আমেরিকায় আমাদের নতুন প্রজন্ম – ধারাবাহিক ১০৭


ওহাইও সংবাদ প্রকাশের সময় : ফেব্রুয়ারি ১৩, ২০২৩, ৯:৫৫ অপরাহ্ণ /
আমেরিকায় আমাদের নতুন প্রজন্ম – ধারাবাহিক ১০৭

মিজান রহমান, নিউইয়র্ক
প্রবাস জীবনে এদেশে আমাদের অনেক ইতিবাচক দিক বা অর্জন থাকা সত্ত্বেও আমরা অনেকেই বিভিন্ন অনুৎপাদনশীল বা অফলপ্রসূ বেশ কিছু কর্মকাণ্ডে নিজেদের অতিমাত্রায় নিয়োজিত রাখি। কিভাবে আমরা আমাদের অনেক মূল্যবান সময়, অর্থ, জ্ঞান এবং মেধার অপচয় করি অথবা কমিউনিটি হিসেবে নিজেদের অগ্রগতির পথে নিজেরাই অনেকটা বাধা হয়ে দাঁড়াই, এই বিষয় গুলো নিয়ে এই সংখ্যায় কিছুটা আলোকপাত করব। তবে আমি পাঠকদের এ বিষয়ে তাদের মতামত জানাতে অনুরোধ করি। সাপ্তাহিক বাঙালী পত্রিকায় ইমেইলের মাধ্যমে আপনাদের মূল্যবান মতামত পাঠানোর অনুরোধ রইলো।

গত সংখ্যায় উল্লেখ করেছিলাম যে প্রবাসে এসে একটি কম্যুনিটি হিসেবে আমরা যখন বড় কোন শহরে, যেমন নিউইয়র্কে, ঘনবসতিপূর্ণ হয়ে বসবাস করি তার অনেক সুবিধা এবং অসুবিধা দুটোই রয়েছে। সুবিধাগুলোর মধ্যে প্রধানত নিজস্ব ভাষা, সংস্কৃতি চর্চা, ধর্ম চর্চা ও পারিবাকি মূল্যবোধ এবং খাদ্যাভাস ইত্যাদি ধরে রাখা। আবার অসুবিধাগুলোর মধ্যে প্রধান একটি হলো যে আমরা অনেকেই নিজস্ব দেশীয় ভাবসাব, রীতি-নীতি, স্বদেশের অনুকরণে প্রায় সবকিছুই করার অতিমাত্রায় চেষ্টা করি। অনেক ক্ষেত্রে আমরা বাস্তবতাকে উপেক্ষা করি। আবার জেনে বা না জেনে অনেক সময় এদেশের সামাজিক রীতি-নীতিকে অগ্রাহ্য এবং অসম্মান করে খামখেয়ালিভাবে চলার চেষ্টা করি।

বাংলাদেশীরা জাতিগতভাবে তাদের অতি আবেগ-প্রবণতা, নিজেদের মধ্যে বিভাজনতা এবং স্বদেশের রাজনৈতিক-অভিমতের যে ধারা নিজ জন্মভূমি থেকে এদেশেও লালন করে যাচ্ছে তার ফলাফল কি দাঁড়াচ্ছে তার ওপর কিছুটা আলোকপাত করার ইচ্ছা। এবং এদেশে তাদের সংস্কৃতি ও সাহিত্য (যেমন বাংলা ভাষায় লেখা-লেখি, পত্র-পত্রিকা প্রকাশ, লাগাতার অনুষ্ঠানাদি) ইত্যাদির অতি-গুরুত্ব আরোপের ফলাফল-এসবের দীর্ঘমেয়াদি প্রাপ্তি এবং অপ্রাপ্তি কি দাঁড়াতে পারে তার সম্ভাবনার ওপর দৃষ্টি নিবন্ধেরও চেষ্টা করব।

বাংলাদেশীরা ঐতিহ্যগতভাবে খুব বেশী আবেগপ্রবণ এবং সবেদনশীল। কিন্তু তারা অনেক ক্ষেত্রেই এগুলোর ব্যবহার বা প্রয়োগ ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও সামাজিক- এই পর্যায়ে যে ভিন্নতর হয় বা হওয়া উচিত তা বোঝে না বা পার্থক্য নির্ণয় করতে পারেনা। যার ফলে তারা যেমন কোন একটি সংগঠন তৈরি করার বা প্রতিষ্ঠা করার প্রয়াস পায়, তেমনি তাদের অযাচিত আবেগ নিয়ে সেই সংগঠনটি আবার দ্রুত ভেঙেও ফেলে এবং নতুন করে আরেকটি সংগঠন তৈরি করে। সুতরাং তারা এই আমেরিকাতে সংখ্যায় অত্যন্ত ক্ষুদ্র একটি কম্যুনিটি হওয়া সত্ত্বেও, একমাত্র এই নিউইয়র্কেই বাংলাদেশী ৬৪টি জেলা, বৃহত্তর জেলা সহ অন্যান্য বহু উপজেলার নামে ৩শ’র বেশী আঞ্চলিক সংগঠন গঠন করেছে। তার ওপর রয়েছে বাংলাদেশের কয়েক শত স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, ক্যাডেট কলেজ, মেডিকেল স্কুল ও অন্যান্য বিশেষ ধরনের স্কুল/কলেজের নামে এলামনাই এসোসিয়েশন।

