সাপ


ওহাইও সংবাদ প্রকাশের সময় : নভেম্বর ১৮, ২০২২, ৯:০২ অপরাহ্ণ /
সাপ

আসমা-উল-হুসনা
চারদিকে থই থই পানি, ঘরের মধ্যেও হাটুঁ পানি। ঘরের চৌকিটাতে ছোট একটা বাচ্চা বসে ট্যা ট্যা করে কেঁদেই যাচ্ছে কিন্তু কারো নজর নাই সেদিকে। টিনের ঘরের দুই পাল্লার দরজার সামনে মা দাড়িঁয়ে আছে, ঠিক তার পিছনে তাকে জড়িয়ে ধরে দাড়িয়ে আছে আরো দুই বাচ্চা। মা তাদেরকে বার বার বলছে পিছন থেকে সরে যেতে কিন্তু তারা কিছুতেই সরছে না বরং আরো জোড়ে মাকে জড়িয়ে ধরছে। মায়ের সামনে বিশাল বিপদ – তাকে বাচঁতে হবে, বাচ্চাদেরকেও বাঁচাতে হবে। তার সামনে বিশাল এক সাপ, এই বন্যায় তারও আশ্রয় লাগবে। মায়ের হাতে ঘরের দরজা লাগানোর কাঠের ডাসা, ডাসা দিয়ে জোরে জোরে বারি দিচ্ছে পানিতে যেন সাপটা অন্য দিকে চলে যায় কিন্তু কোনভাবেই যাচ্ছে না।এদিকেই ধেয়ে আসছে, মা পিছাতেও পারছে না তার বাচ্চাদের জন্য। মা যত বারিই দিক পানির কারণে ঠিকমতো সাপের গায়ে লাগছে না। একেবারে তাদের কাছে চলে এসেছে ফণা তুলে। তাদের সবারই প্রায় দম বন্ধ হয়ে যাচ্ছে আর নিশ্বাস নিতে পারছে না। ঠিক এই সময় নিপার ঘুম ভেংগে গেল। তার সারা শরীর ঘামে ভিজে গেছে, তেষ্টায় গলা শুকিয়ে কাঠ। সে উঠে বসে বড় বড় করে নিশ্বাস নিলো কয়েকবার তারপর হাত বাড়িয়ে মাথার কাছেরাখা বোতল থেকে পানি খেল।
না, এই স্বপ্নে এখন আর সে বিচলিত হয় না, এই স্বপ্ন সে মাঝে মাঝেই দেখে। প্রথম প্রথম ভয়ের তীব্রতা স্বপ্ন ভাংগার পরও তাকে তাড়িয়ে বেড়াত। খাট থেকে নামতে গেলে মনে হত খাটের নিচে সাপ আছে। বাথরুমে যেতে ভয় লাগত এমন কি হাত বাড়িয়ে পানি নিতেও ভয় লাগত। এই স্বপ্নের ঘটনা নিপার অতি পরিচিত, এটা তার নিজের ছোটবেলার ঘটনা। ঐ মা তার নিজের মা আর পিছনের দুই বাচ্চার বড়জন সে নিজে।
তার বাবা অন্য শহরে কাজ করত, প্রতি সপ্তাহে বা দুই সপ্তাহে একবার গ্রামে আসত। প্রতিবছর বন্যার সময় যমুনা নদীর বাধঁ ভেংগেকুল কুল করে পানি ঢুকে যেত প্রবল বেগে। ঘন্টায় ঘন্টায় কমে যেত শুকনা জায়গার পরিধি, পানির দখলে চলে যেত আশেপাশের সব গ্রাম। মানুষের কি কষ্ট! কোথাও যাবার জায়গা নেই, চারদিকে শুধু পানি আর পানি। খুব জরুরী জিনিষ গুলো শুকনা রাখার চেষ্টায় নিজেরা ভিজে শেষ।
সেইবারও নিপার বাবা আসতে পারেনি, তিন বাচ্চা নিয়ে মায়ের কি সংগ্রাম। বিকালে দেখল উঠানেও পানি উঠেনি, শেষ রাতে পানিতে তাদের চৌকি ভাসার দুলুনিতে তাদের ঘুম ভেংগে গেল। ইটের উপর ইট দিয়ে চৌকিটাকে উচুঁ করা, চিড়া, মুড়ি, গুড় সংগ্রহ করা, খাবার পানি, ঔষধ, হ্যা রান্না করার জন্য খড়িগুলোও শুকনা রাখা, রান্নার জোগাড় করা, কত ধরনের যুদ্ধ! করতে হচ্ছে মাকে।