আসমা-উল-হুসনা
১.
-আপা আপা শুনেছো, রাজিব ভাইয়া মারা গেছে?
– কোন রাজিব? কিভাবে মারা গেল ?
– আজিজ কো-অপারেটিভ এর রাজিব ভাইয়া। নিজেদের ছাদ থেকে অন্য ছাদে লাফ দিতে গিয়ে পরে মারা গেছে।
– কি বলছিস এইসব? লাফ দিয়েছিল কেন?
– বন্ধুরা মিলে নাকি বাজি ধরেছিল।
রাজিব ভাই বেশ বড় আমাদের চেয়ে, উনি ঐ.ঝ.ঈ পাশ করে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার জন্য ভর্তি হয়েছিল কিন্তু তখনও ক্লাশ শুরু হয়নি। আর আমরা তখন অনেক ছোট, আমি হয়ত সিক্স বা সেভেনে পড়ি। আমার ভাই বোন আরো ছোট। আমাদের ছোট মাথায় কিছু আসেনি, পরেরদিন দেখতে গিয়েছিলাম দুই ছাদের মাঝে দুরত্ব কতখানি ছিল যে লাফ দিতে গিয়ে পরে গেল, আর বেশি দুরত্ব হলে লাফ দিলই কেন তা জানতে। আমদেরকে দাড়োয়ান ঢুকতে দেয়নি সেদিন। বাসায় মা খালাদের আফছোস করতে শুনলাম আহারে রাজিবের মায়ের না জানি কি অবস্থা? কোথায় ছেলে বড় হচ্ছে, কয়েকদিন পর আয় রোজগার করবে, ছেলের বিয়ে দিবে আর এই অবস্থা হল। মা খালারা আমদের কে ডেকে শাসন করে দিলেন যেন আমরা ছাদে না যাই। সবার মুখে তখন একই কথা। আমরা তখন এক ধরনের কল্পনায় ভাসি, আহা মৃত্যু বিষয়টা একেবারে খারাপ না, পড়াশুনা করতে হবে না, মা- বাবা আর বকাবকি করবে না বরং সারাজীবন মনে করবে বকা না দিয়ে আদর করতে পারত। সবাই আমাদের কথাই বলবে, দুঃখ পাবে।পরিনতির কথা আমদের মাথায় আসে না।
২. ইউনিভার্সিটিতে পড়ার সময় এক মেয়ের সাথে বন্ধুত্ব হলো। তার নাম ইলা। সে যেমন লম্বা তেমনি দেখতে সুন্দরি, পোষাক-আসাকে খুবই স্মার্ট। তাকে অনেক ছেলেই পছন্দ করত। সুতরাং তার বয়ফ্রেন্ড জুটতে বেশিদিন সময় লাগেনি। একদিন বয়ফ্রেন্ডের সাথে ঘুরতে গেল আরেক জোড়া কাপল মিলে। সারাদিন ঘোরার পরে বিকেলবেলা নৌকায় ঘোরার সময় তার বয়ফ্রেন্ডের বন্ধু তাকে বলল
– ইলা তুমি কি আসলেই মামুনকে ভালোবাসো?
– এটা কেমন কথা? ভালো না বাসলে কি এখানে মামুনের সাথে আসতাম?
– প্রমাণ হয়ে যাক, যদি ভালোবাসো তাহলে ( কাবিন নামা বের কর ) এখানে সাইন কর, আমি বাজি ধরে বলতে পারি তুমি সাইন করবে না, ভালবাসলে অবশ্যই সাইন করতে।
– আমি বাবা মার একমাত্র মেয়ে এভাবে কিভাবে সাইন করব?
– আরে বাবা একদিন না একদিনতো তোমরা বিয়ে করবেই, সেটা না হয় করে রাখলে, কেউ কোনদিন জানবেও না। পরে নিয়ম করেই বিয়ে করবে
– তাহলে এখন এটা করার কি দরকার ?
– আমার বন্ধু জানলো যে তুমি ওকে কতটা ভালোবাসো। অবশ্য আমি মামুনকে আগেই বলেছি, ইলা এত সুন্দরি যে যেকোনো সময় আরো ভাল ছেলে পেতে পারে কিন্তু মামুনই বলল আরো ভালো ছেলে পেলেও তুমি মামুনকেই ভালবাসবে কিন্তু মামুনের ধারনা ভুল, দেখেছো আমি বাজিতে জিতে গেছি তুমি সাইন করোনি।
পুরো কথাবার্তার সময় মামুন চুপ ছিল তার মানে মামুন এসবে রাজি ছিল। ইলা কেমন যেন অস্বস্তি অনুভব করছিল তাই সে আর না ভেবেই সাইন করে দিল। সে বাজিতে জিতে গেলেও সারাজীবন সে অনেক ভুগেছে এই সাইন করা নিয়ে।
এই সাইন করার পর থেকেই মামুনের অধিকারবোধ, কেয়ারিং যেন অনেক বেড়ে গেল। প্রথম প্রথম ভাল লাগলেও আস্তে আস্তে যেন দম বন্ধকর পরিবেশ সৃষ্টি করল। এখানে যেও না, ওর সাথে কথা বলো না, ওখানে কি কাজ ইত্যাদি হাজারো প্রশ্ন। অহেতুক সন্দেহ সব কিছু মিলে জীবন বিষময় হয়ে যাচ্ছিল। ব্রেকআপও করতে পারছিল না এই এক সাইনের জন্য।ইলা এক সময় পালিয়ে গিয়েছিল এই শহর থেকে পরিনামে এই সাইন করা কাবিননামার ফটোকপি চলে গিয়েছিল ইলার সব আত্বীয়ের বাসায়। কি লজ্জা! সে কি লজ্জা। ইলা কাউকে কিছু বুঝাতেও পারছিল না। পরবর্তীতে মামুনের কাছে ফিরে আসতে বাধ্য হয়েছিল সে।