আঞ্চলিক সংগঠনগুলি ছাড়াও অন্যান্য অনেক গুলো পেশাগত সংগঠনও রয়েছে এবং তারাও বিভক্ত। যেমন নিউইয়র্কে বাংলাদেশী পত্র-পত্রিকায় কাজ করে এমন সাংবাদিকদের জন্য রয়েছে প্রেসক্লাব এবং তা ৪টি সংগঠনে বিভক্ত। এদেশে এমনকি বাংলাদেশী-আমেরিকানদের বৃহত্তর পেশাগত সংগঠনগুলোর মধ্যে অনেকগুলিই দ্বিধাবিভক্ত। যেমন বাংলাদেশ ইঞ্জিনিয়ার্স এন্ড আর্টিটেক্টস এসোসিয়েশনটা এদেশের বিভিন্ন ভৌগলিক সীমানা অনুযায়ী যেমন ভিন্ন ভিন্ন, তেমনি কেন্দ্রীয়ভাবে এবং এমনকি একই স্টেটে, যেমন নিউইয়র্কেও তা দুই ভাগে বিভক্ত। কয়েক বছর আগে বাংলাদেশ মেডিকেল এসোসিয়েশনটাও ভেঙে দুটি শাখায় পরিণত হয়েছে। তারা একই শহরে (এই নিউইয়র্কে) এই বছর একই উইকেন্ডে দুটি ভিন্ন মেরিয়ট হোটেলে দুটি সেন্ট্রাল কনভেনশন করছে। অথচ এদেশে ইন্ডিয়ান-আমেরিকান ডাক্তারদের সংখ্যা ১,২০,০০০-এরও বেশী এবং তাদের কিন্তু একটি মাত্র কেন্দ্রীয় সংগঠন। অথচ বাংলাদেশেী-আমেরিকান ডাক্তারদের সংখ্যা ২,০০০-এরও কম অথচ সংগঠনে বিভক্তি আছে।

প্রশ্ন আসতে পারে যে, এতসব উচ্ছৃংখলতা ও বিভাজনতার কারণ কি? এবং এসবের খেসারত বা দায়ভার কাদের? অন্যান্য কারণের মধ্যে, বিভাজনের একটি প্রধান কারণ হলো বাংলাদেশী-আমেরিকানদের তাদের দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি সমর্থনের মনোভাব তারা এই সুদূর আমেরিকাতে শুধু যে বয়ে এনেছে তাই নয়, তারা তা লালনও করে যাচ্ছে। বিশেষত বাংলাদেশের প্রধান দুটি রাজনৈতিক দল- আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি সমর্থকরা এদেশে তাদের শিক্ষাগত যোগ্যতা, পেশাগত দায়িত্ববোধ এবং বাংলাদেশী-কমিউনিটি হিসেবে তাদের যে সমষ্টিগত শক্তি- তা যথাযথভাবে ব্যবহার না করে বিভক্তির পথ বেছে নিচ্ছে।
তাদের এই কর্মকাণ্ডের খেসারত কারা দিচ্ছে বা কাদের ওপর বর্তাচ্ছে- তা আমরা চিন্তা করছি না। এর প্রভাব গিয়ে পড়ছে বৃহত্তর বাংলাদেশী কমিউনিটিতে, তাদের পরিবার-পরিজন এবং এদেশের জন্ম নেয়া আমাদের নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের ওপর।

