রাশিদা কামাল
‘ওহাইও সংবাদ’ পত্রিকার সম্পাদক লিটন কবিরের নিমন্ত্রণে এক অনুষ্ঠানে গেলাম। সেখানে দেখা হলো তারেক মনোয়ারের সাথে। তারেক রথীর বন্ধু। রথীর কারণেই ওর সাথে আমার ঘনিষ্ঠতা। এ কারণেই ওকে রথীর মতো ভাবতে ভালোবাসি।
দেখা হতেই তারেক বলল,
খালাম্মা, আপনি কি ফ্রি আছেন ? আমি হেসেই বললাম, আমি ভাসমান মানুষ। সব সময় ফ্রি থাকি। তারেক বলল, আমরা এক জাগায় বেড়াতে যাব। আপনিও সাথে যাবেন।
অনুষ্ঠানের ব্যস্ততায় সেদিন আর কথা এগোলো না। দুই দিন পর তারেকের ফোন এলো। ও জানালো কবে আর কোথায় যাচ্ছি আমরা। আমাদের গন্তব্য মিশিগান। নির্দিষ্ট দিনে আমার ছাত্রী তামান্না আমাকে তুলে নিলো। মিশিগানে এর আগেও গিয়েছি। তবে এবার মিশিগান শহরে যাব না —-এবারের গন্তব্য
ক্রিস্টাল লেক। শহর ছাড়িয়ে অনেকটা দূর। দূর কথাটা শুনে ভালো লাগলো। কারণ অনেক সময় গন্তব্যহীন পথ চলতে আমার ভালো লাগে। ‘ আমার এই পথ চলাতেই আনন্দ’ এ রকম একটা অনুভূতি। এখানকার রাস্তাগুলি এতো মসৃণ যে পথচলা পরিপূর্ণতা পায়। রাস্তার পাশে জড়াজড়ি করে দাঁড়িয়ে থাকা গাছপালা আর নাম না জানা কিছু ফুল এ পরিপূর্ণতাকে আরও দৃঢ় করে। সোনা রোদের ঝিলিক চারদিকে। গাছের ফাঁকে ফাঁকে গাঢ় নীল আকাশটা চোখে পড়ছে। আমরা মুগ্ধ দৃষ্টিতে দেখছি।
শাহরিয়ার খুব চমৎকার গতিতে গাড়ি চালাচ্ছিলো। আমি তামান্না আর ঝর্ণাআপা গল্পও করছি। পড়ন্ত বিকেলে পৌঁছালাম গন্তব্যে। গাড়ি থেকে নামতেই চোখে পড়লো লেকের অফুরন্ত জলরাশি। চোখ আটকে গেলো ওখানে।
অনেক বছর আগের কথা। যেবার প্রথম সমুদ্র দেখেছিলাম সে অনুভূতি ফিরে এলো যেন! যখনকার কথা বলছি তখন কক্সবাজার যাওয়া ছিলো প্রায় অসম্ভব। তখন কোন হোটেল বা মোটেল ছিলো না। ভরসা শুধু পাহাড়ের ওপর দাঁড়িয়ে থাকা সরকারি সার্কিট হাউজ। এর আশেপাশে কোন বসতি ছিলো না। এ দিকটা ছিলো একদম ফাঁকা। নেশাধরা নির্জনতা যাকে বলে। দিনে সমুদ্রের কাছে গেলেও রাতে সমুদ্র দেখতাম সার্কিট হাউজে বসেই। ওখান থেকেই সমুদ্রের গর্জন শুনতাম, সাদা ফেনায় মোড়া ঢেউগুলিকে বেলাভূমিতে আঁছড়ে পড়তে দেখতাম। রাতে জাহাজের আলো পড়তো আমার জানালার শার্সিতে।
অদ্ভুত লাগতো তখন! আমার রুমের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা নারকেল গাছের পাতায় লাগতো সে আলোর ছোঁয়া। পাতাগুলি কাঁপতো আর আলোর বিন্দুগুলি পাতার ফাঁকে দোল খেতো। আমার তখন ঘোর ঘোর লাগতো। সেই রহস্যময় আলোর কথা মনে পড়তেই ঘোর ঘোর ভাবটা ফিরে এলো। একদিন দেখলাম মেঘ করেছে। সমুদ্রটা তখন নীল মনে হলো না —- মনে হলো কালো। কিছুক্ষণের মধ্যেই বড় বড় ফোঁটায় বৃষ্টি নামলো। সে এক দেখার মতো দৃশ্য! কোথা থেকে ধেয়ে আসছে বৃষ্টি তা স্পষ্ট না —– স্পষ্ট কেবল সমুদ্রের ওপর পতিত বৃষ্টির ফোঁটা। আমি জানি না সে সার্কিট হাউজটা এখনও ওখানে আছে কিনা! কিন্তু আছে —- আছে আমার মনের মনি কোঠায়।
সেই জানালার শার্সিতে পড়া রহস্যময় আলো, কম্পমান নারকেল পাতা, অবাধ জলরাশি, আর কাছের সেই বৌদ্ধ মন্দির আমার অজান্তেই আমার কাছে এসে দাঁড়ায়।
অনেক দিন পর প্রায় সে রকম দৃশ্যই চোখে পড়লো। না, এখানে কোন নারকেল গাছ নেই, নেই জাহাজের রহস্যময় আলো তবুও গোটা বিষয়টার মধ্যে একটা মিল খুঁজে পেলাম।
লেককে সাগরের সাথে তুলনা করা ঠিক না! তবুও অনেক সময় অনেক বেঠিক জিনিসকে ঠিক ভাবতে ভালো লাগে। তাই হয়তো মিলটা খুঁজে পেতে চাইলাম।
আগেই বলেছি সন্ধ্যের একটু আগেই পৌঁছেছি। সুয্যি পাটে বসেছে। ডুবু ডুবু সূর্যের লাল রঙটা ছড়িয়ে আছে দিগন্তরেখার ওপর। প্রতিফলিত রঙটা ঝিকিমিকি করে দুলছে লেকের পানিতে। একই সাথে চোখে পড়লো স্থির আকাশ আর কম্পিত আকাশ। আস্তে আস্তে সূর্যটা চলে গেলো। আর আমরা ধূসর অন্ধকারে বসে রইলাম অনেকক্ষণ ধরে।
আমার রুমটা ছিলো লেকের পাড় ঘেঁষে। এখান থেকেও লেকটা স্পষ্ট। একটু অন্ধকার হতেই নৌকার আলোগুলি চোখে পড়তো। তখন মনে হতো জীবনের কোন কিছুই হারায় না!
