আমেরিকায় আমাদের নতুন প্রজন্ম – ধারাবাহিক-১০৮


ওহাইও সংবাদ প্রকাশের সময় : মার্চ ১৩, ২০২৩, ১১:৪৭ অপরাহ্ণ /
আমেরিকায় আমাদের নতুন প্রজন্ম – ধারাবাহিক-১০৮

মিজান রহমান, নিউইয়র্ক
আগের সংখ্যায় উল্লেখ করেছিলাম যে প্রবাসী জীবনে এদেশে আমাদের অনেক ইতিবাচক দিক বা অর্জন থাকা সত্ত্বেও আমরা অনেকেই বিভিন্ন অনুৎপাদনশীল বা অফলপ্রসূ বেশ কিছু কর্মকান্ডে নিজেদের অতিমাত্রায় নিয়োজিত রাখি। কিভাবে আমরা আমাদের অনেক মূল্যবান সময়, অর্থ, জ্ঞান এবং মেধার অপচয় করি, অথবা কমিউনিটি হিসেবে নিজেদের অগ্রগতির পথে নিজেরাই অনেকটা বাধা হয়ে দাঁড়াই।

বাংলাদেশীরা জাতিগতভাবে তাদের অতি আবেগ-প্রবণতা, নিজেদের মধ্যে বিভাজনতা এবং স্বদেশের রাজনৈতিক-অভিমতের যে ধারা নিজ জন্মভূমি থেকে এদেশেও লালন করে যাচ্ছে তার ফলাফল কি দাঁড়াচ্ছে সে বিষয়ে লিখছিলাম। এদেশে, এই নিউইয়র্কেই তাদের কয়েক শত আঞ্চলিক সংগঠন এবং শতাধিক বাংলাদেশের বিভিন্ন স্কুল-কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের নামে অনেক এলামনাই এসোসিয়েশনসহ আরো অর্ধশতাধিক পেশাজীবী সংগঠন রয়েছে।

বাংলাদেশীরা ঐতিহ্যগতভাবে খুব বেশী আবেগপ্রবণ এবং সংবেদনশীল। তারা যেমন কোন একটি সংগঠন তৈরী করার বা প্রতিষ্ঠা করার প্রয়াস পায়, তেমনি তাদের অযাচিত আবেগ নিয়ে সেই সংগঠনটি আবার দ্রুত ভেঙেও ফেলে এবং নতুন করে আরেকটি সংগঠন তৈরী করে। আগেই উল্লেখ করেছিলাম যে তাদের এই বিভাজের একটি প্রধান কারণ হলো তারা বাংলাদেশী রাজনীতির চিন্তাধারাকে এদেশেও তাদের কার্যক্রম এবং কোন সংগঠনের নেতৃত্ব দিতে প্রয়োগ করার চেষ্টা করে। তারা নেতৃত্ব নিয়ে অযাচিত ঝগড়া-ঝাটিতে ও চরম মতনৈক্যে জড়িয়ে পড়ে।

এদেশে যেখানে অন্যান্য দেশের ইমিগ্রান্ট কম্যুনিটিগুলো নিজেদের মধ্যে একত্রিত হয়ে কাজ করার উদ্যোগ নেয়। তারা সংঘবদ্ধ হয়ে কাজ করে এবং নিজ দেশের রাজনৈতিক কার্যক্রমকে এদেশে টেনে আনে না বা সেগুলো নিয়ে নিজেদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করে না। এমনকি তারা এদেশে বৃহত্তম দুটি রাজনৈতিক দল, যেমন রিপাবলিকান এবং ডেমোক্রেটিক পার্টিকে সমর্থন করা নিয়েও নিজেদের সংগঠনগুলোতে কোন রকমের মতানৈক্য সৃষ্টি করে না। বরঞ্চ তারা নিজেদের মধ্যকার বিভিন্ন বিষয়ে পার্থক্যগুলোকে সরিয়ে রেখে একত্রিত হয়ে কোন একটি সংগঠনের, কি পেশাজীবী বা অপেশাজীবী, তার ছত্রছায়ায় থেকে একটি বৃহত্তম গোষ্ঠী হিসেবে এদেশে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করতে ও বিভিন্ন অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে কাজ করে যায়।

