রাশিদা কামাল
গভীর আবেগময় দৃষ্টি নিয়ে সমু তাকালো তরুর দিকে। ওর হাতে হাত রেখে মৃদু একটা চাপ দিলো। তরু হাতটা ছাড়িয়ে নিলো না। আগের মতোই মুখ নিচু করে বসে রইলো।
‘ তরু আমার কথার উত্তর দেবে না ? ‘
‘ কোন কথা ? ‘
‘ তুমি জানো কোন কথা! তরু , তোমাকে আমি ভালোবাসি! এই ভালোবাসার পরিণতি দিতে চাই! তুমি আমায় অপেক্ষায় রেখেছ। স্পষ্ট করে কিছুই তো বলছ না! ‘
‘ স্পষ্ট করেই তো বলেছি! ‘
‘ কী বলেছ ? ‘
‘ আমি পিতৃপরিচয়হীন। বলি নি কথাটা ? ‘
‘ আমি পিতৃপরিচয় চাইছি না! তোমাকে চাইছি! দখলদারিতে বিশ্বাসী আমি! ভালোবাসব অথচ কাছে পাব না এটা মানতে রাজি নই আমি! ‘
‘ আমার জীবনের সব কথা তুমি কি জানো সমু ? ‘
‘ বললাম তো জানতে চাই না ! ‘
‘ তবুও যাকে ভালোবাস, যাকে কাছে পেতে চাও তার সব কথা তোমার জানা উচিত। তুমি জানো আমার বাবা নেই। ‘
‘ জানি যুদ্ধে মারা গেছেন! ‘
‘ না , যুদ্ধে মারা যায় নি। আমি আসলে ——-
‘ তুমি আসলে কী ? ‘
একটু কেঁপে উঠলো তরু। সমু তাড়া দিলো।
‘ বলো তুমি কে! ‘
‘ আমি যুদ্ধশিশু। আমার বাবা যুদ্ধে মারা যায় নি! বর্বর পুরুষের লালসা আর কামের শিকার হয়ে মা আমাকে জন্ম দিয়েছে! মা নিজেও জানে না আমি কার সন্তান! ক্যাম্পে মাকে যারা ভোগ করেছে আমার জন্মের পর মা ওদের চেহারা চিন্তা করতো। আমারই তো মনে আছে মা প্রায়ই কী যেন ভাবতো। তখন মাকে খুব ভয় লাগতো! মার কাছে যেতাম না আমি। ‘
‘ ভয় লাগতো কেন ? ‘
‘ মার চেহারাটা অস্বাভাবিক মনে হতো। পরে বড় হয়ে বুঝেছি মা ওই লোকগুলির কথা ভাবতো। কেন জানো ? ‘
‘ কেন ? ‘
‘ মা বুঝতে চাইতো আমি কার সন্তান! কার মতো দেখতে হয়েছি। মা সেই অস্বাভাবিক চোখে আমাকেও দেখতো। আমি জানি না মা মিলটা কেন খুঁজতো!
