রাশিদা কামাল
আশির দশকের কথা। ঢাকা ইউনিভার্সিটি থেকে সবে বেরিয়ে ‘উদয়ন বিদ্যালয়ে’ জয়েন করেছি। স্কুলটা ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাসেই—ফুলার রোডে। বৃটিশ কাউন্সিলের উল্টো দিকে। প্রথমে শিক্ষকতা ভালো না লাগলেও ধীরে ধীরে ভালো লাগা শুরু হলো। ছাত্রছাত্রীদের সাথে একটা সুন্দর সম্পর্ক গড়ে উঠলো। স্কুলটা পাকিস্তান আমলে ইংলিশ মিডিয়াম ছিলো। স্বাধীনতার পর বাংলা মিডিয়াম হলো। নাম পাল্টে গেলো। English Preparatory থেকে হলো ‘উদয়ন বিদ্যালয়’। Coeducation. সিরিয়াস আর মেধাবী ছাত্রছাত্রীদের সাথে কাজ করতে খুব ভালো লাগতো। পঁচিশ বছর এখানে কাজ করেছি। এই পঁচিশ বছর কত রকম আলোকে আলোকিত হয়েছি তার ইয়ত্তা নেই।
বলাই বাহুল্য আমার অজান্তেই ছাত্রছাত্রীরা আমার বন্ধু হয়ে উঠলো। এই দীর্ঘ সময়ে কত ছেলেমেয়ে পাশ করে বেরিয়ে গেলো তা মনে নেই। না,মনে নেই কথাটা ভুল বললাম। মনে আছে ! সবার কথা মনে আছে !
তবে চোখের আড়াল হলে যা হয় ! সামনে এলেই সেই পুরোনো চেহারাটা স্পষ্ট হয়। যদিও ওরা অনেকটা বদলে গেছে—-বদলেছি আমিও ! কিন্তু বুকের ভেতর জমাটবাঁধা ভালোবাসাটা কখনও বদলায় না। বিনিসুতোর এই মালাটা বুকের নিভৃতে আলো জ্বালে। আর তখন আলোটা উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর হয়। তখন আমরা উভয়েই নস্ট্যালজিক হয়ে হয়ে পড়ি। সেই স্কুল জীবনের দিনগুলি সামনে এসে দাঁড়ায়।
মনে হয় কেউই তো আমরা বদলাই নি ! সেই সাদা কামিজ নেভিব্লু প্যান্ট আর দোপাট্টা পরা মেয়েরা অথবা সাদা সার্ট, নেভিব্লু প্যান্ট পরা ছেলেরা আমার কাছে এসে দাঁড়িয়েছে।
এরা আমার খুব কাছের—খুব প্রিয়—খুব আদরের ! কেউ হারিয়ে যায় নি ! কেউ বদলেও যায় নি ! বদলে যেতে পারে না !
এ আমার সূক্ষ্ম অনুভূতি ! আমার ধারনা সূক্ষ্ম অনুভূতিগুলো অপ্রকাশিত থাকলেও তা বদলায় না !
আজ আমি আমার যে ছাত্রীর কথা বলব সে কিন্তু সত্যিই বদলায় নি ! এতো বছরে সেই একই রকম দেখতে আছে ! লাবণ্যে ভরা মুখটা দেখে ওকে চিনতে আমার এক মুহূর্ত সময় লাগে নি। পরিবর্তন একটা স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। ওর বেলায় এ স্বাভাবিক প্রক্রিয়াও হার মেনেছে ! আগের মতোই মিষ্টি মেয়েটা আমার মনে মুগ্ধতা ছড়ায়।
ওর নাম সুরাইয়া আমিনা, ডাকনাম স্মৃতি। ক্লাসে খুব মন দিয়ে পড়া শুনতো। ওর শান্ত স্নিগ্ধ রূপটা আগের মতোই আছে। স্বামী মসিউর ভুঁইয়া ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার ফ্লোরিডায় পাওয়ার কোম্পানিতে কর্মরত। আগে বুয়েটের শিক্ষক ছিলেন। ছেলে মাহিবুর ভুঁইয়া বাবার যোগ্য সন্তান। পেনসেলভিনিয়ায় ইনভেস্টমেন্ট কর্পোরেশনে কর্মরত।
মেয়ে আরীবাহ রহমান ব্রাউন ইউনিভার্সিটিতে পি.এইচ.ডি. করছে। তবে এ পরিচয়ের বাইরেও ওর আরও একটা পরিচয় আছে ! যে পরিচয়ে শুধু ওর পরিবারই গর্বিত নয়, বাংলাদেশ আর বাংলাদেশের মানুষ ! সুরাইয়া শহীদ বুদ্ধিজীবী অধ্যাপক এস.এম .এ. রাশিদুল হাসানের কন্যা। রাশীদুল হাসান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি ববিভাগের অধ্যাপক ছিলেন।
ওঁর জন্ম পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম জেলায়। বড়ভাই তৈয়ব আলীর ঢাকার ভারতীয় হাইকমিশনে চাকরির সুবাদে তিনি ঢাকায় পড়াশুনা করেছেন। তিন ছেলেমেয়ের মধ্যে সুরাইয়া ছোট। বড়ছেলে সিভিল ইঞ্জিনিয়ার টেক্সাসে থাকেন। বড়মেয়ে রোকাইয়া হাসিনা থাকেন ঢাকা।
