প্রতিকুলতাকে জয় করে এগিয়ে যাবার স্মৃতি চারণ


ওহাইও সংবাদ প্রকাশের সময় : নভেম্বর ২০, ২০২২, ৯:১৮ অপরাহ্ণ /
প্রতিকুলতাকে জয় করে এগিয়ে যাবার স্মৃতি চারণ

সারওয়ার খান

অফিস দরজায় বেল বাজাতেই স্মিত হাসি দিয়ে অভ্যর্থনা জানানো হলো। সরাসরি নিয়ে যাওয়া হলো যার রুমে, তিনিই আমাদের আজকের উপস্থাপনা সফল উদ্যোক্তা ও ব্যাবসায়ী জনাব রফিক হাওলাদার, সর্বজনের পলাশ ভাই। পরিচয় পর্ব শেষে গল্পচ্ছলে জানা হলো ফেলে আসা জীবনের সংগ্রাম চিত্র।

১৯৭৩ ইংরেজি সালে বরিশালের এক মধ্যবিত্ত পরিবারে জনাব রফিক এর জন্ম। বাবার চাকরির সুবাদে প্রাথমিক পর্যায়ের লেখা পড়া ও বেড়ে উঠা হয়েছে ভোলায়। অষ্টম শ্রেণিতে এসে ভর্তি হলেন বরিশালের এ. কে. স্কুলে। এখান থেকেই এস. এস.সি. তে উত্তীর্ণ হলেন। উচ্চ মাধ্যমিক এর গন্ডি পার হলেন বরিশালের হাতেম আলি কলেজ থেকে।

একানব্বই এর শুরুতেই চলে এলেন ঢাকায়। উদ্দেশ্য টোফেল ও অন্যান্য ইংরেজি কোর্সে তামিল নেওয়া। নিয়মিত যাতায়াত করতেন ইউসিএস ঢাকা সেন্টারে। উদ্দেশ্য আমেরিকার বিভিন্ন ইউনিভার্সিটির খোঁজ নেওয়া। মনের ভেতর সুপ্ত বাসনা, উচ্চ শিক্ষার জন্য আমেরিকা যাওয়ার। এর ই মধ্যে সুযোগ পেয়ে চলে গেলেন তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নে। কিন্তু রাজনৈতিক অস্থিরতার কারনে সেই সময় মাত্র ছয় মাসের মধ্যেই মস্কো ত্যাগ করে ঢাকায় ফিরে আসেন।

১৯৯২ তে এলেন আমেরিকার কানসাসের উইচিটা ষ্টেট ইউনিভার্সিটিতে। বিধি বাম, সেখানে পড়া হলো না। জীবন জীবিকার তাগিদে চলে গেলেন নিউইয়র্ক। শুরু হলো সংগ্রামী জীবন। গ্রোসারি ষ্টোরে কাজ নিলেন ডেলিভারি ম্যান এর। পরবর্তীতে রেস্টুরেন্টেও কাজ করতে হয়েছে। গ্রোসারি ষ্টোর এর কাজটা ‘৯৮এ গ্রাজুয়েশন করা অবধি চালিয়ে গেছেন। এভাবেই জোগাড় হয়েছে পড়ার খরচ। ১৯৯৪ তে সিটি ইউনিভার্সিটি অব নিউইয়র্ক অধিভুক্ত লাগারডিয়া কমিউনিটি কলেজে ভর্তি হলেন। পরবর্তীতে ট্রান্সফার নিয়ে গেলেন নিউইয়র্ক ম্যানহাটনের পেইস ইউনিভার্সিটিতে। এখান থেকেই ১৯৯৮ সালে গ্রাজুয়েশন শেষ করেন কম্পিউটার সায়েন্স এন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং এ।

১৯৯৮ সালে গ্রাজুয়েশন শেষ করে আর থমকে দাড়াতে হয় নাই। খণ্ডকালীন অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে ’৯৮ সালের মে মাসে যোগ দিলেন জাইলক্স সিস্টেম (Gyilox) কম্পানির পরামর্শক হিসাবে। শুরুর দিকে এখানেই সি ++ বা স্ট্রাকচারাল ল্যাংগুয়েজ ইত্যাদিতে ট্রেনিং প্রাপ্ত হয়ে দায়িত্ব নিয়ে গেলেন বোল্ডার, কলারাডোতে। টি ভি গেইম নেটওয়ার্ক এর উপর তিন মাসের কন্ট্রাক্ট কাজ যথা সময়েই শেষ হলো।

২০০০ সাল জীবনের এক উল্লেখযোগ্য সময়। বিয়ে হয় মিস্ লায়লা’র সাথে। তৎকালীন সময়ে দেশের সাথে যোগাযোগ অতটা উন্নত ছিল না। বিয়ে পর্ব সমাধা হয় টেলিফোনে। কাগজ পত্র চালাচালি হয় ডাকযোগে। আনন্দ নিয়েই জানালেন যে তারা মিলেনিয়াল কাপল্। ২০০১ এর এপ্রিলে লায়লা ভাবী যখন নিউইয়র্ক এসে পৌছালেন তখন ডেরা বাধলেন এষ্টোরিয়া কুইন্সে।

