রাশিদা কামাল
আমি প্রায়ই একটা কথা বলি ,
সময় বহতা নদী। আমার লেখায়ও এ বাক্যটির আধিক্য লক্ষণীয় তা আমি নিজেও বুঝি। এক সময় ছিলো যখন সময়কে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে সারাদিন বন্ধুবান্ধবের সাথে গল্প করে কাটিয়েছি — ঘুরেছি — বেড়িয়েছি। বাসার কথা মনেও পড়ে নি! মনে পড়ে নি কথাটা ঠিক না, আসলে মনে করতে চাই নি! নিজেকে অমিত শক্তির আধার বলে মনে হয়েছে তখন। মনে হতো সময়কে ভয় পাব কেন! সময় তো উপভোগেরই জন্য! আর তাই সময়কে বহতা নদীর সাথে তুলনা করার কথা ভাবি নি। কিন্তু আমি ভাবি নি বলে বহতা নদীটা তো আর থেমে থাকে নি! নীরবে সে বয়ে চলেছে। এখন আমি নদীটাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখাই না! বরং ভয় পাই। নদীটাই আমাকে দেখায়! শুধু বৃদ্ধাঙ্গুলিই দেখায় না, আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসিও হাসে! কারণ স্রোতশীলা নদীটা অনেকটা পথ পেরিয়ে গেছে আমার জীবন থেকে, আমারই অজান্তে।
জানুয়ারির আট তারিখে আমার ঢাকা যাবার কথা। একা যাব। আমার প্লেন ফোবিয়া আছে। এ কারণেই বেশ কয়েকদিন নির্ঘুম রাত কাটাচ্ছিলাম। ভয়ে কথাটা রথীকে বলি নি! কিন্তু না বললেও কথাটা বাসার সবাই জানে। সুতরাং ঘুরে ফিরে সবাই আমাকে সাহস জোগাচ্ছে। এতোবার আসাযাওয়া করি তবুও ভয়টা কাটিয়ে উঠতে পারি না। রথী এ কারণেই আমার ওপর রাগ হয়।
বিকেলের মধ্যেই রথী আমাকে এয়ারপোর্ট নিয়ে এলো। ইমিগ্রেশন ক্রশ করে লাউঞ্জে গিয়ে বসলাম। একটু আগে এসেছি বলে আমার পাশে কাউকে দেখতে পেলাম না। দূরে দূরে অল্প কিছু মানুষ গভীর মনোযোগে ফোনের দিকে তাকিয়ে আছে। আমি সাথে একটা বই আনব ভেবেছিলাম। তাড়াহুড়োয় ভুলে গেছি। তাই চুপ করে বসে থাকা ছাড়া আমার আর কোন উপায় ছিলো না। এভাবে আধা ঘণ্টা পার করলাম। নিজের কাছেই নিজেকে খারাপ লাগছিলো। কেন ভুলে গেলাম! কিছুটা সময় তো কাটতো ভালোভাবে! এভাবে বসে থাকতে থাকতে হঠাৎ দেখলাম আমার পাশে একটা মেয়ে এসে দাঁড়ালো। আমার দিকে তাকিয়ে একটু হাসলো। ওকে দেখে মনে হলো ও এশিয়ান। ভারত, পাকিস্তান অথবা বাংলাদেশেরও হতে পারে। ব্যাগটা রাখতে রাখতে আমার কাছে জানতে চাইলো,
তুমি কি নিউইয়র্কে যাবে ?
আমি হ্যাঁ বললাম। মেয়েটা বলল, তারপর ?
আমি হেসে বললাম তারপর দোহা।
দোহা শুনে ওকে ভীষণ আনন্দিত মনে হলো। একটু উত্তেজিতও। আমার দিকে কিছুটা ঝুঁকে বলল,
আমিও দোহা যাব। তুমি এরপর কোন দেশে যাবে ?
বাংলাদেশ।
ও বলল, আমি করাচি যাব।
বুঝলাম ও পাকিস্তানের মেয়ে।
ওর সাথে কথা বলতে গিয়ে মনে হলো আমার একাকীত্ব কেটে যাচ্ছে। মেয়েটা যে দেশেরই হোক আমি ভালো একজন সঙ্গী পেয়েছি। এই আনন্দই মনকে দোলা দিচ্ছে। মেয়েটা আরও কাছে এগিয়ে এলো। খুব উৎসাহের সাথে বলল, আমি দুবছর পর দেশে যাচ্ছি। তাই ভীষণ একসাইটেড। সবাই আমার অপেক্ষায় আছে। ওর কথার ধরন খুব ভালো লাগছে। মনে হচ্ছে ও যেন পৌঁছে গেছে ওর মা বাবার কাছে। আমি ওর কাছে ওর নামটা জানতে চাইলাম। ও শুধু নাম না। অনেক কথাই বলল। ওর নাম Sanza Fahim একজন ডাক্তার। ভাইবোনদের মধ্যে ও সবার বড়। বাবামার ইচ্ছেতেই ডাক্তার হয়েছে। এম . বি . বি . এস করেছে করাচিতে। তারপর এ দেশে পড়াশুনা করেছে। কলম্বাসে থাকে। এখানের কোন একটা Medical center এ যুক্ত আছে। আসলে ও এখানে বেশিদিন থাকবে না। অন্য স্স্টেটে চলে যাবে। Medical center এর নামটা আমি ভুলে গেছি।
আমি অনেকক্ষণ ধরেই ওর অনামিকায় একটা চমৎকার আংটির উপস্থিতি লক্ষ করছিলাম। সৌজন্যে বাঁধছিলে বলে কিছু জিজ্ঞাসা করতে পারছিলাম না। তবে ততক্ষণে সানজা আমাকে আপন ভাবতে শুরু করেছে। গল্পের এক পর্যায়ে ও নিজেই আংটিটা দেখিয়ে বলল,
এটা আমার দাদির আংটি। সব সময়ই পরে থাকি। আমার মনে হয় আমার দাদি আমাকে ছুঁয়ে আছে। আংটিটা সত্যিই সুন্দর। আমি সাহস পেয়ে বললাম,
আমি ভেবেছিলাম এটা বিশেষ কারো দেওয়া আংটি।
ও একটু লজ্জা পেলো। আমি আবার বললাম লজ্জার কিছু নেই। বিশেষ কেউ তো থাকতেই পারে! তুমি বিয়ে কর নি ?