বিশিষ্ট রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী, শিক্ষক ও রবীন্দ্রসঙ্গীত প্রতিষ্ঠান ‘ অভ্যুদয় ‘ এর পরিচালক। সুরাইয়া পরিসংখ্যানে মাস্টার্স করে ফ্লোরিডায় বসবাস করছে। একাত্তুরে ওর বাবাকে যখন ধরে নিয়ে যায় তখন ওর ভাইয়ের বয়স ছিলো মাত্র তেরো বছর। বোনের বয়স বারো আর ও ছিলো দুই বছরের শিশু।
রাশীদুল হাসানকে দুবার ধরে নেয়া হয়েছিলো। প্রথমবার দশদিন আটকে রাখা হয়। ওর মা তেরো বছরের ছেলেকে নিয়ে স্বামীকে খুঁজতে শুরু করলে তেমন কেউ সাহায্য করে নি। পরে ওর বাবার এক বন্ধু আজিজুর রহমান জীবনের ঝুঁকি নিয়ে রমনা থানায় গিয়ে এক বেলুচ মেজরের সাথে দেখা করে ওঁকে ছাড়িয়ে আনার চেষ্টা করেছিলেন। দশদিন পর অবশ্য ছাড়া পেয়েছিলেন। ওরা ইউনিভার্সিটির যে কোয়ার্টারে থাকতো সেখানে খুব বোম্বিং হতো। তাই রাতে ওরা বাংলার অধ্যাপক আনোয়ার পাশার বাসায় গিয়ে থাকতো। চৌদ্দই ডিসেম্বর ওই বাড়ির সামনে একটা গাড়ি এসে দাঁড়ালো। কিছু লোক আনোয়ার পাশা আর রাশীদুল হাসানকে চোখ বেঁধে নিয়ে গেলো।
এই শেষ। কেউ আর ফিরে আসেন নি। জানুয়ারির চার তারিখে রাশীদুল হাসানের লাশ মিরপুর বধ্যভূমিতে পাওয়া গেলো। জীবনের এতোসব সাফল্যের মাঝেও সুরাইয়ার মনে পড়ে ছেলেবেলার সেই ভয়ংকর দিনগুলির কথা। ছোট ছিলো বলে অনেক কিছুই ও তখন বুঝতো না। বাবার কথা মনে নেই। বাবা বলতে কেবল বাঁধানো ছবি। তবুও শুনে শুনে আরও একটা ছবি ও মনের মধ্যে তৈরি করেছিলো। আর সেটা হলো বাবাকে যখন বন্দুকের নলের সামনে দাঁড়াতে হয়েছিল সেই ভয়াবহ ছবি। ওর ভাষায়, ‘ একটা সুন্দর জীবন বাবা শুরু করেছিলেন । চোখে ছিলো স্বপ্ন — মনে ছিলো আশা। বন্দুকের নল সব তছনছ করে দিলো । ‘
যুদ্ধ শেষ হলেও ওদের যুদ্ধ শুরু হলো। আর সে যুদ্ধ পুরোটাই সামলেছেন ওর মা রোকাইয়া রাশীদ। ওরা তিনজন নাবালক সন্তান ছিলো মার সহযোদ্ধা। বিশ্ববিদ্যালয় ওদের থাকার ব্যবস্থা আর সামান্য কিছু ভাতা দিতো। এই সামান্য সম্বল নিয়েই মা যুদ্ধ করেছেন—-বেঁচে থাকার যুদ্ধ, সন্তানদের মানুষ করার যুদ্ধ ! ওর মা স্বামীর জন্য শোক করার সময়ও পান নি তখন ! লড়াইটা ছিলো এতোই কঠিন ! ওর ভাষায়, ‘ আমার কাছে মা আজও বিস্ময়। কোন মন্ত্রবলে মা এই অসাধ্য সাধন করেছেন তা আমি জানি না ! আমার লড়াকু মার জন্যই আজ আমরা মানুষ হতে পেরেছি। পড়ালেখায় ভালো ছিলাম বলে আমাদের অবশ্য তেমন খরচ হতো না। এই লড়াকু মা গত বছর আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন। না, মা চলে যান নি ! যেতে পারেন না আমাদের ছেড়ে ! আমাদের অস্তিত্বের সাথেই তো মিশে আছেন মা—–মিশে আছেন বাবা ! ‘
দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তানদের তো মৃত্যু নেই ! তাঁরা শুধু সন্তানদের সাথেই মিশে থাকেন না, মিশে আছেন এ দেশের স্বাধীনতার সাথে, মিশে আছেন পতাকার সাথে, মিশে আছেন বাংলার সবুজ শ্যামল প্রকৃতির সাথে। যে প্রকৃতির সোঁদা গন্ধ আমাদের ব্যাকুল করে—-আকুল করে—পাগল করে ! আমি সুরাইয়াকে বলি যে মৃত্যু স্বাধীনতা এনে দেয় সে মৃত্যু মহান। সে অর্থে তুমি এক গর্বিত সন্তান ! আর এই গর্ব নিয়েই মাথা উঁচু করে বেঁচে থাকো তোমরা।
আপনার মতামত লিখুন :