আসমা-উল-হুসনা
ওয়ালমার্ট সুপারশপে সারাদিন হাটাহাটি করে কাজ করে আর মানুষ দেখে বীথি। কত ধরনের, কত ভাষাভাষীর মানুষ!কেউ বাংলায় কথা বললেই কানটা খাড়া হয়ে যায়, মনটা ভালো হয়ে যায়। আগ বাড়িয়ে যেয়ে কথা বলে, তারা বাংলাদেশি কিনা? বাংলাদেশে কোথায় বাড়ি? কতদিন ধরে এসেছে, এখানে কোথায় থাকে এইসব। বাংলায় কথা বলতে পেরে একটু শান্তি শান্তি লাগে। দেশের কথা মনে পড়ে যায়। কি একটা জীবন ছিল তার! নিজের ফ্লাটে প্রায় সন্ধ্যায় চায়ের আড্ডা বসত, না হলে তারাই চলে যেতো কোথাও না কোথাও। বাড়িতে কাজের বুয়ারা সব রেডি করে রাখত। মাছ ভাত ছিল তার প্রিয় খাবার। কত পদের মাছের তরকারিতে টেবিল সাজানো থাকতো। কত সন্মান জনক জায়গায় কত সন্মানিয় একটা পজিশনে কাজ করত সে। কত বন্ধু বান্ধব, আত্মীয় স্বজন, সহকর্মী দিয়ে ভরা ছিল তার জীবন। ড্রাইভার রেডিই থাকত ছুটির দিনে কোথাও না কোথাও ঘুরতে যাবার জন্য। আহারে সাতটা মাস ধরে কারো বাসায় যাওয়া হয়নি, কেউ আসেনি তার কাছেও, এখানেতো চেনেই না কাউকে, কোথায় যাবে সে আর কথাই বা বলবে কার সাথে। চায়ের আড্ডায় বসেনি কতদিন, তার প্রিয় দুধচা খাওয়াই বাদ হয়ে গেছে জীবন থেকে। মাছ খাওয়াই ভুলে যাচ্ছে, তাজা মাছ পাবে টা কই, ফ্রোজেন মাছে গন্ধ লাগে তাও কি সব মাছ! ওয়ালমার্টের এই কাজ শারিরীক পরিশ্রমের কাজ, জীবনে কখনোই চিন্তাই করেনি তাকে এমন কাজ করতে হবে, তারপরও কাজটা তার জন্য অনেকটা খোলা জানালার মতো। মানুষ দেখতে পারে, কথা বলতে পারে। ইন্ডিয়ান কিছু কলিগের সাথে ভালো সম্পর্ক তৈরী হইছে তাই ভালোই লাগে কিন্তু বাসায় ফিরতে হবে ভাবতেই মনটা তিতা হয়ে যায়।
বীথিরা বাংলাদেশ থেকে এসে উঠছে তার খুব কাছের আত্মীয়ের বাসায়। অনেক আগে থেকেই সেভাবে ঠিক করা, সেভাবে কিছু লেনদেন হয়েছে। কথা হয়েছে দেড়/ দুই বছর এখানে থাকবে সে হিসাবে বেজমেন্টে দুইটা বেডরুম ও বাথরুম তৈরী করা হয়েছে। কথামতো স্বামী আর দুই ছেলে মেয়ে নিয়ে ডিসেম্বর মাসে আমেরিকা এসেছে সে। চারিদিকে শুধু বরফ আর বরফ। কথা বলার কেউ নেই, কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই। ঘর থেকে বের হতে পারে না। গৃহবন্দী অবস্থা। ছেলেটা বাংলাদেশে থাকতে প্রায় দিনই দুইবার গোসল করত। এখানে এসেই শুনতে হলো প্রতিদিন গোসল করার কি আছে আর এত সময় নিয়ে গোসল করতে হবে কেন? পানির বিল, গ্যাসের বিল কত আসে কোনো হিসাব আছে। প্রতিদিন দুইবার গোসল করা ছেলেটা সপ্তাহে একবার গোসল করা শুরু করল, মাঝেমাঝে লুকিয়ে গোসল করে যখন তার আত্মীয়রা বাসায় থাকে না। মেয়েকে স্কুলে কিভাবে ভর্তি করবে জিজ্ঞেস করেছিল তার আত্মীর বউকে সে উত্তর দিল গুগলে সার্চ করে দেখেন আমি জানি না, তাই আর কোনো প্রশ্ন করতে দ্বিধা লাগে।