বিয়ের কথায় আরও একটু লজ্জা পেলো। মৃদু আলোতেও মনে হলো ওর গালে আবির ছড়িয়েছে। খুব উৎসাহের সাথে বলল, বিয়ে করি নি। তবে এবার করব। আমার বাবাও বিয়ের কথা ভাবছে। আমি নিজেও এর গুরুত্ব অনুভব করছি। তুমি কি এ জন্যই দেশে যাচ্ছ ? আমি মজা করে কথাটা বললাম। ও সঙ্গে সঙ্গেই উত্তর দিলো, না! না! আমি অনেকদিন দেশে যাই না। সে কারণেই যাচ্ছি। তবে বিয়ের কথাটাও ভাবছি। আসলে ডাক্তার ছেলে পাচ্ছি না। তাই কাজটাও এগোচ্ছে না।
আমার হাসি পেলো। কারণ আমাদের দেশেও এ রকম কথা শুনেছি। তাই ওর দিকে তাকিয়েই বললাম, ছেলেকে যে ডাক্তার হতে তা ভাবছ কেন! ভালো সঙ্গী যে কোন পেশারই হতে পারে! যে তোমাকে ভালো বুঝবে, যে তোমাকে ভালোবাসবে তাকেই জীবনসঙ্গী বানাবে!
আবার লাজুক হাসলো সানজা।
আমি ওর দিকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম। বিয়ের কথায় মেয়েটা কেমন আবেগ প্রবণ হয়ে উঠেছে!
তোমার কোন বয়ফ্রেন্ড নেই? আমি প্রশ্নটা করে ওর দিকে আবার তাকালাম। এবার ও জোরে হাসলো। হাসতে হাসতেই কথাটার উত্তর দিলো। আমি পড়াশুনা নিয়ে এতোটাই ব্যস্ত ছিলাম যে বয়ফ্রেন্ডের কথা মাথায় আসে নি!
আমি কথার ফাঁকে ফাঁকে ওর আংটিটার দিকে তাকাচ্ছিলাম। আংটিটা খুব দৃষ্টিনন্দন তা আগেই বলেছি। তবে শুধু এ কারণে না আংটিটার সাথে জড়িয়ে আছে ভালোবাসার সম্পর্ক! দাদির স্মৃতিকে কী চমতকারভাবে আঁকড়ে ধরে আছে! আংটিটাকেই মনে করছে দাদির আদরের আর ভালোবাসার ছোঁয়া। কত সহজে আমার মতো স্বল্প পরিচিত আর অসম বয়সী মানুষের কাছে কথাটা বলল উচ্ছ্বসিত গলায়।
কেন জানি না ওই আংটির দিকে তাকিয়ে আমার নিজের কথা মনে পড়লো! শৈশব এসে দাঁড়ালো আমার পাশ ঘেঁষে! আমার দাদাজান অনেক আগেই মারা গিয়েছিলেন বলে তাঁকে আমি পাই নি। কিন্তু দাদিকে পেয়েছিলাম। ছেলেবেলা কেটেছে দাদির সাহচর্যে। মা সংসার নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন। আমাদের দেখাশোনার দায়িত্ব তাই দাদি নিয়েছিলেন। মার পাশে ঘুমোনোর কথা মনে পড়ে না। ওটা ছিলো ছোটদের দখলে। দাদির বিছানা মানে আমাদের বিছানা। তখন ইলেকট্রিসিটি ছিলো না। আমার মনে আছে ঘুম ভাঙলেই দেখতাম দাদি আমাদের হাতপাখা দিয়ে বাতাস করছেন।
সেই ছেলেবেলায় এটাকে স্বাভাবিক মনে হলেও বড় হয়ে মনে প্রশ্ন জেগেছে দাদি কি সারারাতই জেগে থাকতেন! হ্যাঁ,
উত্তর পেয়েছি! সারারাত না হলেও অনেকটা রাত জেগে পার করতেন আমাদেরই জন্য! কখনও বিরক্ত হতেন বলে মনে পড়ে না! যখন এ সব কথা বুঝতে শিখেছি তখন আর করার কিছু ছিলো না! কারণ ততদিনে দাদি আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন অন্য ভুবনে। এখনও মনে তীব্র ইচ্ছে জাগে দাদিকে যদি আবার ফিরে পেতাম! না, যা হবার না তা ভেবে লাভ নেই ! তবুও এই তীব্র ইচ্ছে মাঝে মাঝেই পীড়া দেয়! একে দমন করা তখন কষ্টকর হয়ে দাঁড়ায়। দাদির ঋণ শোধ করতে পারব না — এ ঋণ শোধ হবারও নয়! তবুও নস্টালজিক হই —- স্মৃতিমেদুর হই ।
