আমেরিকায় আমাদের নতুন প্রজন্ম


ওহাইও সংবাদ প্রকাশের সময় : জানুয়ারি ১১, ২০২৩, ১০:৩২ অপরাহ্ণ /
আমেরিকায় আমাদের নতুন প্রজন্ম

মিজান রহমান, নিউইয়র্ক
ধারাবাহিক-১০৬
এই সংখ্যায় এবং পরবর্তী কয়েকটি সংখ্যায় আমাদের বাংলাদেশী অভিবাসী বা ইমিগ্রান্টদের এদেশে আগমনের ইতিহাস, গত তিন যুগের কিছু বেশী সময় ধরে তাদের এদেশে আগমনের জোয়ার এবং তাদের ঘরে জন্ম নেয়া নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের জীবনযাত্রার কিছু কিছু ভালো-মন্দ বিষয় নিয়ে আলোচনা করব। বিশেষত বাংলাদেশীরা তাদের অতি আবেগ-প্রবণতা, নিজেদের মধ্যে বিভাজন এবং স্বদেশের রাজনীতির যে ধারা নিজ জন্মভূমি থেকে এদেশেও লালন করে যাচ্ছে তার ফলাফল কি দাঁড়াচ্ছে তার ওপর আলোকপাত করার চেষ্টা থাকবে। সেই সাথে এদেশে তাদের সংস্কৃতি ও সাহিত্য (যেমন বাংলা ভাষায় লেখালেখি, পত্র-পত্রিকা প্রকাশ, লাগাতার অনুষ্ঠানাদি) ইত্যাদির প্রতি অতি-গুরুত্ব আরোপের ফলাফল, এসবের দীর্ঘমেয়াদি প্রাপ্তি এবং অপ্রাপ্তি কী দাঁড়াতে পারে তার সম্ভাবনার ওপর দৃষ্টি নিবন্ধেরও ইচ্ছা রইলো।

যদিও অধুনা বাংলাদেশী-আমেরিকান বলতে মূলত বাংলাদেশ থেকে এদেশে আসা বাংলাদেশের পাসপোর্টধারী ইমিগ্র্যান্ট বাঙালিদের এবং এদেশে তাদের ঘরে জন্ম নেয়া নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েদেরই বোঝায়। যাদের আগমন খুব স্বল্প সংখ্যায় ৭০ দশকে, কিছু কিছু ফার্মাসিস্ট ও ডাক্তারসহ অন্যান্য পদের সুযোগ নিয়ে শুরু হয়ে ৮০ দশকের শেষের দিকে ছাত্র ভিসাসহ আরো অনেক ক্যাটাগরিতে বর্ধিতহারে তাদের আগমন ঘটে। পরবর্তীতে ৯০ দশকের বিভিন্ন ইউ. এস. মাইগ্রেশন প্রোগ্রাম, যেমন ও. পি-ওয়ান, ডি. ভি-ওয়ান প্রোগ্রাম চালু হওয়ায় অধিক সংখ্যক বাংলাদেশীর এদেশে আগমন ঘটতে থাকে। ২০০০ সালের পরে এই সংখ্যা বহুগুণে বেড়ে যায়, বিশেষত আই. টি. সহ অন্যান্য টেক সেক্টর, মেডিকেল বা স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে, ছাত্র ভিসায়, শিক্ষা-ক্ষেত্রে এবং পারিবারিক ডিপেন্ডেড বা আত্মীয়তার সূত্র ধরে। একই সাথে এদেশে আমাদের সন্তান জন্মহারও অনেক গুণে বেড়ে যায়। গত এক বা দেড় যুগ ধরে এদেশে জন্ম নেয়া ছেলেমেয়েরা, তাদের ইমিগ্রান্ট বাবা-মাকে দাদা-দাদি, নানা-নানি বানিয়ে জনসংখ্যাকে আরো বাড়িয়ে দিয়েছে।

