যদি জানতাম – ছোটগল্প


ওহাইও সংবাদ প্রকাশের সময় : মার্চ ১৩, ২০২৩, ১১:০৯ অপরাহ্ণ /
যদি জানতাম – ছোটগল্প

রাশিদা কামাল

প্রাক্ শারদীয় বাতাসের একটা নিজস্ব ঘ্রাণ থাকে। এই ঘ্রাণটা সবাই অনুভব করে না। কিন্তু শিহাব করে। খুব সাবধানে একটু একটু করে ঘ্রাণটা বুকের মধ্যে টেনে নেয় ও। টেনে নিতে গিয়ে নিজেকেই প্রশ্ন করে কী আছে এই শারদীয় বাতাসে! কেনই বা মন স্পন্দমান হয় এ সময়! প্রশ্নটা মনে হতেই একটা গভীর শ্বাস বুকের মধ্যে জেগে ওঠে। কিছুক্ষণ শ্বাসটা বুকের গভীরে ঘোরাফেরা করে। বাইরে আসতে দেয় না ও। পাছে অন্য কেউ জেনে ফেলে! এই তো বেশ আছে! সব আবেগকে বুকের মধ্যে আটকে রেখে দিব্য চলছে ওর প্রাত্যহিক জীবন ।
মা বলেছে মলি এসেছে দেশে। মাত্র দুসপ্তাহের জন্য। যে কোনদিন আসতে পারে ওদের বাসায়। মলি ওর ছেলেবেলার বন্ধু। পুরো নাম মল্লিকা। এক পাড়াতেই বড় হয়েছে। ছেলেবেলার বন্ধুত্ব কবে প্রেমে পরিণত হয়েছে তা ওরা দুজনের কেউই টের পায় নি! প্রাত্যহিক সম্পর্কের পাশাপাশি আরও একটা সম্পর্ক ওদেরই অজান্তে দানা বেঁধেছে। অন্যদের কাছে যদিও বিষয়টা ছিলো নির্মল বন্ধুত্বের। অন্য কথা ওরা ছাড়া কেউই ভাবে নি।
কিছুক্ষণ আগে মা এসেছিলো ওর কাছে। বলে গেছে মলি একটু পরেই আসবে। শিহাবের মনের ভেতর একটা চেনা সুর বেজে উঠলো। কতদিন দেখে না মিলিকে! কেমন দেখতে হয়েছে ও! সেই আগের মতোই কি আছে! হাসলে গালে এখনও কি টোল পড়ে? শিহাবের মনে আছে ওই টোলের জন্যই ওকে এতো ভালো লাগতো। ইচ্ছে হতো ওর গালে ঠোঁট ছোঁয়াতে।

অনেকবার ছুঁইয়েছেও। মলি বাঁধা দিতো। শিহাব শুনতো না ওর কথা। জোর করেই ঠোঁট ছোঁয়াতো। বিয়ের পর ওর টোলটা কি হারিয়ে গেছে! মলি যদি ওর হতো তাহলে টোলটা হারাতে দিতো না কিছুতেই। ওর আদরেই জেগে থাকতো। অথৈ সমুদ্রের মাঝে জেগে থাকা শ্যামল সবুজ দ্বীপের মতো।
সৌন্দর্য একটা সূক্ষ্ম জিনিস। সবার চোখে ধরা দেয় না! মলি নিজেও জানতো না ওর এমন সৌন্দর্যের কথা যদি না শিহাব ওর টোলে ঠোঁট ছোঁয়াতে না চাইতো। কথা বলতে গিয়ে প্রায়ই হাত ছোঁয়াতো। আর তখনই ঠোঁট ছোঁয়াতে ইচ্ছে করতো।
মলির কাছে এসব এখন অতীত! হয়তো শিহাব নামে কেউ একজন ছিলো ওর জীবনে তা আর মনেও পড়ে না! মনে পড়ার কথাও না! কম বয়সের উচ্ছ্বাসময় আবেগকে কে আর মনে রাখে! তাছাড়া ভুলে যাবার কাজটা তো ও তরান্বিত করেছিলো!

বিকেল বেলাটা শিহাবের কাটে ওর রুম সংলগ্ন বারান্দায়। মা একটা রকিং চেয়ারের ব্যবস্থা করেছে। এখানে বসেই নারকেল গাছের পাতার ওপর পড়া রোদের ঝিলিক দেখে। শরৎকালের সন্ধ্যায় শিউলির গন্ধ গায়ে মাখে। আর তখনই কেন যেন মিলির কথা বেশি করে মনে পড়ে। মাঝে মাঝে রাতে ঘুম না এলে এখানে এসে বসে। এ সময় বাতাসে মন খারাপের ছোঁয়া থাকে। তখনও মলি পায়ে পায়ে এসে দাঁড়ায় ওর গা ঘেঁষে। ও তখন ইচ্ছেমতো মলির টোলে ঠোঁট ছোঁয়ায়। মলি বাঁধা দেয় না। শুধু লাজুক হাসে।

