ক্লিভল্যান্ডে একখণ্ড বাংলাদেশ ও আবহমান বাংলার পিঠা উৎসব


ওহাইও সংবাদ প্রকাশের সময় : মার্চ ১২, ২০২৩, ১১:০৪ অপরাহ্ণ /
ক্লিভল্যান্ডে একখণ্ড বাংলাদেশ ও আবহমান বাংলার পিঠা উৎসব

লালন নূর, ক্লিভল্যান্ড, ওহাইও সংবাদ : উৎসব ও বাঙালি একে অপরের পরিপূরক; যেন স্বচ্ছ জলের আয়নায় পরস্পরের বিম্বিত প্রতিচ্ছবি। এখানে যাপিত জীবন আর সংস্কৃতি-যাপন মিলে-মিশে একাকার হয়ে সকল বিভেদ ভুলে ডানা মেলে উড়ে যায় সম্পর্কের বালিহাঁস। ফুলেল আবেগে অবলীলায় বেজে ওঠে দূর থেকে ভেসে আসা সুর, “আজহোক না রঙ ফ্যাকাশে / তোমার আমার আকাশে / চাঁদের হাসি যতই হোক না ক্লান্ত / বৃষ্টি নামুক নাই বা নামুক / ঝড় উঠুক নাই বা উঠুক / ফুল ফুটুক নাই বা ফুটুক-আজ বসন্ত”।


এমনি এক বসন্তের রঙিন আবহে গত ২৫ ফেব্রুয়ারি (শনিবার) ক্লিভল্যান্ডে পালিত হলো আবহমান বাংলার পিঠা উৎসব। প্রকৃতির প্রবহমান প্রবালে বসন্তের পূর্ণতায় বাঙালি পরিচয়ে জেগে উঠে ছিলো একখণ্ড বাংলাদেশ। উৎসবের রঙ আর রকমারি পিঠার আবহে মেতে উঠে ছিলো সবাই। প্রতিদিনের বিশ্বাস আর বিভঙ্গের দ্বন্দ্ব ঝেড়ে ফেলে নতুন করে মিলিত কণ্ঠের সুর এখানে বেজে উঠেছিলো মধুর হয়ে। বসন্ত যেমন বাঙালিকে দেয় জীবনের বিভা, শীতের হাজারো পিঠা তাকে দেয় মিলিত হবার পরম বন্ধুতা। রঙ আর বাঙালি এখানে হয়ে ওঠে প্রাত্যহিকতার প্রতিচ্ছবি। প্রবাসের যাপিত জীবনে পিঠার উৎসবে এমন বসন্তকে ঘিরে জীবনের গান এখানে হয়ে যায় বেঁচে থাকার একমুঠো রোদ্দুর। ভোজন রসিক বাঙালির জীবনে আড্ডা অনতিক্রম্য। হল ভর্তি আবাল বৃদ্ধ বনিতা। কোণায় কোণায় এখানে-ওখানে যেন বেজে উঠেছিলো-“আজি দখিন-দুয়ার খোলা / এসোহে, এসো হে, এসো হে আমার বসন্ত এসো / দিব হৃদয় দোলায় দোলা”।

প্রায় অর্ধশত বাঙালি পরিবার মিলিত হয়েছিলো এই পিঠা উৎসবে। সবাই এনেছিলো নিজ হাতে বানানো নানা রকমের পিঠা আর তার সাথে রাতের খাবারের দুটি করে পদ। অংশগ্রহণের উচ্ছ্বাস যেন বোধের জগত থেকে টেনে এনে বোধনকে দিয়ে ছিলেন প্রকাশ-মহিমা। আর এখানেই তা হয়ে ওঠে অনিবার্যতায় বাঙালির আবহমান চেতনার প্রকাশ; প্রথা ও প্রার্থণার পরিভাষা। এ বোধ থেকেই আবহমান বাংলার পিঠা উৎসবহয়ে ওঠে প্রবাসি বাঙালির প্রাণের উৎসব; যেন প্রবাস জীবনের নিভৃতির আড়ালে নিরব দৈনন্দিনতার নিবিড় অনূবাদ। পিঠার এমন আয়োজন যেন বাঙালির নিশ্বাস ও নিবিড়তার নিখাদ মুখরতা। ঐতিহ্য আর সংস্কৃতির প্রকাশে পিঠা তাই আবহমান বাঙালির প্রাণের প্রসূন, সাবলীল ঝর্ণাধারায় প্রণত প্রপাত।

বহুবর্ণিল রঙের সঙ্গীতময় বিচ্ছুরণকে উৎসবের সমারোহে এভাবেই সর্বজনীন করে তোলে ক্লিভল্যান্ডে বসবাসকারী বাঙালিরা। এ যেন জীবনকে উজাড় করে করে দিগন্তে ভাসমান সত্যিকারের ডানা মেলা পাখির অবিরাম চলাচল; ধর্ম ও বিশ্বাসের সীমাবদ্ধতা থেকে মুক্তির রঙিন মুখাবয়ব। নানান রকমের পিঠার আয়োজনের সাথে ছিলো শিশুদের জন্য বেলুন টুইস্টিং ও ফেইস পেইন্টিঙের ব্যাবস্থা, যা এই উৎসবে শিশুদেরও করে ছিলো একাত্ম। পিঠা উৎসব ঘিরে নির্ধারিত কোন সাংস্কৃতিক পরিবেশনা না থাকলেও মুক্ত মঞ্চ ছিলো সবার জন্য উন্মূক্ত। সবাইকে নিজের আনন্দে গান গেয়ে শোনান মেজবাহ ও রুবেল। নাচ পরিবেশন করেন আরশি। আয়োজনের শেষে কেক কেটে সবার সর্বাঙ্গিন মঙ্গল কামনা করেন শ্রদ্ধেয় আপেল খালা। সব শেষে ছিলো র‌্যাফেল ড্র। এই আয়োজনটির সার্বিক দায়িত্বে ছিলেন মুনমুন চৌধুরী, নিগার সুলতানা ও রিপা নূর।

শুধু উৎসবের পূর্ণতা নয়, এমন আয়োজনে বাঙালি খুঁজে পায় মিলন-তীর্থ। শীতের শূন্যতার শেষে পরিপূর্ণ ফুলেল আবাহন বাঙালিকে দেয় উড়ে উড়ে ঘুরে বেড়ানোর মোহন মুগ্ধতা। বসন্ত যেমন জীবনের উঠানে হাসপাতালের বারান্দা থেকে শুশ্রুষা হয়ে ছুটে আসা হাতে আঁকা বাঁকা বাঁকা রোদ, তেমনি একখণ্ড প্রবাস জীবনে এমন পিঠার আয়োজন যেন বাঙালির কল্পনার দোদুল্যমানতায় স্বদেশের সাথে নিবিড় স্বপ্ন বিনিময়। নিজেকে উজার করে গড়ে তোলা বিশ্বাসের হারমোনিয়াম এখানে সবার হয়ে সুর হয়ে বাজে রন্ধ্রে রন্ধ্রে। বিশ্বের বুকে বুক মিলিয়ে বেঁচে থাকার বাসনা পাখা মেলে উড়ে যায় দিগন্তে-“মধুর বসন্ত এসেছে মধুর মিলন ঘটাতে,/ মধুর মলয়সমীরে মধুর মিলন রটাতে ॥ / কুহকলেখনী ছুটায়ে কুসুম তুলিছে ফুটায়ে, / লিখিছে প্রণয়কাহিনী বিবিধ বরনছটাতে”।