কিন্তু প্রথম যে বাঙালি যারা বাংলাদেশী-কলাম্বাস হয়ে এদেশে আসেন, তাদের গুটি কয়েক সর্বপ্রথম এদেশে আসেন ১৮৮৭ সাথে তৎকালীন অবিভক্ত বাংলা, আসাম এবং ত্রিপুরা রাজ্য থেকে। পরবর্তীতে, বিংশ শতাব্দীর একেবারে শুরুর দিকে, ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের পর পর শ’দুয়েক বাঙালি এদেশে আসেন। সেই অভিবাসীদের মধ্যে হিন্দু ও মুসলিম উভয় ধরণের মানুষ ছিল। তাদের অনেকে পশ্চিম উপকূলে, যেমন ক্যালিফোর্নিয়ার সানফ্রান্সিসকো, ওরেগন ও ওয়াশিংটন স্টেটে বসতি স্থাপন করে। সেই সাথে নিউ অর্লিন্স, নিউইয়র্কেও। সেই প্রথমদিকের বাঙালিদের কেউ বণিক হিসেবে, কেউ জাহাজের খালাসি হিসেবে বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে আমেরিকায় আসে। অনেকেই তখন নিউইয়র্ক ও সানফ্রান্সিসকোর বন্দরে নোঙ্গর করা জাহাজ থেকে সমুদ্রে ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং সাঁতার কেটে তীরে উঠে উধাও হয়। আমেরিকার তৎকালীন বিভ্রান্তিমূলক আইন অনুযায়ী সেই সব বাঙালিদের এদেশের শ্বেতাঙ্গ নারীদের বিয়ে করা নিষিদ্ধ ছিলো। ফলে তাদের বেশিরভাগই এদেশে মেক্সিকান, আফ্রিকান-আমেরিকান বা মিশ্র বর্ণের মহিলাদের বিয়ে করেছিল।

বর্তমানে এদেশে বাঙালি বা বাংলাদেশী অধ্যুষিত জনগোষ্ঠী- যারা জাতিগতভাবে শুধুমাত্র বাংলাদেশী-আমেরিকান হিসেবে চিহ্নিত হয়, ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিদের বাদ দিয়ে, তাদের সংখ্যা, ইউ. এস. সেনসান ব্যুরো ২০২০ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী ৩ লাখের কিছু বেশী। তবে অবৈধভাবে অবস্থানরত বা টেম্পোরারি ভিসার অধিকারীরা এর অন্তর্ভূক্ত নয়। যদিও বাংলাদেশী-আমেরিকানরা এদেশে সংখ্যায় একটি ক্ষুদ্র সম্প্রদায় হিসেবে চিহ্নিত কিন্তু তারা এদেশের প্রায় সর্বত্রই ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসবাস করে। তবে কয়েকটি স্টেটে এবং বড় কিছু শহরে তাদের ঘনবসতি চোখে পড়ার মত। তার মধ্যে নিউইয়র্ক স্টেটেই সর্বোচ্চ সংখ্যায়। আবার নিউইয়র্ক সিটির কুইন্স বরোতেই সবচেয়ে বেশী সংখ্যায় বাংলাদেশীর বসবাস। তারপরে যথাক্রমে ব্রুকলীন, ব্রংক্স, ম্যানহ্যাটান এবং স্ট্যাটেন আইল্যান্ডে। নিউইয়র্কের লং আইল্যান্ড সহ অন্যান্য স্থানেও তাদের বসবাস। আগের সংখ্যায় উল্লেখ করেছিলাম যে বাংলাদেশীদের বসবাসের ক্ষেত্রে প্রধান স্টেট হিসেবে নিউইয়র্ক এবং তারপরে প্রধান পাঁচটি স্টেটের মধ্যে যথাক্রমে ক্যালিফোর্নিয়া, নিউ জার্সি, মিশিগান এবং টেক্সাস। আর বড় শহরগুলোর মধ্যে প্রধান পাঁচটি হলো নিউ ইয়র্ক সিটি, ডেট্রয়েট, লস এঞ্জেলেস, ফিলাডেলফিয়া ও বৃহত্তর ওয়াশিংটন ডিসি।