দুঃখজনক হলেও এটা সত্যি যে, তারা তাদের অনেক খুঁটি-নাটি বিষয়ে ব্যক্তিগত মতানৈক্যের কারণে কোন সংগঠনের ছাতার তলে কমুনিটির বৃহত্তম স্বার্থে এদেশে এখনো একসঙ্গে কাজ করতে শেখেনি। বাংলাদেশীদের এদেশে এইসব অনাকাঙ্খিত কার্যকলাপের কারণে তারা যে শুধু নিজেদের মধ্যেই বিবাদ সৃষ্টি করছে, প্রচুর অর্থ ও সময় নষ্ট করছে তাই নয়, তারা এদেশে তাদের উত্তরোত্তর আরো বেশী অগ্রগতিতে নিজেরাই বাধার সৃষ্টি করছে। বিভিন্ন ধরণের নাগরিক অধিকার আদায়ে বা তরান্বিত করতে নিজেদের পিছিয়ে রাখছে তাই নয়, তারা তাদের সেসব লজ্জাজনক এবং বিড়ম্বনাময় কার্যকলাপের মাধ্যমে এদেশে জন্ম নেয়া আমাদের নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের জন্য একটা হাস্যকর ও বিব্রতকর অবস্থার সৃষ্টি করছে।

এদেশে এখন পর্যন্ত যে সংগঠন বা উদ্যোগটি সার্থকতাসহ সাফল্যময় হয়, বাংলাদেশের স্বার্থে, বাংলাদেশের বাঙালিদের স্বার্থে, সবচেয়ে অর্থসহ যে অনুষ্ঠান বা কনসার্ট হয়, যাতে এখন পর্যন্ত সর্বোচ্চ সংখ্যক মানুষ যোগদান করেছিল, বাংলাদেশের জন্য, তা আমাদের সেই স্বাধীনতা যুদ্ধকালীন সময়ে, ১৯৭১ সালে করা ‘দ্য কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’ এখনো রেকর্ড সৃষ্টি করে আছে। যার উদ্যোক্তা ছিলেন বিটলসের গিটারবাদক এবং ভোকালিস্ট জর্জ হ্যারিসন এবং সেতারবাদক রবি শংকরের মত বিশ্ববিখ্যাত ব্যক্তিরা। যেখানে উপস্থিত হয়েছিলেন ৪০,০০০- এর বেশী দর্শক, যারা বাংলাদেশের স্বাধীনতার সমর্থনে, নিউইয়র্কের বিখ্যাত ম্যাডিসন স্কয়ার গার্ডেনে সমবেত হন এবং সর্বোচ্চ অর্থ সংগ্রহ করা হয় বাংলাদেশের শরণার্থী শিশুদের সাহায্যের জন্য। তৎকালীন সেই ফান্ড রেইজিং-এ সংগৃহীত হয় দুই লক্ষ পঞ্চাশ হাজার ডলার, যা আজকের মূল্যে প্রায় বিশ লক্ষ ডলারের সমপর্যায়ের।

অথচ সেই স্বাধীনতা অর্জনের পর বাংলাদেশী পাসপোর্টধারী বাংলাদেশী বাঙালীরা, আমরা যারা এদেশে বসতি গড়েছি বাংলাদেশী-আমেরিকান হিসেবে গত ৫০ বছর ধরে, তারা এখন পর্যন্ত সেই ধরণের নিঃস্বার্থ উদ্যোগ বা এদেশে আমাদের সমষ্টিগত কমিউনিটি, এমনকি এদেশে জন্ম নেয়া আমাদের নতুন প্রজন্মকে পথ প্রদর্শন বা দিকনির্দেশনা হিসেবে তেমন কিছু উপহার দিতে পারিনি। আমাদের শিখতে বাকি আছে যে ‘দশে মিলে করি কাজ হারি-জিতি নাহি লাজ’ বা ‘দশের লাঠি একের বোঝা’ অথবা ‘ঐক্যই শক্তি’। ছোটবেলা থেকে এইসব প্রবাদ পড়ে আসা সত্ত্বেও আমরা এগুলোর কোনোটাই বাস্তব অর্থে নিজেদের জীবনে এদেশে এসে প্রয়োগ করতে শিখিনি। এটা আমাদের সমষ্টিগত লজ্জা এবং চরম সীমাবদ্ধতা।

১৯৮৭ সালে প্রতিষ্ঠিত হওয়া এবং সেই বছরই ওয়াশিংটন ডি. সি. শহরে প্রথম সম্মেলন করা, তৎকালীন বাংলাদেশী-আমেরিকানদের বিভিন্ন সংগঠনকে একত্রিত করার, আপাতদৃষ্টিতে একটি মহৎ উদ্যোগ হিসেবে ফোবানা’র (ফেডারেশন অব বাংলাদেশী এসোসিয়েশনস ইন নর্থ আমেরিকা) সৃষ্টি করা হয়। কিন্তু সেই প্রাথমিক পর্যায়ের উদ্যোক্তাদের মাঝে বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলের মতভেদ এবং অন্যান্য বিভিন্ন ব্যক্তিগত বিষয়ে মতানৈক্যের কারণে মাত্র বছর কয়েক পরেই, ৯০ দশকের শুরুতে সেই ফোবানা ভেঙে দুটিতে পরিণত হয়। ক্রমান্বয়ে সেটা ভাঙতে ভাঙতে গত কয়েক বছরে তা ৪টি ফোবানা সম্মেলন এবং এর বিপক্ষে আরো গোটা কয়েক সম্মেলন আয়োজিত হয়।