জানো সমু, মা ছেলেবেলায় আমাকে আকাশের দিকে তাকিয়ে বলতো তারাদের মধ্যে আমার বাবা আছে। আমি তাই বিশ্বাস করে তারাদের মাঝে বাবাকে খুঁজতাম! ‘
‘ বিশ্বাসটা ভাঙ্গলো কী করে ? ‘
‘ বড় হবার পর মা আমাকে সত্যি কথাটা একদিন বলল। ‘
‘ সত্যি কথাটা কী ! ‘
‘ মাকে যুদ্ধের সময় আর্মিক্যাম্পে তুলে নিয়ে গিয়েছিলো। ‘
‘ মাই গড! বলো কী ! ‘
‘ ভয় পেলে! আমি কিন্তু সত্যি কথা বলছি! ‘
‘ তারপর ? ‘
‘ পুরুষ হয়ে তারপর জানতে চাইছ ? যুদ্ধরত পুরুষের সম্ভোগেচ্ছার শিকার ছিলো মা।
কতজনের সম্ভোগেচ্ছা পূরণ করতে হয়েছে মাকে তা মা নিজেও জানে না ! পুরুষের কামলালসার কাছে মার কুমারী জীবনের অবসান ঘটেছিল। তাই মা জানে না আমি কার সম্ভোগের ফসল! ‘
‘ পরিবারের কেউ খবর নেয় নি তোমার মার ? ‘
‘ মা যে বেঁচে আছে তাই তো কেউ জানতো না! সবাই জানতো মাকে মেরে ফেলা হয়েছে । এক সময় মা তার শারীরিক পরিবর্তনের কথা টের পেলো। শুধু মা না, পরিবর্তনটা সবার চোখেই ধরা পড়লো। আর কথাটা ছড়িয়ে পড়লো ক্যাম্পে। এরও কিছুদিন পর মাকে তাড়িয়ে দেওয়া হলো। মার তখন একটাই ভাবনা কোথায় যাবে এ অবস্থায়! কে দেবে আশ্রয়! তাছাড়া বাচ্চাটা জন্মের পরেও তো ওকে দুর্বিষহ জীবন টেনে বেড়াতে হবে ! মার সামনে তখন একটা পথই খোলা! নিজেকে শেষ করে দেওয়া! দুজনের অস্তিত্বই নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। কেউ জানবে না মার এই নিগৃহীত জীবনের করুণ কথা! কিন্তু নিজেকে শেষ করার কথা ভাবতেই মা অনুভব করলো শরীরের ভেতর ঘুমন্ত কেউ যেন জেগে উঠেছে —– যেন বলছে, শেষ কোর না মা! আমাদের এ পরিস্থিতির জন্য তো আমরা দায়ী না! এ মিনতি অনুভব করতেই মা চলতে গিয়েও থেমে গেলো। মার মনে হলো নিজের বাড়িতে ফিরে যাবার কথা। বাবা মা নিশ্চয়ই ওকে ফেলে দেবে না! কিন্তু বাড়ির সামনে যেতেই দেখলো দরজায় তালা ঝুলছে। মার তখন প্রায় জ্ঞান হারাবার অবস্থা। শেষ আশ্রয়ও বিলীন! কিন্তু কিছু একটা তো করতেই হবে! এক বান্ধবীর কথা তখন মনে পড়লো। ওদের বাড়ির কাছেই বান্ধবীদের বাড়ি। বান্ধবী সব শুনে মাকে এক জাগায় পাঠালো। মা যখন ওখানে পৌঁছালো তখন সন্ধে। মহিলা সব শুনে মাকে আশ্রয় দিলো —- অভয় দিলো। মার সেবা করলো। যুদ্ধ তখন শেষ। মহিলা রটিয়ে দিলো আমার বাবা যুদ্ধে মারা গেছেন। মহিলা ছিলো নার্স। মাকেও হাসপাতালে একটা কাজ জোগাড় করে দিলো। এই মহিলাই আমার বেনুখালা। বেনুখালার কাছেই আমার জন্ম —- আমার বেড়ে ওঠা! ‘
‘ তোমার মা কি আর পরিবারের খোঁজ পান নি ? ‘
‘ পেয়েছিলো! তখন মার বাবা মারা গেছেন মার শোকে। নানু মাকে নিতে পারে নি। কারণ মামা চায় নি। এমন কী মা যে বেঁচে আছে এ কথাটাও অস্বীকার করেছিলো। ‘
একটু হাসলো তরু।
‘ মামার দোষ দেই না! সমাজই তো আমাদের গ্রহণ করবে না! মামা তো সমাজেরই অংশ! আমার মাঝে মাঝে কী মনে হয় জানো সমু ? ‘
‘ কী মনে হয় ? ‘
‘ বেনুখালা মানুষ না —- মহামানব। সমাজের ভ্রূকুটি উপেক্ষা করে আমাদেরকে কাছে টেনে নিয়েছে। এই আশ্রয়টুকু না পেলে মা আত্মঘাতী হতো। আত্মীয় , পরিজন, মান, সম্ভ্রম সব হারিয়ে মা পেলো বেনুখালার মতো এক মহিয়সী মানুষকে!
