ফিরে দেখা


ওহাইও সংবাদ প্রকাশের সময় : জানুয়ারি ১১, ২০২৩, ১১:৪৬ অপরাহ্ণ /
ফিরে দেখা

আসমা -উল-হুসনা

আমি কিছুক্ষণ পরের একটা মিটিং এর জন্য প্রিপারেশন নিচ্ছিলাম। হঠাৎ বাসা থেকে ফোন-আমার মা নাকি বাসায় এসেছে, আমার সাথে দেখা করতে চায়। কিছুই বুঝলাম না কিছুক্ষণ আগেইতো আম্মার সাথে কথা হলো, তিনি রংপুরে ভালোই আছেন। আমাকে বেড়িয়ে আসতে বললেন। আমি অবাক হয়ে ফুপুকে বললাম কি যা তা বলছ? আম্মার সাথে এইমাত্র কথা হলো – সেতো রংপুরে, বাসায় আসলো কিভাবে?
– তোমার আম্মার কথা বলি নাই, বলেছি তোমার মার কথা মানে তোমার আপন মা।
– হ্ঠাৎ করে কেমন যেন লাগছিল, মা মানে আমার জন্মদাত্রী মা! যাকে আমি চিনি না, চেহারা দেখি নাই কোনদিন মা বলে ডাকিনি। যিনি কোনদিন আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরেন নি। আমাকে একবার চোখের দেখাও দেখতে আসেন নি। তিনি এসেছেন আমার বাসায়?

কিছুক্ষণের জন্য কেমন হতবুদ্ধি হয়ে গেলাম। বুঝে উঠতে পারছিলাম না আমার কি করা উচিৎ। অথচ এই দিনটার জন্য কতদিন, কতমাস, কতবছর আমি অপেক্ষায় ছিলাম!
ছোটবেলাতে যখন থেকে বুঝতে শিখেছি তখন থেকেই জানি আমার মা আমাকে ছয়মাস বয়সেই ফেলে চলে গিয়েছেন। আর কোনদিন খোঁজও নেয়নি। আর আমার বাবা, মা চলে যাবার দের বছর পরেই বিয়ে করেছেন। সেই ঘরে আমার দুই ভাইও আছে। তাদেরকে নিয়ে বাবা অন্য শহরে যেখানে তিনি চাকুরী করেন সেখানে থাকতেন। আর আমি থাকতাম দাদি আর ফুফুর কাছে। তারা আমাকে খুব ভালোবাসতেন কিন্তু কেউ আমাকে কিছু না বললেও খুব ছোটবেলা থেকেই বুঝতাম ঐ বাড়িতে মার কথা বলা নিষেধ।

বাবাকে খুব বেশি কাছে পাইনি, তিনি রাশভারী লোক ছিলেন। বাসায় আসতেন কয়েকদিন পরপর তাও দিনের বেলা থাকতেন না। বাবার প্রতি কেমন যেন ভয় কাজ করত। বাবা বাসায় আসলে আমি সবসময় দাদি বা ফুপুর পিছনে লুকিয়ে থাকতাম। বাবাও বেশি কথা বলতেন না- কেমন আছ? পড়াশুনা কেমন চলছে? কিছু লাগবে কিনা? এই সব কথা বলার পর তিনি আর কথা খুঁজে পেতেন না, আমিও হ্যা না এর মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকতাম। মাঝেমধ্যে আমার সৎ মা যাকে আমি আম্মা বলেই ডাকতাম ও দুইভাইও আসত। আমি দেখতাম আম্মা তার দুই ছেলেকে কিভাবে আদর করত, খাবার খাইয়ে দিত, গোছল করিয়ে দিত, সাথে করে নিয়ে ঘুমাত। আর ভাইয়েরাও সারাদিনে যা করত তার সব গল্প গুটুর গুটুর করে আম্মাকে বলত। আমারও খুব ইচ্ছে করত আম্মার গলা জড়িয়ে ধরে ওভাবে গল্প করতে। কিন্তু তিনি আমাকে ওভাবে কাছেই ডাকেননি আর আমারো সব জড়তা ভেংগে তার কাছে যাওয়া হয়নি। শুধু চাতক পাখির মত তৃষ্ণার্ত হয়ে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখতাম কিন্তু ভাই দুইটার সাথে কিভাবে কিভাবে যেন খুব বন্ধুত্ব হয়ে গেল। ওদেরকে আমি খুব ভালবেসে ফেললাম ।

