ড: তানভীর হোসেন ও ড: ইশরাত জাহান এর প্রবাস জীবনের গল্প


ওহাইও সংবাদ প্রকাশের সময় : জানুয়ারি ১২, ২০২৩, ১২:২২ পূর্বাহ্ণ /
ড: তানভীর হোসেন ও ড: ইশরাত জাহান এর প্রবাস জীবনের গল্প

গ্রন্হনা ও উপস্হাপনা : সারওয়ার খান
কলম্বাস ওহাইও এর ওহাইও ষ্টেট ইউনিভার্সিটির মৌলিক গবেষনার দুই বিশিষ্ট গবেষক, বাংলাদেশী বাঙ্গালীদের গর্ব ড: তানভীর হোসেন ও ড: ইশরাত জাহান দম্পতি। তাদের নিজেদের ভাষ্যেই চলুন জেনে নেয়া যাক তাদের সফলতার গল্প।
ড: তানভীর হোসেনের বর্ননায় :
টাঙ্গাইল জেলার ঘাটাইল থানার পাকুটিয়া গ্রামে জন্ম। বাবা: এস এম শাহাদাত হোসেন, মা: আছিয়া বেগম। ৩ ভাই ১ বোনের সবার ছোট আমার জন্ম ১৯৭৭ সালে। বড়ভাই আর বোনের হাত ধরে স্কুল জীবন শুরু, স্মৃতি বিজড়িত পাকুটিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। এরপরে মাধ্যমিক পর্যায়ে ভর্তি হলাম পাকুটিয়া উচ্চ বিদ্যালয় যা আজকের পাকুটিয়া স্কুল এন্ড কলেজ।
এই স্কুল থেকেই এসএসসি ১৯৯২ সালে। আজও স্মৃতিপটে ভেসে উঠে শ্রদ্ধেয় শিক্ষা গুরুদের কথা। শিক্ষা জীবনের বড় পাওয়া বাবাকে প্রধান শিক্ষক হিসাবে। তিনি প্রধান শিক্ষক এবং পরবর্তীতে অধ্যক্ষ হিসাবে ৪০ বছর দায়িত্ব পালন করে অবসরে যান। বর্তমানে বাংলাদেশ মাধ্যমিক শিক্ষক সমিতির কেন্দ্রীয় কমিটিতে উপদেষ্টা হিসাবে দায়িত্বরত আছেন।
ঢাকার সরকারি বিজ্ঞান কলেজ থেকে এইচএসসি ১৯৯৪ সালে। স্কুল জীবন থেকেই দেশের বাইরে পড়াশুনার আগ্রহ জাগে বড় ভাই সাজ্জাদ হোসেনের কারণে। তিনি ১৯৯২ সালে আমেরিকা আসেন উচ্চতর ডিগ্রির জন্য। আমিও সিদ্ধান্ত নেই দেশের বাইরে পড়তে যাওয়ার। মামার সাথে ইন্ডিয়া-বেঙ্গালোরএ বেড়াতে যেয়ে জানতে পারি ওখানে কিভাবে এডমিশন নেয়া যায়। এইচএসসির পর ভর্তি হয়ে যাই বেঙ্গালোর ইউনিভার্সিটি-PES কলেজএ। সেখান থেকে বিএসসি-মাইক্রোবায়োলজি/কেমিস্ট্রি কমপ্লিট করি। বিএসসি পড়াকালীন সময়ে জাপানের কিছু প্রফেসরদের সাথে যোগাযোগ করি এবং আগ্রহ প্রকাশ করি সেখানে রিসার্চ করার। ২০০১ সালে জাপান যাই রিসার্চ স্টুডেন্ট হিসাবে এবং মাস্টার্স ও পিএইচডি করার জন্য জাপান সরকারের মনবুকাগাকুশো স্কলারশিপএর জন্য মনোনীত হই। বিজ্ঞান গবেষণায় জাপানের প্রখ্যাত ইউনিভার্সিটি সুকুবা ইউনিভার্সিটি থেকে ২০০৫ সালে M.Sc. in Applied Microbiology and Biochemistry এবং ২০০৮ সালে PhD in Bioindustrial Sciences অর্জন করি।
২০০৭ সালে পিএইচডি তে অধ্যায়নরত অবস্থায় পারিবারিকভাবে বিয়ে হয় ইশরাত জাহান লুবনার সাথে। ২০০৮ সালে আমাদের প্রথম সন্তান (ছেলে) তানিশ নাবহান হোসেনের জন্ম সুকুবা গাকুইন হসপিটালে। পিএইচডি শেষে রিসার্চ সায়েন্টিস্ট হিসাবে জব শুরু করি ফার্মিট বায়োফার্মা, জাপানে।