সুযোগ পেলেই সতেজ হয়ে ফিরে আসে — ফিরে আসে আমাদেরই মনে।
রাতের খাবারের ব্যবস্থা তারেক লরেন আর শাহরিয়ারই করলো। পরের দিন কাকডাকা ভোরে উঠলাম। আমার ভাষায় ঘুঘুডাকা ভোর। আমি তামান্না আর ঝর্ণাআপা লেকের পাড়ে গেলাম। মানুষজন তেমন আসে নি ! তবে হাঁসেরা সাঁতার কাটছে মনের আনন্দে। আমার মনে হলো ওদের লাল পায়ে ঘুঙুর —-
কলমির সতেজ ডগা যেন ওদের ছুঁয়ে আছে! আকাশে গাংচিলেরা উড়ছে। দিগন্তরেখার পাশ ঘেঁষে গোলাপি নরম আলোর রেখা।
লরেন ওমার লেয়লা আর তাহমিদকে নিয়ে নৌকা চালাতে গেছে। লরেন এ দেশের মেয়ে। ও কেনু চালাতে দক্ষ। পানিতে হাঁসেদের কেলি, আকাশে গাংচিলদের ওড়াওড়ি আর দিগন্তরেখার পাশ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকা অরণ্য আমাদের উঠতে দিলো না!
পরের দিন বারবিকিউর আয়োজন করা হলো। তারেকই এ আয়োজনের প্রধান। আমরা গল্প করছি সবাই। ইচ্ছে হচ্ছিলো লেকের পাশে গিয়ে দাঁড়াই। ছোট ছোট ছেলেমেয়ে মাছ ধরায় ব্যস্ত। মাছ পেয়ে দারুণ খুশি ওরা। এই খুশিটা আমাদের মাঝেও ছড়িয়ে পড়তো।
পরের দিন গেলাম শহর ঘুরে দেখতে। ছোট্ট শহর। মানুষজনও কম। এই লেকের টানেই এখানে মানুষ আসে। একটা দোকানে ঢুকলাম। এভাবে কিছুক্ষণ ঘুর আমরা ফিরে এলাম আমাদের ক্ষণস্থায়ী বাসায়। মনে হলো আনন্দের উপকরণগুলি ক্ষণস্থায়ীই হয় ! পরের দিন কলম্বাসে ফিরে আসার কথা।
কোনকিছু ছেড়ে আসতে গেলেই বিষাদের ছোঁয়া লাগে। গাড়িতে ওঠার আগেই আবার দেখে নিলাম বাড়িটাকে। কফিহাউজের টেবিলের মতো বাড়িটাও ফাঁকা পড়ে থাকবে না জানি। আমাদেরই মতো কতজন এসেছে, কতজন আসবে তার ইয়ত্তা নেই। আমার মতো হয়তো ওদেরও মনে হবে আমরা এক সময় এই বাড়িটার বাসিন্দা ছিলাম! লেকের পানিতে আমাদেরও ছায়া পড়েছিলো ! এখানকার ঠাণ্ডা হাওয়া আমরা গায়ে মেখেছিলাম ! বাতাসের খুনসুটিতে আমাদের চুল এলোমেলো হয়েছিলো! হয়তো মাতাল বাতাস আমাদের মনও এলোমেলো করেছিলো!
অনেক দূর আসার পরেও মনে হচ্ছিল জলকণাগুলি যেন আমাদের ফিরে আসতে বলছে!
না, মনের সব কথা শুনতে নেই —– কিছু কথা উপেক্ষা করতে হয় ! সব কথা শুনলে জীবন চলে না, গতিহীন হয়ে পড়ে! তাই ভালোলাগার অনুভূতিকে বুকে ধরে ফিরে চললাম গতানুগতিক জীবনের দিকে।
অফুরন্ত জলরাশিকে বললাম —
‘মোর লাগি করিও না শোক
আমার রয়েছে কর্ম
আমার রয়েছে বিশ্বলোক।’
আপনার মতামত লিখুন :