এই বছর (২০২২ সালে) সেপ্টেম্বরের শুরুতে, লেবার ডে উইকেন্ডে তারা বিভিন্ন শহরে ৪টি সম্মেলন করে। শিকাগোতে একটি, ক্যালিফোর্নিয়ার লস এঞ্জেলেসে একটি, কানাডার মন্ট্রিয়েলে একটি এবং নিউইয়র্কে একটি। তদুপরি নিউইয়র্ক শহরে আরেকটি পাল্টা সংগঠন, আমেরিকা-বাংলাদেশ-কানাডা এই ব্যানারে ‘বাংলাদেশ সম্মেলন’ বলে আরেকটি সম্মেলন হয় এবং এটা তাদের চতুর্থ সম্মেলন বলে উল্লেখ করে। তার মানে তারা গত ৪ বছর ধরে তা করে আসছে।

অধিকাংশ বাংলাদেশীর মধ্যে ‘নেতা’ হওয়ার প্রবণাতা লক্ষণীয় এবং এই নেতাগিরি করার জন্য তারা সংগঠন ভেঙে নতুন সংগঠন তৈরী করেন। অথচ তারা বুঝতে চাননা যে একজন নেতা বা লিডার হওয়া একটা বড় গুণ হিসেবে ধরে নিয়ে তারা এদেশের মেইন স্ট্রিম পলিটিক্সে জড়িত হয়ে তাদের সেই নেতৃত্বের বৈশিষ্ট্যকে প্রমাণ করতে পারেন। সেই সাথে এদেশে নিজেদের বৃহত্তর কমুনিটির অনেক কল্যাণ সাধন করার সাথে সাথে এখানকার অন্যান্য কমুনিটির মাঝেও তাদের নেতৃত্বের গুণাগুণ প্রমাণ করে অধিকতর সম্মান অর্জণ করতে পারেন। কিন্তু তা তারা করবেন না। বরঞ্চ তারা নিজেদের মধ্যে চেয়ার কাড়াকাড়ি করে, একে অপরকে অকথ্য ভাষায় গালাগালি করে, একই সংগঠনের একে অপরের বিরুদ্ধে ডজন ডজন মামলা মোকদ্দমা করে, প্রতিবছর লক্ষ লক্ষ ডলার ব্যয় করে।

আমরা এদেশে এসে এখানকার সমাজ ব্যবস্থা থেকে অনেক কিছু শিখতে পারি এবং সেগুলো নিজেদের উন্নয়নে প্রয়োগ করতে পারি। এমনকি আমাদের মত করে অন্যান্য কমিউনিটিগুলো কিভাবে একত্রিত হয়ে তাদের নিজেদের বৃহত্তর কমুনিটি গড়ার জন্য, এদেশে জন্ম নেয়া তাদের নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের জন্য, এমনকি তাদের নিজের দেশের স্বার্থে এদেশে যৌথভাবে কাজ করে যাচ্ছে সেগুলো পর্যবেক্ষণ করে আমরা আরো ফলপ্রসূভাবে আমাদের মেধা, কর্মদক্ষতা, অর্থ ও মূল্যবান সময় ব্যয় করতে পারি। সে ব্যাপারে আমাদের আগ্রহ কম।

অথচ আমাদের চোখের সামনে, ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিরা এদেশে ১৯৮১ সালে প্রতিষ্ঠিত হওয়া ‘বঙ্গ সম্মেলন’ নর্থ আমেরিকান বেঙ্গলি কনফারেন্স নামে প্রতিবছর একত্রিত হয়ে এদেশে বাঙালি সংস্কৃতির ধারা বয়ে নেয়ার সাথে সাথে গত চার যুগ ধরে এদেশে তাদের নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের মাঝে একটা যোগসূত্রতার মাধ্যমে হিসেবে সাফল্যজনকভাবে ব্যবহার করে আসছে। তাদের মধ্যেকার হাজার হাজার বিয়ে-সাদির যোগাযোগ ঘটেছে সেই বঙ্গ সম্মেলনের মিলনমেলা থেকেই। গত ৪২ বছরে তাদের মধ্যে নেতৃত্ব নিয়ে কোন্দলের কারণে বা অন্য কোন কারণে বিভেদের সৃষ্টি হয়নি বা তারা সেই সংগঠন ভেঙে যেতে পারে এমন কিছু হতে দেননি।
সূত্র: সাপ্তাহিক বাঙালী, নিউ ইয়র্ক, অক্টোবর ১, ২০২২