ইতিমধ্যে কাজও বদল হলো। ১৯৯৯ তে যোগ দিলেন নিউইয়র্ক এর মেম্বার মার্ক কোম্পানিতে সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে। ৯/১১ এর টুইন টাওয়ারের হামলার সময় খুব কাছে থেকেই প্রত্যক্ষ করেছেন সবকিছু। এবং ঘটনার প্রভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন সরাসরি। ঘটনার আকস্মিকতায় ও প্রভাব বিবেচনায় তার পুরো টিমকেই কাজ থেকে অবসর দেওয়া হয়। ঘরে অন্ত:সত্বা স্ত্রী, সদ্য চাকরি হারানো সঞ্চয় বিহীন একটা অনিশ্চিত অবস্থা, স্টুডেন্ট লোন পরিশোধ এর তাড়া, সব মিলিয়ে একটা বিভিন্ন মূখী চাপে পড়তে হয়েছিল সে সময়।

আস্তে ধীরে ধাতস্থ হয়ে বিভিন্ন ওয়েব সাইটে রেজুমি পোষ্ট দিতে লাগলেন। ফল পেলেনও তাড়াতাড়ি। ২০০১ এর শেষের দিকে যোগ দিলেন পেপসি তে কনসালট্যান্ট হিসাবে। বেতন পেলেনও ধারনাতীত। সেই থেকেই আর্থিক হিসাব নিকাশের পাল্লা তার দিকেই হেলতে শুরু করলো। তিন মাসের পেপসির কাজ শেষ করে ২০০২ এর শরুতে যোগ দিলেন ফাইজারে। এখানেই ডাটা এনালাইসিস, ডাটা বেইজ এর কাজ করে সফ্ট ওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার হিসাবে নিজের অভিজ্ঞতা বাড়ানোর সুযোগ পেলেন।

২০০২ সালের মে মাসে এ ই পি ওহাইও এর তিন মাসের কন্ট্রাক্টে চলে এলেন কলম্বাস ওহাইওতে। পরবর্তীতে তৎকালীন ব্যাংক ওয়ান এর কাজে যোগ দিলেন, যা প্রায় বছর কাল স্থায়ী হলো। আওডি/ভোক্স ওয়াগন এর সাথেও কাজ করেছেন মাস ছয়েক। ২০০৫ এ পুনরায়যোগ দিলেন চেইজ ব্যাংকে। এবার ফুলটাইম জব। সুযোগ সুবিধাও বেশী। চেইজ এর সহায়তায় ওহাইও ষ্টেট ইউনিভার্সিটি থেকে মাষ্টার্স করার সুযোগ পেলেন।

২০০২ সালে কলম্বাসে আসার পর থেকেই নিজের ব্যাবসা গড়ে তোলার পরিকল্পনা ছিল। জিম রজার এর উৎসাহে নিজের আইটিকনসাল্টিং ফার্ম গড়ে তোলায় মনোনিবেশ করলেন। চাকরির পাশাপাশি নিজের অভিজ্ঞতা ও দক্ষতা কাজে লাগিয়ে নিজের ব্যাবসা প্রসারে মনোযোগী হলেন। মূল পরিকল্পনা অনুযায়ী প্রার্থী নিয়োগ করে আই টি বিষয়ে প্রশিক্ষণ দিয়ে কনসাল্টিং ফার্মের জনবল হিসাবে বিভিন্ন প্রজেক্টের কাজে লাগানোর কার্যক্রম যথারীতি চালু হলো।

এক সময়ের রুমমেইট, প্রথম দিককার প্রশিক্ষণ গ্রহনকারী জনাব আবু বকর হানিফ আজ আমেরিকা ও বাংলাদেশ উভয় দেশেই স্বমহিমায় প্রতিষ্ঠিত। ভার্জিনিয়ায় তিনি গড়ে তুলেছেন ওয়াশিংটন ইউনিভার্সিটি অব সাইন্স এন্ড টেকনোলজি। জনাব হানিফের প্রতিষ্ঠার বর্ননা দিতে গিয়ে জনাব রফিক ও আনন্দবোধ করছিলেন। এছাড়া ও প্রায় শতাধিক মানুষ জনাব রফিকের সরাসরি তত্বাবধানে আইটি ট্রেনিং নিয়ে আজ আমেরিকার বিভিন্ন নামীদামী প্রতিষ্ঠান এ প্রতিষ্ঠিত।

কনসাল্টিং ফার্মের কার্যক্রম ২০০৩ থেকে শুরু করে ২০১২ পর্যন্ত বেশ ভালই চলছিল। এর ই মধ্যে ব্যাবসায়ী জনাব গোলাম রহমান সুমন এর সাথে পরিচয়ের সুত্র ধরে ২০০৬/২০০৭ দিকে রিটেইল মোবাইল এক্সেসরিজ ব্যাবসায় জড়িত হলেন। Cellaxs ব্র্যান্ড গড়ে তুলে ব্যাবসা সম্প্রসারণে মনোযোগী হলেন। ২০০৯ থেকে ২০১২ পর্যন্ত চাকরির পাশাপাশি ব্যাবসায়ও সময় দিয়েছেন।