ছোটবেলা থেকে আমার কোন বন্ধু ছিলো না। মার ধারনা ছিলো বন্ধুরা যদি সত্যি কথাটা জেনে যায়! আমাকে স্কুলে পাঠিয়ে মা ভয়ে ভয়ে থাকতো! কেউ কেউ অবশ্য সন্দেহ করতো। বাবার কথা আমার কাছে জানতে চাইতো। আমি বলতাম যুদ্ধে মারা গেছে। আমার কথায় ওরা মুখ টিপে হাসতো! বলতো ,
‘ ঠিক জানো তো! ‘
আমি ওদের হাসির অর্থ বুঝতাম না! মা কথাটা শুনে বলতো ওদের সাথে না মিশতে। আমার ছোটবেলা বড়বেলা এভাবেই কেটেছে! ‘
তরুর চোখে বৃষ্টির ছোঁয়া। কথা আটকে যাচ্ছে কান্নার আবেগে। সমু আবার ওর হাতে হাত রাখলো। চোখের পানি মুছিয়ে দিলো।
‘ কাঁদছ কেন তরু ? ‘
‘ মার কথা ভেবে কাঁদছি। আমি সবসময় কাঁদি আমার দুখিনি মার কথা ভেবে। একটা সত্যি কথা বলবে সমু ? ‘
‘ বলো কী কথা ? ‘
‘ এরপরও কি তুমি তোমার ভালোবাসার পরিণতি চাইবে! ‘
‘ তোমার কী মনে হয় ? ‘
অন্ধকার মিশেছে বিকেলের আলোয়। পাখিরা কুলায় ফিরছে। নরম আলো ছুঁয়ে আছে ওদের। সমু এবার তরুর হাতটা ছেড়ে দুহাতে ওকে কাছে টেনে নিলো। তরুর চোখে চোখ রাখলো। গাঢ় গলায় বলল,
‘ চোখের নেশা বা শরীরের নেশায় ভালোবাসা হয় না তরু! ভালোবাসার শেকড় থাকতে হয়! আর সে শেকড় গ্রথিত থাকে বুকের গভীরে! আমার সে শেকড়টা অনেক দূর ছড়িয়েছে।
সেটা উপড়ে ফেলা সহজ নয় —-
সম্ভবও নয়! তাছাড়া একটা কথা মনে রেখ! আমরা এ যুগের মানুষ! সমাজের ভ্রূকুটিকে ভয় পাব কেন! তরু এক অর্থে তোমরাও তো যোদ্ধা! এ যুদ্ধ বন্দুকের নয় —- এ যুদ্ধ জীবনের! আমি তোমার পরিচয় গোপন করে নয়, প্রকাশ করেই তোমাকে আমার জীবনে গ্রহণ করব। আমার ধারনা আমার মতো অনেকেই তোমাকে আমার মতো করেই ভাববে। কেন নিজেকে ছোট ভাবছ! কেন মাকে ছোট করছ! এ দেশ, এ দেশের মানুষ তোমাদের কাছে ঋণী! কিছুটা হলেও আমাকে এ ঋণ শোধ করার সুযোগ দাও! ‘
তরুর মনের কালো ছায়াটা সরে যাচ্ছে। রঙধনুর আলো ঠিকরোচ্ছে সেখানে।
‘ তরু , আমার মনে হাজার পাখির ভিড়। ওদেরকে আমি উড়িয়ে দিতে চাই না ! তোমার কাছে এলে বুনোফুলের একটা মিষ্টি গন্ধ ছুঁয়ে যায় আমাকে। তাকেও বুকের ভেতর ধরে রাখতে চাই! হৃদপিণ্ডের মাঝে মিশে যাওয়া এসব অনুষঙ্গ তো তোমাকেই খোঁজে তরু! তাই আমি আমার ভালোবাসার পরিণতি খুঁজি —– চাই দখলদারি। ‘তরুর চোখ আবারও ভিজে উঠেছে। ও ওর হাতটা বাড়িয়ে দিলো সমুর দিকে।
আপনার মতামত লিখুন :