আমাদের চাকরি এবং ছেলের বেড়ে উঠা এইসব নিয়ে জাপানে ভালোই চলছিল। ২০১১ সালের প্রথম দিকে বাবা-মা আমেরিকা চলে আসেন বড় ভাইয়ের কাছে এবং আমাকেও আমেরিকায় চলে আসার উৎসাহ দেন। আমিও সব কিছু ভেবে আমেরিকায় আসার পরিকল্পনা করি এবং জবের জন্য চেষ্টা করি। ২০১১ সালে ইউনিভার্সিটি অফ সেন্ট্রাল ফ্লোরিডাতে জয়েন করি এনআইএইচ এর ফেলোশিপ নিয়ে পোস্টডক্টরাল রিসার্চার হিসাবে। ২০১৩ সালে মেয়ে নুমায়রা হোসেনের জন্ম ফ্লোরিডাতে। ২০১৩ সালেই রিসার্চ অ্যাসোসিয়েট হিসাবে জব শুরু করি ওহাইও ইউনিভার্সিটি কলেজ অফ মেডিসিনএ এবং এথেন্স ওহাইও তে মুভ করি। ২০১৭ সালে কলম্বাস আসি Scientist position নিয়ে Nationwide Children Hospital এ। ২০১৯ সাল থেকে OSU, Dept. of  Anesthesiology এ জব শুরু এবং সপরিবারে আপার আর্লিংটনে বসবাস করতে থাকি। ছেলে এবং মেয়ে আপার আর্লিংটন স্কুলের যথাক্রমে মিডল এবং এলিমেন্টারি স্কুলে যাচ্ছে।
বর্তমানে ড: তানভীর যে মৌলিক গবেষনায় নিয়োজিত আছেন, তা তার নিজ বর্ননাতেই জানুন : ” Finding the cellular-based therapies caused by anesthetic drug, toxic and gas poisoning which damage cells, cell death and serious organ dzsfunction. Our target interplay between mitochondrial dznamics and respiratory function. Primary approach is to expose the cellular stressors which can alter mitochondrial motility and metabolic requirements and evoke cellular injury or death. Secondary approach is to develop a treatment strategy which can restore mitochondrial motility and metabolic requirements and protect cellular injury or death. ”
ড: ইশরাত জাহান (লুবনা) তার নিজ বর্ননায় জেনে নেয়া যাক তার প্রবাস জীবনের গল্প:
জন্ম ও বেড়ে ওঠা বরিশাল বিভাগের ঝালকাঠি জেলা শহরে। বাবা ছিলেন জেলা শিক্ষা অফিসার আর মা গৃহিনী (২০০৫ সালে রত্নগর্ভা পদক প্রাপ্ত)। ৭ বোন ২ ভাই এর সবাই উচ্চ শিক্ষিত এবং দেশে বিদেশে চাকুরীরত।
এসএসসি উত্তীর্ন হওয়া ১৯৯২ সালে (ঝালকাঠি সরকারি বালিকা বিদ্যালয়) থেকে, এইচএসসি: ১৯৯৪ সালে (বেগম বদরুন্নেসা কলেজ) থেকে, বিএসসি (অনার্স): ১৯৯৭ সালে (১৯৯৪-৯৫ শিক্ষাবর্ষ) রসায়ন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এবং এমএসসি: ১৯৯৮ সালে, সেশন জটিলতায় রেজাল্ট বের হতে হতে ২০০১।
২০০১ সালেই বেক্সিমকো ফার্মাতে জয়েন করি আর এন্ড ডি রিসার্চ কেমিস্ট হিসাবে। ২০০২ সালে জাপান সরকারের মনবুকাগাকুশো বৃত্তি নিয়ে উচ্চশিক্ষার্থে টোকিও গমন করি। ২০০৬ এ টোকিও তে অবস্থিত ওচানোমিজু ইউনিভার্সিটি থেকে কেমিস্ট্রি তে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন এবং একই সালে জেএসটি ফেলোশিপ নিয়ে পোস্টডক শুরু করি। ২০০৭ সালে জনাব তানভির হোসেন এর সাথে পারিবারিক ভাবে বিয়ে এবং ২০০৮ এ ছেলের জন্ম। ছেলের জন্মের আগে এবং পরে বিরতির পর আবার পোস্টডক করি ইউনিভার্সিটি অব টোকিও তে ২০০৯ থেকে ২০১১ পর্যন্ত। ২০১১ এর শেষের দিকে আমেরিকার ফ্লোরিডা আসি। এরপর ইউনিভার্সিটি অব ফ্লোরিডা থেকে পোস্টডক এর অফার সত্ত্বেও প্রেগন্যান্সি, মেয়ের জন্ম, ওয়াইও তে মুভ এবং ব্যক্তিগত কিছু কারণে চাকরিতে বেশ লম্বা একটা গ্যাপ হয়। ২০১৬ সালে ওহাইও ইউনিভার্সিটিতে আবার নতুন করে রিসার্চ ফেলো হিসাবে পোস্টডক শুরু করি কলেজ অব মেডিসিনএ। এই জবটা আমার জন্য একটা টার্নিং পয়েন্ট ছিল। রিসার্চের ফিল্ড কেমিস্ট্রি থেকে বায়োমেডিকেল সায়েন্সএ শিফট ! শিফ্টের এই চ্যালেঞ্জ আমি গ্রহণ করেছিলাম এবং এনজয় করেছিলাম। টাইপ ১ ডায়বেটিস এর উপর রিসার্চে আমি ভালো কিছু পেপার পাবলিশ করি এবং ২টা পেটেন্ট এর স্বত্ব অর্জন করি।