আংটিটার দিকে তাকিয়ে নিজেকে আবার অপরাধী মনে হলো। মনে মনে সব সময়ই
দাদিকে উদ্দেশ্য করে বলি,
তুমি ওপারে খুব ভালো থেকো, সুখে থেকো। যা আমরা করতে পারি নি তা যেন আল্লাহ্ তোমার জন্য করেন। ভাবার আর সময় পেলাম না। আমাদের প্লেনে ওঠার সময় হয়ে গেলো। কিন্তু গল্প রয়ে গেলো অসমাপ্ত ! আমি কাউন্টারে গিয়ে আমাদের দুজনার সীট পাশাপাশি করে নিলাম। এরই মধ্যে ও আমাকে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠালো আমি accept করতেই ও আমার পাতায় গেলো। তখনই জানলো আমি লেখালিখি করি। ও অবাক হয়ে আমাকে বলল,
তুমি লেখক!
আমি একটু হাসলাম এ কথায় ।
ও বলল, আমার এর আগে কখনও কোন লেখকের সাথে দেখা হয় নি! কী ধরনের লেখা তুমি লেখ ?
বললাম, সাধারণত উপন্যাস আর ছোট গল্প লিখি।
ওর অবাক দৃষ্টিটা তখনও আমার দিকে নিবদ্ধ ছিলো।
প্লেনে ওঠার জন্য আমরা কিউতে দাঁড়ালাম। ও বলল প্লেন বসে তোমার গল্প শুনব।
শুধু আমার গল্প না, কত্ত গল্প যে করলাম দুজনে! একবার প্লেনটা জোরে দুলে উঠলো। ও আমাকে দুহাতে জড়িয়ে ধরে রাখলো। আসলে মানুষ আপন হতে সময় লাগে না! এটা মনের ব্যাপার! মন যদি চায় তবে অনেক কিছুই করা যায় —- এ কথাটা ওই ছোট্ট মেয়েটা আমাকে আবার বুঝিয়ে দিলো।
নিউইয়র্কে পৌঁছালাম রাত দেড়টার দিকে। আমি হুইলচেয়ারে করে বাইরে এসে দেখি সানজা দাঁড়িয়ে আছে আমার জন্য। আমি আসার পর ও আমার সাথে চলতে শুরু করলো। আবার আমরা আগের মতো একসাথে লাউঞ্জে বসলাম। তবে এখান থেকেই আমরা বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলাম। ঢাকা এসে ওকে ফোন দিলাম। ও বলল,
দোহায় তোমাকে অনেক খুঁজেছি।
আমি জানি ওর আর আমার গন্তব্য এক না। তাই দেখা হবার কথাও না। ওকে বললাম ওহাইও গেলে দেখা হবে।
শুরু করেছিলাম ‘ জীবন বহতা নদী ‘ কথাটা দিয়ে। সত্যিই তো বহতা নদী! বাঁক থেকে বাঁকান্তরে ছুটে চলছে অবিরত!
সেই বাঁকে থাকে কত বিচিত্র কাহিনি! সে সব কাহিনি আমাদের মনে বিচিত্র অনুভূতি সৃষ্টি করে। কোন কোন অনুভূতি সূক্ষ্ম, কোন কোনটা স্থূল। কিন্তু সবটাই জীবনের মূল্যবান প্রাপ্তি। এই যে চলার পথে সানজার সাথে আমার দেখা হলো, ও বন্ধুর মতো আমার দিকে হাত বাড়ালো। আর আমি সে হাতে হাত রাখলাম। মুহূর্তেই আমার একাকীত্ব দূর হলো। মেঘের রাজ্যে আমরা এক হলাম আমাদেরই অজান্তে। কথা দিয়েছি ওহাইও ফিরে গিয়ে দেখা হবে, কথা হবে! তবে সত্যিই কি দেখা হবে! ও চলে যাবে অন্য স্টেটে তবুও ওর সাথে কাটানো স্মৃতিগুলি বুনোফুলের তীব্র আর মিষ্টি গন্ধের মতো আমাকে ছুঁয়ে থাকবে আজীবন। আমি গন্ধটাকে হারিয়ে যেতে দেব না। বুনোফুলের মিষ্টি গন্ধটাকে মনের গভীরে ধরে রাখব।
আপনার মতামত লিখুন :