মার গলার আওয়াজ পাচ্ছে শিহাব। মা এদিকেই আসছে। নিশ্চয়ই সাথে মলি আছে!
‘ ঘুমিয়ে পড়লি নাকি শিহাব ! দেখ কে এসেছে ! ‘
চোখ তুলে তাকালো শিহাব ম মার পেছনে মলি। কথা বলতে বলতে মা ওর কাছে এসে পড়লো।
না, ঘুমায় নি ও। জেগেই আছে মলির জন্য। কতদিন পর দেখা হবে! ক্র্যাচটা হাতে নিয়ে উঠে দাঁড়াতে চেষ্টা করলো শিহাব। মা বাঁধা দিলো।
‘উঠতে হবে না ! মলি তোর কাছেই বসবে! ‘

শিহাব প্রথম মার দিকে তাকালো। তারপর আস্তে আস্তে মলিকে দেখলো। তাকিয়েই রইলো কিছুক্ষণ। না মলির তেমন পরিবর্তন হয় নি! ও সাবধানে মলির টোলটা খুজলো। পুরনো ইচ্ছেটা নতুন করে মাথাচাড়া দিয়ে উঠলো। মুহূর্তেই শাসন করলো নিজেকে। এ মলি তো ওর না–অন্য একজনের! এ মলিকে ও চেনে না! ও তো চেনে ওর বুকের ভেতর জেগে থাকা মলিকে! যে পায়ে পায়ে ওর কাছে আসে, শিউলির মিষ্টি গন্ধ ছড়ায়!
মার গলা,
‘তুই এখন কী খাবি মলি ?’
‘এখন কিছু খাব না। তুমি ব্যস্ত হয়ো না!’
‘তাই বললে কী হয়! কতদিন পর এলি! শোন, রাতে কিন্তু খাওয়াদাওয়া করে যাবি!’
মলির উত্তরের অপেক্ষা না করেই মা চলে গেলো।
রোদে বেগুনি রঙের ছোঁয়া। নারকেল গাছটাকে অন্যরকম দেখাচ্ছে। সেদিক থেকে চোখ সরিয়ে শিহাব তাকালো মলির দিকে। মলির চোখে বৃষ্টির ছোঁয়া।

‘দাঁড়িয়ে আছ কেন মলি! বোস!’
একটা হাত দিয়ে চেয়ারটা শিহাব ঠিক করে দিলো। মলির চোখের জলকণা প্রচণ্ড ঝাঁকি খেয়ে ঝরে পড়ছে।
‘কাঁদছ কেন!’
শিহাবের কথায় মলির কান্নার তোড় বেড়ে গেলো। শিহাব হাত বাড়ালো মলিকে ছোঁয়ার জন্য। মলি সেই বাড়ানো হাতে হাত রাখলো।
‘কেঁদ না! কী হয়েছে বলো!’
শিহাবের মনের মধ্যে সেই চেনা সুর বেজে চলেছে। ও নরম নীলাভ আকাশের দিকে তাকিয়ে সুরটাকে বুকের মধ্যে ধরে রাখতে চাইলো। ততক্ষণে নিজেকে কিছুটা সামলেছে মলি। শিহাবের কপালে হাত রাখলো।
‘তোমার ফিরে আসার কথা আমি জানতাম শিহাব! তবে এতোটা খারাপ অবস্থায় আছ তা ভাবি নি!’
‘ভাবলে কী করতে! সব ছেড়ে চলে আসতে আমার কাছে!’
‘আসতে তো চেয়েছিলাম! তুমি দাও নি!’
‘কেন দেই নি তা নিশ্চয়ই আমাকে দেখে বুঝতে পারছ!’

‘তোমার কী মনে হয়? তোমাকে এ অবস্থায় দেখলে আমি সরে যেতাম! কী ভাব তোমরা মেয়েদেরকে! যদি জানতাম তুমি বেঁচে আছ তাহলে ———-
‘তাহলে কী মলি!
‘সেটা প্রমাণ করতে তো দাও নি! তোমাদের বাসা থেকে জানানো হয়েছিল তুমি যুদ্ধেই মারা গেছ।’
‘মরেই তো গিয়েছিলাম!’
‘আহত অবস্থায় কোথায় ছিলে? আমার সাথে যোগাযোগ কর নি কেন?’
‘ইচ্ছে করে করি নি! আমার এ অবস্থা তুমি মেনে নিতে পারতে না। তাছাড়া আমার এ বিড়ম্বিত জীবনের সাথে তোমাকে জড়াতে চাই নি মলি! আমি ইন্ডিয়ায় একটা হাসপাতালে ছিলাম। অনেক সময় লেগেছিল সুস্থ হতে। সুস্থ হয়ে নিজেকে আবিষ্কার করলাম এ অবস্থায়। তোমাকে আর কষ্ট দিতে মন চাইলো না। তাই মাকে আমার মৃত্যুর সংবাদ পাঠালাম।’