২০১২ এর জুলাইতে চেইজ ব্যাংক এর চাকরি ছেড়ে দিয়ে পরিপূর্ণ ভাবে নিজেকে ব্যাবসায় নিয়োজিত করেন। ২০১৫ এর দিকে কর্পোরেট ব্যাবসাকে ফ্রাঞ্জাইজ ব্যাবসায় পরিবর্তন করে এগিয়ে যেতে থাকেন। পরবর্তীতে Cellairis প্রতিষ্ঠান, যা এক সময় প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল, তার নাম সহ প্রায় আড়াই শতাধিক ব্যাবসা Cellaxs এর মাধ্যমে অধিগ্রহন করে নেওয়া হয়। Cellaxs আজ একটা পরিপূর্ণ সফল ব্যাবসা প্রতিষ্ঠান। আমেরিকার মল ভিত্তিক সর্ববৃহৎCell Phone Accessories and Repair Retail Store ব্যাবসা প্রতিষ্ঠান। ৩১০ এর অধিক রিটেইল ষ্টোর আমেরিকার ৪০ টি অঙ্গ রাজ্য ব্যাপী ছড়িয়ে গেছে ইতিমধ্যেই। সেল ফোন ও তার আনুষঙ্গিক যাবতীয় সবকিছুই প্রতিটা ফ্রাঞ্জাইজ এর মাধ্যমে সেবা দেওয়া হচ্ছে।

এক সময়কার সরকারি চাকরি জীবি বাবা ও মা ২০০১ সালে স্থায়ীভাবে আমেরিকা চলে আসেন। ২০১৩ সালে বাবার মৃত্যুর আগ পর্যন্ত পিতা পুত্রের বন্ধন ঘনিষ্ঠ থেকে ঘনিষ্ঠতর হয়েছিল। তিন ভাই ও এক বোনের চমৎকার পারিবারিক পরিবেশে বেড়ে উঠেছেন জনাব রফিক। দীর্ঘ বিবাহিত জীবনে তিন পুত্র ও তিন কন্যার গর্বিত রফিক লায়লা দম্পতি। মিসেস লায়লা ভারতেশ্বরী হোমস্ ও ইডেন কলেজ থেকে পড়াশোনা শেষ করে রফিক লায়লা দম্পতির আরেক ব্যাবসা প্রতিষ্ঠান Green Meadows Commercial / Multifamily Real Estate Rental Property এর আর্থিক দিকটি পরিচালনা করেন।

ওহাইও এর বাংলাদেশী কমিউনিটির সার্বিক উন্নয়নে জনাব রফিক সদাই সচেষ্ট। বাংলাদেশী ইমিগ্র্যান্ট যারা সহসাই আমেরিকা এসেছেন তাদের প্রতি জনাব রফিক এর পরামর্শ, সৎ কর্মঠ এবং নতুন পরিবেশের সাথে মানিয়ে নেওয়ার সক্ষমতাই সাফল্যের সোপান হিসেবে ইতিমধ্যে পরিগণিত হয়েছে।

Cellaxs সর্বদাই নিজেদের কর্মীদের উৎসাহিত করে অন্যদের কে সহায়তা করার ক্ষেত্রে Cellaxs এর নিয়মিত Corporate Social Responsibility গুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে – ম্যাচিং গিফট প্রোগ্রাম, বাৎসরিক ইনকামের একটা অংশ বিভিন্ন গ্লোবাল নন প্রফিট অর্গানাইজেশন গুলো কে প্রদান করা। এসব অরগানাইজেশনের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে অটিজমস্পিক্স, লোক্যাল সুপ কিচেন এন্ড ফুড ব্যাংক ইত্যাদি। তাছাড়াও হোম লেসদের কে সহায়তা প্রদান, রিফিউজি রিসেটেলমেন্ট প্রোগ্রাম গুলোতে সাহায্য প্রদান, টয়েস ফর টটস এ ডোনেশন সহ আরও নানান সামাজিক কার্যক্রমে Cellaxs সর্বদাই একটি নির্ভরতার নাম।

অর্থনৈতিক স্বাধীনতা অর্জন, নতুন জীবনের বুনিয়াদ ও নতুন চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার প্রত্যয়ে মানুষকে এগিয়ে নিয়ে যেতে Cellaxs সবসময়েই প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। Cellaxs তার নিজস্ব স্বকীয়তায় একক ও অনন্য, সে তালিকায় যোগ করা যেতে পারে প্রায় শ’খানেকের ও বেশি ইমিগ্র্যান্ট পরিবারকে আমেরিকায় পুনর্বাসনে সহায়তা প্রদান পূর্বক তাদেরকে ধীরে ধীরে বিনিয়োগকারী হিসেবে তৈরি করা এবং Cellaxs এ বিনিয়োগ পূর্বক প্রত্যেকের উজ্জ্বল অর্থনৈতিক ভবিষ্যতের ভিত মজবুত করা।