প্রবাসে বড় কোন শহরে ঘনবসতিপূর্ণ হয়ে বসবাস করার অনেক সুবিধা এবং অসুবিধা দুটোই রয়েছে। সুবিধাগুলোর মধ্যে প্রধানত নিজস্ব ভাষা, সংস্কৃতি, ধর্মীয় বিশ্বাস ও পারিবারিক মূল্যবোধ এবং খাদ্যাভাস ইত্যাদি ধারণ ও লালন-পালন করাটা ইমিগ্রান্ট পরিবারগুলোর জন্য অনেকটা সহজতর হয়। আবার অসুবিধাগুলোা মধ্যে প্রধান একটি হলো অতিমাত্রায় নিজস্ব দেশীয় ভাসবাস, রীতি-নীতি, স্বদেশের অনুকরণে প্রায় সবকিছুই করার অতিমাত্রায় চেষ্টা করা বা ধারণ করে চলা। এমনকি অনেক ক্ষেত্রে বাস্তবটাকে উপেক্ষা করে, নিজেদের ছেলেমেয়েদের এদেশে তাদের জন্মগত অধিকারগুলোকে উপেক্ষা করে, এদেশের সামাজিক রীতি-নীতিকে অগ্রাহ্য এবং অসম্মান করে নিজেদের খামখেয়ালিভাবে চলার চেষ্টা চালানো।

আমেরিকার বাংলাদেশী প্রবাসীরা বাংলাদেশের জন্য রেমিটেন্স পাঠানোর একটি গুরুত্বপূর্ণ উৎস। নন-রেসিডেন্স বাংলাদেশী (এন. আর. বি.) হিসেবে আমেরিকার প্রবাসী বাংলাদেশীরাই মধ্যপ্রাচ্যে প্রবাসী বাংলাদেশীদের পরপরই সর্বোচ্চ রেমিটেন্স বাংলাদেশে পাঠায়। অন্য দেশ থেকে আসা প্রবাসীদের মত বাংলাদেশী প্রবাসীরা এই আমেরিকার সমস্ত সুযোগ-সুবিধা ভোগ করে। সেই অভিজ্ঞতাগুলো তাদেরকে নিজ দেশের উন্নয়নে অবদান রাখার বিভিন্ন উপায় খুঁজতে অনুপ্রাণিত করে। তারা তাদের এখানকার অভিজ্ঞতার আলোকে বিভিন্ন উপায়ে তাদের স্বদেশকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসে। যেমন, (১) অ্যাডভোকেসি এবং মানবপ্রীতি বা মানবসেবা: (২) রেমিটেন্স পাঠানো, বিনিয়োগ করা এবং উদ্যোক্তা হিসেবে নতুন নতুন ব্যবসা-বাণিজ্যে আগ্রহী হওয়া; (৩) পর্যটন শিল্প এবং দাতব্য বা স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে নিজেদের নিয়োজিত করা।

কিছু প্রবাসী ডায়াম্পোরা অ্যাডভোকেসি গ্রুপে যোগদান করে। অন্য প্রবাসীরা চেষ্টা করে কিছু কিছু জনহিতৈষী কর্মকান্ডে জড়িত থাকার মাধ্যমে স্বদেশের উন্নয়নকে তরান্বিত করতে। অনেকে এদেশে অর্থ সংগ্রহ (ফান্ডরেইজিং) করে স্বদেশে শিক্ষা ব্যবস্থা, সামাজিক-উন্নয়ন এবং পরিবেশগত উন্নয়নের জন্য নিজেদের সময়, মেধা, অর্থ ব্যয় বা স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে স্বদেশে অবস্থিত সমজাতীয় সংস্থাগুলির সাথে কাজ করে। তাদের অনেকেই এদেশে জন্মগ্রহণ করা আমাদের নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের প্রতিবছর বাংলাদেশে নিয়ে যায় যাতে করে তারা তাদের বাপদাদার শেকড়ের সাথে যোগসূত্র রক্ষা করতে পারে বা এ ব্যাপারে তাদের আগ্রহ জন্মায়।
তবে এতসব ইতিবাচক দিক থাকা সত্ত্বেও এদেশে প্রবাসীরা অনেকেই কিভাবে বিভিন্ন অনুৎপাদনশীল বা অফলপ্রসূ কিছু কর্মকান্ডে নিজেদের অতিমাত্রায় নিয়োজিত রেখে, কিভাবে তাদের মূল্যবান সময়, অর্থ, জ্ঞান এবং মেধার অপচয় করে, অথবা কমিউনিটি হিসেবে নিজেদের অগ্রগতির পথে নিজেরাই অনেকটা বাধা হয়ে দাঁড়ায়, এই বিষয়গুলোর ওপর পরবর্তী সংখ্যায় কিছুটা আলোকপাত করার ইচ্ছা রইলো।

সূত্র: সাপ্তাহিক বাঙালী, নিউ ইয়র্ক, সেপ্টেম্বর ১৭, ২০২২