এত সবকিছুর মাঝেও কোন এক আজানা কারনে সবসময় চিন্তা করতাম একদিন মা ফিরে আসবে, আমাকে বুকে জড়িয়ে ঘুম পারাবে, আদর করে খাইয়ে দিবে, আমার ছোট বড় আব্দারগুলো পুরণ করবে, আমার সাথে অনেক গল্প করবে। আমার পরিচিত সব বাচ্চাদের মা যেমন করে। আমার আম্মা যেমন করে আমার ভাইদের সাথে। যদিও আমার ফুফু আমাকে মায়ের মতই আগলে রাখতেন তবুও আমি আমার সমস্ত কথা মনে মনে মার সাথে বলতাম আর ভাবতাম মা যখন ফিরবে তখন সব করব।

আমি যখন ক্লাস ফোরে তখন ফুফুর বিয়ে হয়ে যাওয়ায় বাবা আমাকে নিয়ে যান তার কাছে। এমনেতেই সবার কাছে শুনে এসেছি সৎ মা কখনো আপন হয় না, তার উপর উনি কখনো আপন করার চেষ্টাও করেননি। আমি সবসময়ই এক ধরনের ভয়ে ভয়ে থাকতাম। তাই উনি অখুশি হন বা রাগ করেন এমন কোন কাজ আমি কখনই করতাম না এমনকি নিজ হাতে নিজের খাবারও নিতাম না। তাই অনেক সময় স্কুল থেকে ফিরে খুব ক্ষুদার্থ থাকলেও অপেক্ষা করতাম কখন তিনি খাবার দিবেন। অনেক সময় তিনি ঘুমিয়ে থাকতেন আর আমি ক্ষুদার্থ অবাস্থায় পানির পর পানি খেয়ে যেতাম তাও তার ঘুম ভাংগাতাম না। মাঝে মাঝে ক্ষুধায় আমার কান্না পেয়ে যেত তখন আমি আমার মার কথা ভাবতাম।

মনে মনে চিন্তা করতাম মার কি আমার কথা মনে হয় না? কেন মা আসে না? মনে হত হয়ত এ বাড়ি থেকে নিষেধ করা ছিল কিন্ত তিনিতো স্কুলে আসতে পারেন। এসব ভাবতাম আর নিজেকে বুঝ দিতাম কিন্তু আমার মা, খালা, মামার কেউই কোনদিন আসেননি। যখন আমার ভাইয়েরা অসুস্থ হত তখন কত ফল, তাদের জন্য তাদের পছন্দমত খাবার দেওয়া হত। আম্মা আব্বা কত যত্ন নিতেন, প্রায় সারারাত জেগে থেকে সেবা করতেন। আমিও অনেক সেবা করতাম। আমি অসুস্থ হলে বাবা ওষুধ ও ফল আনলেও যেন কেটে দেবার মতো কেঊ ছিল না। সাধারন খাবার খেতে ইচ্ছে না করলে না খেয়েই থাকতে হত। আব্বা মাঝে মাঝে রাতে চেক করে যেতেন। মনে হত আম্মা যেন বিরক্ত হতেন। আর আমি যেন লজ্জায় কুকড়ে যেতাম আর তখন মার কথা ভাবতাম যে মা ফেরলে তিনি কি কি করবেন আমার এই অবস্থায়।

এই বাড়িতে আমি দুই বছর ছিলাম কিন্তু আমার মনে হচ্ছিল আমি হয়তো ক্ষুধার কষ্টেই মারা যাব! একেতো সংকোচ কাটিয়ে কোনদিন খাবার নিতে পারতাম না তার মধ্যে আমাকে ঘরের কাজ করতে হত। কাপড় ধোঁয়া, ঘর গুছানো, ভাইদের যত্ন নেওয়া যদিও ভাইদেরকে আমার ভালোই লাগত কিন্তু আম্মা হয়তো আমার দূর্বলতা বুঝতেন তাই তাদের সব কাজগুলোও আমাকে দিয়েই করাতেন। বাবা সারাদিন বাসায় থাকতেন না আর রাতে এলেও হয়ত তিনি কিছু বুঝতেন না বা বুঝতে চাইতেন না। আমিও কখনো কোনদিন আম্মার কথার বিপক্ষে যেতাম না কিন্তু আমার মনে হচ্ছিল এভাবে থাকতে থাকতে আমি হয়ত মরেই যাব। তাই সেবার যখন গ্রামের এক চাচা বেড়াতে এসেছিল তখন তাকে দিয়ে দাদিকে একটা চিঠি পাঠিয়েছিলাম। লিখেছিলাম – এখানে থাকলে আমি মরেই যাব, বাচাঁতে চাইলে এখান থেকে নিয়ে যাও।