দিনের পর দিন মিষ্টিকুমড়া দিয়ে পানি পানি খিচুড়ি রান্না করত মা আর তাই খেয়েই তারা পার করে দিত দিন। খাবার দিতে যখন অনেক দেরি হত মাঝে মাঝেই চাল আর গম ভেজে দিত তাই খেয়ে পানি খেয়ে থাকত নিপারা। এরপরএকদিন এই সাপের ঘটনা, হ্যা সাপটাকে তাড়াতে পেরেছিল তার মা কিন্তু তারা এতটাই ভয় পেয়েছিলযে মা সারা রাত কুপিবাতি জ্বালিয়ে রেখছিল আর হাতের কাছে রেখেছিল শক্ত লাঠি। বলাতো যায় না সাপটা যদি ফিরে আসে!সারারাত একফোঁটাও ঘুমায় নি মা, একটু পর পর বাচ্চাদের গায়ে হাত বুলালেও বাচ্চারা ঘুমের মধ্যেও কেঁপে কেঁপে উঠছিল।
এরপর কেটে গেছে অনেক বছর। জীবনের মোড় ঘুড়ে গেছে ভীষণভাবে। আর কোথাও কোন সমস্যাও হয়নি কিন্তু এই স্বপ্ন দেখা শুরু হয় নিপার বিয়ের পর থেকে। ভালোবেসে বিয়ে করে নিপা চলে এসছিল কানাডায় রবির সাথে। মা-বাবা চাননি নিপা এত দূরে চলে যাক। এদিকে নতুন চাকুরী, নতুন পরিবেশ, সব কিছু গুছাতে গিয়ে পরিবারে তেমন কোন খোঁজ খবর নিতে পারেনি সে। বিয়ের ছয় মাস পরেই মা মারা যান হার্ট এট্যাকে। নিপা মাকে দেখতেও পারল না। তখন থেকেই নিপা একধরনের আত্ম গ্লানিতে ডুবে যাচ্ছিল রোজ। নিজের বিবেকের কাছে দংশিত হচ্ছিল সে। তার মনে হচ্ছিল সে হয়ত তার পরিবারকে আর কখনওই দেখতে পারবে না।
রবিই তার একমাত্র আশ্রয়। এক পৃথিবী ভালোভাসা দিয়ে রবিকে জড়িয়ে রেখেছিল সে কিন্তু কিছুদিন পর রবির উপর কিছু দুবৃত্তরা আক্রমণ করে যদিও রবির কিছু হয় নি কিন্তু সেইরাতেই প্রথম এই স্বপ্ন দেখে নিপা। এরপর মাঝে মাঝে যখনি কোন বড় ধরনের চাপে পড়ে এই স্বপ্ন বার বার ফিরে আসে। নিপার ঘুম ভেংগে যাওয়া, ভয়ে অস্থির হয়ে যাওয়া নিয়ে প্রথম প্রথম রবি সমব্যাথি হলেও পরে বিরক্ত হয়ে যেতো যে সকালে অফিস অথচ নিপার জন্য সে ঘুমাতে পারছে না কিন্তু সে ভুলেই যেত নিপার অফিস আরো সকালে আর নিপাকে ঘরের কাজও করতে হয়। বিরক্ত হয়ে রবি অন্য রুমে ঘুমাতে যেতো আর নিপার মনে হত, এত বড় পৃথিবী! কয়েকশ কোটি মানুষ অথচ সে কত একা! এই একাকীত্বই তার সংগি হয়ে গেল সাথে এই স্বপ্ন।
রাতের অন্ধকারে ভয়ের সাথে লড়তে লড়তেই সে শিখে গেলো হাজারো মানুষের ভিরে কিভাবে একা বাচঁতে হয়।একের পর এক দায়ীত্বচলে আসে তার উপর। প্রয়োজন ও অপ্রয়োজনে হাজার মানুষের সাথে মিশতে মিশতে জেনেছে সৃষ্টির সেরা জীব মানুষ, কখনো কখনো সাপের চেয়েও ভয়ংকর হয়ে উঠে যারা শুধু মাত্র অস্তিত্ব রক্ষায় আক্রমন করে না বরং নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতেই আক্রমন করে। বিশেষ করে বিশ্বাসের মাত্রা যেখনে বেশি সেখানেই যেন হিংস্রতা বেশি। আর এরকম কোন পরিস্থিতিতে বা মানুষের মুখোমুখি হলেই নিপা এই স্বপ্ন দেখে।
একজন মনোবিজ্ঞানীর সাথে যোগাযোগ করে থেরাপি নিয়েছে সে। এখন সে নিজেকে ভাল ভাবেই কন্ট্রোল করতে পারে। শুধু এটাই বুঝতে পারে না মানুষকে কেন সাপের মত হতে হবে?