈরি করেছেন, যা বর্তমান বিশ্বে সবচেয়ে তীব্র লেজার গুলীর অন্যতম। এই প্রক্রিয়ায় সুপার কম্পিউটার ব্যবহার করে বৃহত্তর পরিসরে ডাটা এনালাইসিস এর কাজ করা হচ্ছে যার অর্থায়নে আছে US Department of Energy.

এনাম আহমেদ চৌধুরী তার তিন বছর বয়সেই জন্মস্হান বাংলাদেশ এর ফেনী জেলা (তৎকালীন বৃহত্তর নোয়াখালী) থেকে পরিবারের সাথে ঢাকা চলে আসেন। স্কুল শিক্ষিকা মা ও চার্টার্ড একাউন্টেন্ট পিতার তত্তাবধানে পারিবারিক পরিবেশে তার বেড়ে উঠা। ঢাকার গভঃ ল্যাবরেটরি স্কুল থেকে ১৯৯৮ সালে এসএসসি এবং ঢাকা কলেজ থেকে ১৯৯১ সালে এইচএসসি পাশ করেন।

ছোট বেলা থেকেই বিজ্ঞানী হবার স্বপ্ন লালন করতেন। আশি‘র দশকে বাবা মায়ের সাথে আমেরিকা বেড়াতে এসে সে স্বপ্ন বাস্তবায়নের একটা আলোর দিশা পেলেন। এইচএসসি পূর্ববর্তী সময়ে নিজে থেকেই ইংরেজির চর্চা করতে থাকেন। ঢাকাস্হ আমেরিকান কালচারাল সেন্টার, ব্রিটিশ কাউন্সিল ইত্যাদির মাধ্যমে খোজ খবর নিয়ে আমেরিকার বিভিন্ন ইউনিভার্সিটিতে ভর্তির প্রক্রিয়া শুরু করেন। এইচএসসি’র ফল বের হবার আগেই আমেরিকার কয়েকটি ইউনিভার্সিটি থেকে ভর্তির অফার আসে। ১৯৯১ এর শেষের দিকে ইন্ডিয়ানা অঙ্গ রাজ্যের Wabash কলেজে ভর্তি হয়ে ছাত্র হিসাবে আমেরিকা আসেন।

সে সময় দেশে বাবা মা এর সাথে যোগাযোগ করার মাধ্যম ছিল চিঠি বা টেলিফোন। এখনো মনে আছে, সে সময় ফোন করতে প্রতি মিনিট দুই ডলার খরচ হতো। ডর্মে থেকে নিজে গ্রোসারী বাজার করে বরফের রাজ্যে জীবন যুদ্ধের পাশাপাশি চলতে থাকল পড়ালেখাও। ভিন্ন দেশের ছাত্র ছাত্রী সীমিত সংখ্যক থাকায় ছাত্র শিক্ষকের যোগাযোগ বেশ ভালই ছিল।

পদার্থ বিজ্ঞান এ ব্যাচেলর ডিগ্রী নিয়ে এমএস প্রোগ্রামে ভর্তি হলেন দেলেওয়ার (Delaware) ইউনিভার্সিটিতে। ইলেক্ট্রিক্যাল এন্ড কম্পিউটার ইন্জিনিয়ারিং এ এমএস শেষ করা হলেও পদার্থ বিজ্ঞানেও চর্চা চালু ছিল। পরবর্তীতে আবারও পদার্থ বিজ্ঞান এ পিএইচডি ডিগ্রী শেষ হলো একই ইউনিভার্সিটি থেকে ২০০৪ সালে।
পিএইচডি প্রোগ্রামে অধ্যায়ন কালেই বাংলাদেশে যেয়ে পূর্ব পরিচিত মাহজাবীন হারুন শামা এর সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হলেন। সে সময়টা ছিল ১৯৯৯ সাল।

পিএইচডি অধ্যায়ন কালে বিষয় ছিল “Laser Atomic Moliculer Physics” যা পরবর্তী কালে ২০১২ সালে SCARLET Laser System তৈরীতে ও লেজার নিয়ে আরও ব্যাপক গবেষনায় সহায়ক হয়েছিল। লেজার এর বাস্তব প্রয়োগ বিশেষ করে চিকিৎসা বিজ্ঞানে যেমন লেইসিক সার্জারি, ক্যানসার চিকিৎসায় প্রটোন থেরাপি অন্যতম। লেজার গবেষনায় ইউরোপীয় বিভিন্ন দেশ, কোরিয়া, জাপান ও চায়নাতেও উল্লেখযোগ্য যথেষ্ট অগ্রগতি সাধিত হয়েছে।
E L I (Extreme Light Infrastructure) প্রজেক্টের তিনটি ল্যাব যথাক্রমে চেক রিপাবলিক, হাঙ্গেরি ও রুমানিয়া তে স্হাপিত হয়েছে। তন্মধ্যে চেক রিপাবলিক ও হাঙ্গেরি এর রিসার্চ ল্যাব এর সাথেও ডক্টর চৌধুরীর টিমের যৌথ গবেষনা পরিচালিত হয়।