এই যে শত শত সংগঠন আমাদের কমিউনিটিতে এদের প্রধান কাজ কি এ বিষয়ে কিছুটা আলোচনা করা যাক। এরা প্রায় প্রতি বছরই নিজেদের মধ্যে নির্বাচন করে এবং সেই নির্বাচনকে কেন্দ্র করে হাজার ডলার খরচ করে এবং মাসাধিককাল এই নির্বাচন নিয়ে তটস্থ থাকে। নিউইয়র্কের কয়েকটি বড় বড় সংগঠন তাদের নির্বাচনের ক্যাম্পেইনে প্রধান-প্রার্থীরা এক একজন ৫০,০০০ থেকে ১,০০,০০০ ডলার খরচ করে। বিভিন্ন সংগঠন বছরে একটা বনভোজন করে, বাংলাদেশের বিভিন্ন জাতীয় দিন উদযাপন করে, ঈদ ও পূজা-পার্বন উপলক্ষে একত্রিত হয়ে আনন্দ করে এবং আড্ডা দেয়। আর পেশাজীবী সংগঠনগুলো কি করে? তারাও বছরে একটা বনভোজন করে, একটা সামার-সম্মেলন করে আর একটা উইন্টার গ্যাদারিং করে। তারা তাদের সেই সম্মেলনে তাদের পেশাগত কিছু পড়াশুনা (কন্টিনিউইং এডুকেশন) ছাড়া কিছু গান-বাজনার আয়োজন করে, খাওয়া-দাওয়া করে, আর যে শহরে তারা সেই সম্মেলনটি করে সেই শহরটিতে ঘোরাঘুরি করে, বিভিন্ন দর্শনীয় স্থান দেখতে যায় ইত্যাদি। আর সবচেয়ে প্রধান আকর্ষণ হলো তারা নিজেরাই নিজেদের পুরষ্কৃত করে বিভিন্ন আকারের মেডেল দিয়ে।

এদেশে একটি পেশাগত সংগঠনের অনেক শক্তি বা পাওয়ার থাকার কথা। তারা তাদের বার্ষিক সম্মেলনের মধ্যেমে স্থানীয় গভর্ণর বা অন্যান্য কর্মকর্তা থেকে শুরু করে ফেডারেল কর্মকর্তাদের নিমন্ত্রণ করে। তাদের পেশাগত বিষয়ে লবিং করা ছাড়া তারা এদেশে তাদের কমুনিটির অধিকার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে, এমনকি নিজ নিজ দেশের পক্ষে, সরকারের পক্ষে লবিং করে, কানেকশন বা যোগাযোগ সৃষ্টি করে। তারা তাদের দেশের বা এদেশের জনকল্যাণে বিভিন্ন সেবা-কাজের জন্য অর্থ সংগ্রহ করে, বড় বড় চ্যারিটেবল ফাউন্ডেশন তৈরি করে। বৃহত্তর জনহিতকর কাজে তাদের সময় ও মেধা বিনিয়োগ করে, গবেষণায় বিনিয়োগ করে। আর আমাদের পেশাজীবী সংগঠনগুলো অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তাদের সম্মেলনের প্রধান আকর্ষণ হলো বাংলাদেশ থেকে শিল্পী আনিয়ে তারা গান শোনা, এমনিক একাধিক শিল্পী এনে তা করা। এটা যে কত বড় মেধা, সময়, সুযোগ ও অর্থের অপচয় তারা তা বোঝে না। অথচ বাংলােেদশী অনেক পেশাজীবী সংগঠনের বয়স ২০, ৩০ এমনকি ৪০ বছর, যেমন বাংলাদেশে মেডিকেল এসোসিয়েশন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ১৯৮১ সালে মাত্র কয়েক ডজন ডাক্তারদের নিয়ে।

অন্য দেশীয় পেশাজীবী সংগঠনের কর্মকর্তারা যেখানে এদেশে জন্ম নেয়া ছেলেমেয়ের মাঝে যোগসূত্র তৈরিতে বিশেভভাবে মনোযোগী হয় এবং তাদের জন্য উপযোগী ও উপভোগ্য অনুষ্ঠানাদির পরিকল্পনা করে, এমনকি ইন্ডিয়ান মেডিকেল এসোসিয়েশন এদেশে জন্ম নেয়া ও ডাক্তার হওয়া তাদের ছেলেমেয়েদের জন্য স্বনির্ভর একটি অঙ্গ-সংগঠন প্রতিষ্ঠিত করেছে তাদের প্রধান সংগঠনের ছায়ায়। তারা সেই অঙ্গ-সংগঠনের মাধ্যমে তাদেরকে (তাদের নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েদেরকে) একত্রে থাকতে উৎসাহিত করে। অথচ এদেশে বাংলাদেশী কমুনিটির পেশাগত সংগঠন এমনকি তাদের নিজেদের ছেলেমেয়েদের উপস্থিতত রাখতেও ব্যর্থ হচ্ছে। এর ফলে তারা তাদের ছেলেমেয়েদের শেকড় থেকে দূরে সরিয়ে দিচ্ছেন। এর পরিণতি যে কত ভয়াবহ তা একবারও চিন্তা করছেন না তারা। সূত্র: সাপ্তাহিক বাঙালী, নিউ ইয়র্ক, সেপ্টেম্বর ২৪, ২০২২