তারপর কি হয়েছিল আমি জানি না কিন্তু দাদি আমাকে নেবার ব্যবস্থা করেছিলেন এবং পরে বাবা আমাকে একটি আবাসিক স্কুলে ভর্তি করে দেন ক্লাস সিক্স এ । তখন থেকে মাস্টার্স পাশ করা পর্যন্ত আমি হোস্টেলে থেকেই পড়াশুনা করেছি, চাইলে যে কেউ আমাকে দেখতে আসতে পারত। আমিও গভীর আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করতাম আমার মায়ের জন্য। কেননা আমার ধারণা ছিল হয়ত বাবা বা দাদি আমার মাকে আমার কাছে আসতে দেয় না কিন্তু সে ধারনা সময়ের সাথে পরিবর্তিত হয়ে আমার সমস্ত আগ্রহ শেষ হয়ে গেল। বুঝেছিলাম তিনি চাইলে আমার সাথে দেখা করতে পারতেন কিন্তু তিনি কখনো চাননি। শেষ আশা ছিল হয়ত আমার বিয়ের সময় তিনি আসবেন, তাই অচেনা কোন বয়স্ক মহিলাকে দেখলে আগ্রহ ভরে দেখছিলাম। আমার ফুফু হয়ত বুঝছিলেন আমার মনের কথা তাই একসময় বললেন তোমার মা আসেন নি। তাই এইসব নিয়ে ভেবে সময় নষ্ট না করে নিজের ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাব।

আমার ফুফুর কোন সন্তান না হওয়ায় তার বিয়ের এগার বছর পর তার স্বামী তাকে ডিভোর্স দিয়েছিলেন তাই আমার নতুন সংসারে ফুফুকে নিয়ে এসেছিলাম। উনিও মায়ের মত করে সব কিছু আগলে রাখতেন আমিও আমার আশ্রয় খুঁজে পেতাম। এরমধ্যে আম্মার সাথে সম্পর্কটা বেশ সহজ হয়েছে ভাইদের কারনেই হয়ত। আমি পড়াশুনা শেষ করে চাকুরিতে ঢুকিছি, বাবাও কোনকারণে চাকরি হারানোর কারনে আমি আমার ভাইদের পড়াশুনা চালিয়েছি। এখন আম্মা আমাকে নিজের মেয়ের মতই দেখেন। আমিও মেনে নিয়েছি যদিও অতীতের কষ্টগুলো মাঝে মধ্যেই আমার চোখে জ্বালা ধরায়। মাঝেমধ্যেই মনে হয় আমার ছোটবেলাটা আরেকটু ভাল কাটলে কার এমন ক্ষতি হত?
আমারও এক ছেলে হয়েছে তাকে আমি সব আদর ঢেলে দেওয়ার চেষ্টা করি যা আমি পাইনি। নামকরাএক প্রতিঠানে ভালো পজিশনে কাজ করি। স্বামী, সন্তান নিয়ে সুন্দর ভাবে সংসার চলছে। ভালোই আছি কিন্তু এখন কেন তিনি এসেছেন?

যখন আমি অসহায় ছিলাম, যখন আমি সবসময় অপেক্ষা করতাম তার জন্য, যখন তাকে আমার খুব প্রয়োজন ছিল তখন তিনি আসেন নি। এখন কেন? একবার মনে হলো বাসায় চলে যাই তাকে প্রশ্ন করি, কেন তিনি এমন করেছেন আমার সাথে? আমার কথা কি তার একবারো মনে হয়নি? কিন্তু পরক্ষণেই মনে হল যে মানুষ আমার সমস্ত আশা, অপেক্ষা, অসহায় অবস্থায় দুরে ছিল তার জন্য আমার কোন সময় নাই।
আমি ফুফুকে বললাম “যে এসেছে তাকে বল আমার কোন মা নেই একজন আম্মা আছেন যে এখন রংপুরে আছে আর একজন ফুফু আছে। আমি আর কাউকে চিনি না” বলে ফোন রেখে দিলাম। আমার চোখ জ্বালা করছিল, আমি বাথরুম এ গিয়ে ভাল করে মুখ ধুয়ে নিলাম,, লম্বা করে শ্বাস নিয়ে মিটিং এ চলে গেলাম। আমি আর পিছন ফিরে তাকাব না।