এরপর আরো আতংকে, ভয়ে, লজ্জায়, শংকায় দিন কেটেছে তার। অবশেষে ডিভোর্স দিয়ে নিজের জীবন বাঁচিয়েছিল সে কিন্তু এখনও মাঝে মাঝেই আৎকে উঠে পুরানো দিনের কথা মনে করে। সাইন করার সময় শুধু ঐ বাজিতে জিতে যাওয়া নিয়েই চিন্তা করেছিল সে, ভবিষ্যৎ এ পরিনতির এর কথা ভাবেনি।
৩. আমরা ঠিক করেছিলাম কুষ্টিয়া বেড়াতে যাব। লালন ফকিরের মাজার, রবীন্দ্রনাথের কুঠিবাড়ি আর গড়াই নদীর শহর কুষ্টিয়া। আমার হাসবেন্ডের জন্মস্থান আর তাদের বাড়িটাও নদীর পারে। যা ভাবা সেই কাজ, তিনদিনের সফরে বেড়িয়ে পরলাম। তিনতলা বাড়ির ছাদ থেকে নদী দেখা যায় যেখানে নদীর পানিতে চাঁদের আলো পথ তৈরী করে। চাঁদের আলোয় নদীর পাড়ের বালি চিকচিক করে। কেমন যেন এক মায়াময় জগৎ তৈরী হয়। কুষ্টিয়া শহরের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে নদী, বেশি চওড়া না, শীতকালে অল্প পানি থাকে কিছ কিছু জায়গা দিয়ে পায়ে হেঁটেও পার হওয়া যায় এই নদী কিন্তু বর্ষায় ভীষণ খরস্রোতা। আমরা গিয়েছিও বর্ষাকালে, আমার হাসবেন্ড বললেন চল আমরা সবাই আজ নদীতে গোছল করব। আমি সাঁতার না জানায় একটু ভয় পেলেও সবাই হই হই করে রাজি হয়ে গেল। আমার শ্বাশুড়ী সাবধান করলেন প্রতিবছর বর্ষায় কোন না কোন মায়ের বুক খালি হয় এই নদীর কারনে। আমি আরো ভয় পেয়ে গেলাম। বাচ্চাদের হাঁটুপানির বেশিতে নামতে দিতে চাই না আর বাচ্চারা আমার কথা শুনতে চাচ্ছে না সাথে তাদের বাবাও। এরমধ্যে আমরা কিছুটা চিৎকার চেচামেচির শব্দ শুনতে পেলাম। এরপর দেখলাম কিছু মানুষ দৌড়েঁ সামনে যাচ্ছে চিৎকার করে কি বলছে বুঝতে পারছি না কিন্তু নদীতে গোছল করার আগ্রহ চলে গেল এবং আমাদেরও আগ্রহ হল ঘটনা জানার। তাই বাচ্চাদের বাসায় রেখে আমরা গেলাম খোঁজ নিতে, যেয়ে যা শুনলাম তাতে আমরা হতভম্ব!
তিনজন কিশোর মিলে বাজি লেগেছিল এই নদী সাঁতরে পার হওয়ার, যে হেরে যাবে সে অন্য দুজনকে খাওয়াবে। দুজন পারলেও একজন স্রোতের টানে ডুবে চলে গেছে কেঊ আর খোঁজ পাচ্ছে না। নৌকা নিয়ে আসে পাশে জাল ফেলা হচ্ছে, স্রোত যেদিকে গেছে সেদিকেও খোঁজা হচ্ছে কিন্তু কোথায় পাওয়া যাচ্ছে না। সেই কিশোরের মা ও আত্বীয় স্বজনের হাহাকার ও বিলাপে বাতাস ভারি হয়ে যাচ্ছে। সবাই নদীর কুল ধরে অনেকদূর পর্যন্ত যাচ্ছে কিন্তু কোথাও নেই। এলাকার লোকজন সবাই এগিয়ে এসেছিল সাহায্য করতে কিন্তু সব চেষ্টাই বৃথা। অন্য কিশোদের সড়িয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে কিন্তু তারাও ভয়ে, আতংকে দিশেহারা হয়ে গেছে, তাদের সাথেও এরকম হতে পারত এবং তাদের বাজির কারনে তাদের এক বন্ধু সারাজীবনের জন্য হারিয়ে গেছে। এ বোঝা বয়ে বেড়ানো এ কিশোরদয়ের জন্য ভীষণ কষ্টকর। তারা ঘুণাক্ষরেও পরিণয় এর কথা ভাবেনি। আমরা আরো দুদিন ছিলাম, সেই কিশোরের মা পাগলপ্রায় যখনতখন নদীপাড়ে চলে আসে আর চিৎকার করে ছেলেকে ডাকতে থাকে তাকে কোনভাবেই কিছু বোঝানো যায় না আর বাবাটা কেমন যেন পাথর হয়ে গেছেন। এলাকাজুড়ে সবার মুখে একই কথা, কেমন যেন থমকে গেছে সবকিছু কোন কিছুতেই গতি নেই।
আর এভাবেই না বুঝেশুনে কোমলমতি মানুষগুলো বাজির নামে হারিয়ে যায় কিংবা হারিয়ে ফেলে স্বাভাবিক জীবন।
আপনার মতামত লিখুন :