বীথির স্বামী বাউল প্রকৃতির উদাসীন মানুষ। সে ঘরে বসে থাকতে পারে না। ব্যাংক একাউন্ট খোলা হয়নি, তাই উবার ডাকতে পারে না, সারাজীবন দেশে ড্রাইভার ছিল তাই গাড়ি চালাতে পারে না। আত্মীয়কে বললে বলে সপ্তাহে দুইদিন ছুটি পাই সেটাও তোমাদের দিলে আমার সংসারে সময় দিবো কিভাবে? বীথির রান্না খেয়ে যেখানে মানুষ অনেক প্রশংসা করতো সেখানে এখানে এসে জানলো সে আসলে কোনো রান্নাই জানে না, তার রান্না মানেই লবন, মরিচ আর তেলের বাহার। রোজ কেন রান্না করতে হবে? গুড়া মরিচ এ বাসায় ঢুকানো যাবে না, মাসে আধা কেজির উপর লবন কেনা যাবে না, তেল দেড় লিটার ইত্যাদি ইত্যাদি নিয়ম কানুন। এ বাড়ি যেহেতু তার তাই এইসব নিয়ম মেনেই চলতে হবে। আস্তে ধীরে বাচ্চারা স্কুল কলেজে ভর্তি হয়, বীথি ও তার স্বামীও কাজে ঢুকে। সেখানেও সমস্যা দেশ থেকে করে আসা ডিগ্রির তেমন কোনো মুল্য পাচ্ছে না। দেশের করে কাজের অভিজ্ঞতা কোনো কাজে লাগে না হয়ত পথ ঘাট ভালো জানে না তাই এতো সমস্যা। তাই বাধ্য হয়ে শারিরীক পরিশ্রমের কাজ হলেও ওয়ালমার্ট এ কাজ শুরু করে। বাইরের সময়টা কঠিন হলেও সয়ে যায়।
কিন্তু চেনা মানুষের অচেনা চেহারা, গৃহবন্দী জীবন, কথা বলতে না পারা, তেল-লবন-মরিচের হিসাব, পানি-বিদ্যুৎ-গ্যাসের হিসাব, রান্নাবান্না-পরিস্কার পরিচ্ছন্নতা নিয়ে রোজ আতংক। বাচ্চাগুলো স্কুল কলেজ থেকে ফিরেই নিজেদের ঘরে বন্দী হয়ে যায় বীথি না ফেরা প্রর্যন্ত ঘর থেকে বের হয় না, না জানি কি শুনতে হয় সেই ভয়ে দুপুরে না খেয়ে থাকে। আনন্দে উচ্ছল থাকা ছেলেমেয়ের চুপসে যাওয়া চেহারা দেখে বুক ফেটে যায় বীথির। সেও যে একজন এম বি এ করা মানুষ, সেও যে পৃথিবী শ্রেষ্ঠ প্রতিষ্ঠানে কাজ করে এসেছে, তারও যে দেশে একটা সামাজিক অবস্থান আছে সে যেন ধীরে ধীরে ভুলতে বসেছে।নিজেকে গুটিয়ে নিতে নিতে নিজেকে ক্ষুদ্র করে ফেলেছে। রোজ ভোরে ঘুম ভেংগে আধা ঘন্টা বসে থাকে বিছানায়। মনে হয় তার কোথাও যেন কেউ নাই। আনন্দ বা কষ্ট শেয়ার করার কেউ নেই। মনে হয় তার জীবন যেন থমকে গেছে, আটকে গেছে কোনো এক অন্ধকার গহবরে। কেন এসেছে সে এখানে? এটা কেমন উন্নত জীবন তার? এরকম জীবনের জন্য আমেরিকা এসেছে সে? বাচ্চাগুলো প্রতিদিন একই কথা বলে মা চলো দেশে ফিরে যাই। দেশের কথা মনে পড়ে-মশা-মাছি, ধুলা-বালি, যানযট, গ্যাস-বিদ্যুত সংকট, রাজনৈতিক নৈরাজ্য, তারপরও সে কত স্বাধীন ছিল ওখানে।
পরিচিত পথ, নদী-নালা, খাল-বিল, বৃষ্টি-বাদল, রিকশার টুংটাং, ফেরিওয়ালা হাকডাক, হাজারো পরিশ্রমে নোনা ঝরানো সব মানুষ, অগনিত মানুষের আন্তরিকতা, মজার মজার সব খাবার, বন্ধু-বান্ধব, আত্বীয় স্বজন সব ভালোলাগা, সব ভালোবাসাই যেন ওই দেশ আর ওই দেশের মানুষের জন্য বয়ে বেড়ায় রোজ। হয়তো একটা দেশ ছেড়ে অন্য দেশে অবস্থান তৈরি তাদের কষ্ট হচ্ছে, সে হয়ত ভুল জায়গা বেছে নিয়েছিল, বিশ্বাস করেছিল ভুল মানুষকে কিন্তু সে জানে সে এক স্বাধীন দেশের স্বাধীন মানুষ। তার শিকড় অনেক মজবুত, সময় বদলাবে আর সেটা খুব দ্রুতই হবে। সে আর থাকবে না এই বন্দী জীবনে। লেনদেনের হিসাবের ধার সে আর ধরে না। নিজের মতো করে বাচবেএখন থেকে। সেও মাথা তুলে দাঁড়াবে স্বাধীনভাবে। তারা দেখেছে, সয়েছে, শিখেছে, মানুষ চিনেছে, তাদের হারবার বা হারাবার কিছু নেই কিন্তু যারা তাদের সাথে এমন করলো তারা কি কিছুই হারায় নি?
আপনার মতামত লিখুন :