২০১৯ এ আবারো মুভ করে কলম্বাস আসি এবং সিনিয়র রিসার্চ অ্যাসোসিয়েট হিসাবে জয়েন করি OSU Wexner Medical Center এ।
ওএসইউ তে আমার এখনকার রিসার্চ ফিল্ড হলো ইমিউনোলজি। ইনফ্লেমেশন এবং অটোইমিউন ডিজিজের জন্য কার্যকরী ওষুধ খুঁজে বের করার কাজ করছি। রক্তের একধরণের বিশেষায়িত কোষ টি সেল (T Cell) যা আমাদের শরীরের প্রতিরক্ষার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এই কোষ আমাদের প্যাথোজেন থেকে দীর্ঘমেয়াদি সুরক্ষা দেয় সরাসরি জীবাণুকে বা জীবাণু আক্রান্ত কোষকে আক্রমণ করার মাধ্যমে। জেনেটিক এবং জীবাণুঘটিত কারণে এই টি সেলের স্ট্রাকচারএ পরিবর্তন ঘটতে পারে। সেরকম হলে তখন টি সেল নিজের সুস্থ কোষকেই আক্রমণ করে বসে। সেরকমটা হলে শরীরের যেই অঙ্গ টি সেল দ্বারা আক্রান্তের শিকার, সেটি ক্রমশ দুর্বল হতে হতে অকার্যকর হয়ে পড়ে। এই ধরণের রোগ সমষ্টিগতভাবে অটোইমিউন ডিজিজ নাম পরিচিত। পরিচিত রোগ এর মধ্যে উদাহরণ হলো টাইপ ওয়ান ডায়াবেটিস, গ্রেভ ডিজিজ (থাইরয়েড) রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিজ (গেঁটেবাত), ভিটিলিগো (শ্বেতী), স্কেলেরোডার্মা (চুলকানি), এজমা ইত্যাদি। অটোইমিউন ডিজিজ থেকে সম্পূর্ণ সুস্থ হওয়ার কোনো ওষুধ এখনো আবিষ্কৃত হয়নি। এখন পর্যন্ত চিকিৎসা হলো সিনথেটিক ড্রাগ বা মনোক্লোনাল এন্টিবডি প্রয়োগ করে রোগকে বাড়তে না দেয়া এবং সিম্পটম কমানো।
আমাদের ল্যাবএ আমি মূলত কাজ করি অটোইমিউন ডিজিজ এর জন্য দায়ী টি সেল নিয়ে। কিভাবে এই ডিজিজের উৎপত্তি, শরীরে এর বায়োকেমিক্যাল বিক্রিয়া, ডিজিজ প্রগ্রেস বা মেকানিজম এবং কিভাবে এইরোগ থামিয়ে দেয়া যায় এই নিয়ে আমার গবেষণা। আমাদের অটোইমিউন ডিজিজ মডেল হলো মাল্টিপল স্ক্লেরোসিস নামের ব্রেইনের রোগ। আমি ওষুধ ডিজাইন করি এবং কম্পিউটার সিমুলেশন করে এই কার্যকারিতা সম্পর্কে একটা ধারণা করি। পরের ধাপ হলো জেনেটিক, ফার্মাকোলজিক এবং মেটাবলিক মেথড ব্যবহার করে ট্রানজেনিক ইঁদুর তৈরী করে তাদেরকে রোগে আক্রান্ত করার জন্য টি সেল ইঞ্জেক্ট করি। এরপর কন্ট্রোল পদ্ধতিতে এদের রোগমুক্ত করার জন্য ওষুধ প্রয়োগ করি।
বাবা ও মা দুইজনই গত হয়েছেন। কলম্বাসে মুভ করে আসবার পর এখানকার জীবনযাত্রায় মানিয়ে নিয়ে বেশ ভালই লাগছে।
সবশেষে একটা কথা বলতে চাই-কোনো কারণে যদি গ্যাপ হয় বা থেমে যেতে হয়, সেটাই কিন্তু শেষ নয়। নতুন করে আবার শুরু করা যায়। বয়স যে একটা সংখ্যামাত্র তা আমাদের প্রেসিডেন্ট বাইডেন বুঝিয়ে দিয়েছেন এই ৮১ বছর বয়সেও এরকম গুরুদায়িত্ব পালন করে। আমার আম্মা একটা কথা বলতেন – হাল না ছেড়ে যেকোনো কাজের জন্য চেষ্টা করে যাওয়াই হলো সফলতা! তাই হাল ছেড়োনা বন্ধু বরং…
উদ্দোমী সব বয়সের সকলের জন্যই ড: তানভীর ও ড: ইশরাতের লক্ষ্য স্থির করে সামনে এগিয়ে যাবার গল্প আগামীর প্রেরনা হয়ে উৎসাহ যোগাবে।