‘আমি অনেকদিন তোমার অপেক্ষায় ছিলাম! শেষ পর্যন্ত ——–
‘শেষ পর্যন্ত বিয়ে করলে!’
‘করতে বাধ্য হলাম। আমাকে কে টানবে! যদি তোমার বেঁচে থাকার কথা জানতাম তবে বিয়ের কথা ভাবতাম না! তোমার জন্যই আজ আমরা বিচ্ছিন্ন!’
মলির কথাগুলি খুব ভালো লাগছে শিহাবের। মলি ওকে এখনও ভোলে নি! ভুলটা তো ওর! ভালোবাসার কেমিস্ট্রি তো অন্য রকম! সব কিছুর সাথে মেলে না! তবে আজ আর এসব কথা ভেবে লাভ কী!
মলি আরও কাছে এগিয়ে এলো।

‘বেঁচেই যখন আছ তাহলে বিয়ে কর নি কেন!’
বন্ধ চোখ আস্তে আস্তে খুলল শিহাব। মলির দিকে তাকালো গাঢ় দৃষ্টিতে।
‘তোমার মতো কাউকে তো পাই নি! অথবা তোমাকে ভুলতে পারি নি! মনে আছে মলি, ছোটবেলায় আমরা বর বউ খেলতাম! তুমি বউ হতে আর আমি বর! চাদর টানিয়ে ঘর বানাতাম। সে ঘরে আমাদের বসানো হতো! ছোট একটা রুমাল মুখে চেপে ধরে আমি তোমার পাশে বসে থাকতাম। আর তুমি ঘোমটার ফাঁকে আমাকে দেখতে!’
একটু হাসলো শিহাব।

‘আনিস খুব রাগ করতো! ও বর হয়ে তোমার পাশে বসতে চাইতো। আমি দিতাম না।
আর এ কারণেই ওর সাথে আমার গোলমাল হতো। ও আমাকে দেখতেই পারতো না !
জানো মলি আমরা কিন্তু একসাথে যুদ্ধ করেছি!
‘আনিস কেমন আছে?’
‘ওপারে কেমন আছে জানি না। আমি আহত হয়েছিলাম আর ও মারা গিয়েছিলো।’
বাতাস বিষণ্ণ। রাত একটু একটু করে গাঢ় হচ্ছে। ওদের কথা ফুরাচ্ছে না! অনেকদিন পর স্মৃতিরা মুখর হয়েছে। স্মৃতিরাও তো ভালোবাসার অংশ!
মা ডেকে গেছে। উঠতে হবে এখন। ওরা ছুঁয়ে আছে দুজন দুজনকে।
‘মলি মা ডেকেছে।’
‘আর একটু থাকি!’
‘তোমার দেরি হচ্ছে না!’
‘চলে যেতে বলছ!’
আবার উদাস হলো শিহাব।

‘তোমাকে চলে যেতে বলার সাধ্যি কই আমার! আমার গণ্ডিটা খুব ছোট মলি! সেই গণ্ডিটা জুড়ে আছ তুমি। শুধুই তুমি! সেই ছেলেবেলার চাদরের
ঘরের মতো! আমরা বর বউ সেজে বসে থাকতাম–তুমি তাকাতে আমার দিকে ঘোমটার ফাঁকে! মলি, আমি এখনও তোমাকে সেভাবেই দেখি! বুকের ভেতরের নদীটা দুলে ওঠে। তুমি তখন আস আমার কাছে। চাদরের ঘরটা কিন্তু থাকে! আমি তোমার গালের টোলটা ছুঁয়ে দেই। কখনও কখনও ঠোঁট দিয়ে ছুঁই। না, তুমি তখন বাঁধা দাও না। আমি জানি ভালোবাসার মানুষটাকে এভাবেই ধরে রাখতে হয়! অদ্ভুত সকাল নামে শরীর জুড়ে। তোমার চুলের মিষ্টি গন্ধ আমাকে ছুঁয়ে থাকে। এক বুক না, এক পাহাড় রোদ ওঠে মনে।
আমার শরীর অবশ হয়। আমি সবকিছু বিস্মৃত হয়ে শুধু তোমাকেই জড়িয়ে ধরে থাকি!
মলি এর পরেও বলবে তোমাকে চলে যেতে বলেছি!’
মলির মুখে কোন কথা নেই। ওর বুকেও একটা নদী বইছে! উথালপাথাল ঢেউ তাতে। সেই ঢেউয়ের ছোঁয়া ওর দুচোখে। চোখের নোনাজল ওকে বুঝিয়ে দিচ্ছে ভালোবাসা কখনও হারায় না—-হারাতে পারে না ! প্রাত্যহিক জীবনের সাথে লেপটে থাকে। যা জীবনের মূল্যবান প্রাপ্তি।