বাবা ও মা গত হয়েছেন বেশ আগেই। তিন ভাই এর মাঝে ডক্টর চৌধুরী সবার বড়। অন্য দুই ভাইও নিজ নিজ কর্মক্ষেত্রে সুপ্রতিষ্ঠিত। মেঝো ভাই ইংল্যান্ডে সিনিয়র ইকোনমিস্ট হিসাবে কর্মরত। ছোট ভাই টরেন্টো চিল্ড্রেন হসপিটালে সাইনটিস্ট এর কাজে নিয়োজিত।
ডক্টর এনাম ও শ্যামা দম্পতির দুই মেয়ে। বড় মেয়ে রাইয়ান চৌধুরী ওহাইও ষ্টেট ইউনিভার্সিটি থেকে পাশ করে ইন্ডিয়ানাতে পরিবেশ প্রকৌশলী হিসাবে কর্মরত। আর ছোট মেয়ে নুসরাহ চৌধুরী রচেষ্টার ইন্সটিটিউট অব টেকনোলজি এর তৃতীয় বর্ষে এনিমেশন নিয়ে পড়াশোনা করছে। ভবিষ্যতে মুভি মেকার হবার ইচ্ছা আছে নুসরাহ’র।

ডক্টর চৌধুরী গবেষনা ও কাজ নিয়ে অত্যন্ত ব্যাস্ত সময় কাটান। তার সহধর্মিনী মিসেস শামা প্রায় একাই পরিবার সামলিয়ে রাখেন। সন্তানদের দৈনন্দিন কার্যকলাপ দেখভাল করে পরিবার সামলিয়েও মিসেস শামা তার কর্মজীবন এর পেশাগত দক্ষতায় নিজেকে সফ্টওয়্যার ডেভেলপার ইঞ্জিনিয়ার হিসাবে গড়ে তুলেছেন। বর্তমানে তিনি Pearson এ কর্মরত আছেন।

ডক্টর এনাম চৌধুরী তার অধ্যাবসায়, কঠোর পরিশ্রম, জ্ঞান আহরন ও গবেষনার প্রয়োজনে তার চর্চার যে অভ্যাস গড়ে তুলেছেন, তার জন্য তিনি তার প্রয়াত স্কুল শিক্ষিকা মা এবং তার গভঃ ল্যাবরেটরি স্কুলের শিক্ষকদের কাছে চির ঋনি ও কৃতজ্ঞ হয়ে আছেন।

ডক্টর এনাম আহমেদ চৌধুরী ২০০৪ সাল থেকে ওহাইও ষ্টেট ইউনিভার্সিটির গবেষনা ও শিক্ষকতার কাজে নিয়োজিত আছেন। প্রায় দুইশতাধিক গবেষনা পত্রের লেখক ডক্টর চৌধুরী বাংলাদেশ এর শিক্ষক গবেষকদের সাথে যৌথভাবে কাজ করারও ইচ্ছা রাখেন। বাংলাদেশী ছাত্র ছাত্রী যারা উচ্চতর শিক্ষা ও গবেষনার জন্য আমেরিকায় আসতে চান, তারা দেশে থেকেই কিছু গবেষনা পত্র প্রকাশ করে, বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরামে গবেষনা পত্র উপস্হাপন করে নিজেদেরকে উচ্চতর শিক্ষা গ্রহনে প্রস্হুত করতে পারেন। তাতে সহজেই ভাল যে কোন শিক্ষা বা গবেষনা প্রতিষ্ঠানে উচ্চতর শিক্ষায় ভর্তির সুযোগ পাবেন। প্রয়োজনে ডক্টর চৌধুরী ব্যাক্তিগত ভাবেও সহায়তার করতে পারবেন। সেক্ষত্রে ইমেইল এর মাধ্যমে তার সাথে যোগাযোগ এর পরামর্শ দিয়েছেন। echowdhury.laserjck@gmail.com