বীরাঙ্গনা দিবস চাই


ওহাইও সংবাদ প্রকাশের সময় : নভেম্বর ১৮, ২০২২, ৮:৫২ অপরাহ্ণ /
বীরাঙ্গনা দিবস চাই

সিলভীয়া পান্ডীত
প্রতিবছর বিশ্বের সকল নারীদের সম্মান জানাবার জন্য আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালিত হয়। বিশ্বের সকল নারী এই দিনটিতে নিজেদের দারুণ ভাগ্যবতী মনে করে। কারণ তাদের সম্মান জানাবার জন্য ক্যালেন্ডারের ৩৬৫ দিন থেকে একটা দিন ধার্য করা হয়েছে। বিশ্বের সকল নারীদের সাথে এই দিনটিতে আমিও খুব আনন্দে থাকি ।
প্রতি বছর আন্তর্জাতিক নারী দিবসের অনেক আগে থেকে আমার বাচ্চারা প্ল্যান করতে থাকে আমাকে কোন রেস্টুরেন্টে খাওয়াতে নিয়ে যাবে, কী উপহার দিবে আমাকে! কারণ, ওরা আমাকে ভীষণ ভালবাসে, সারাক্ষণ আমার পিছু পিছু ঘোরে, আমাকে ক্ষেপায়, আবার যখন তখন কাছে এসে জড়িয়ে ধরে চুমু খায়। ওদের এই ভালবাসায় আমার সময় কি যে আনন্দে কাটে তা আমি ভাষায় প্রকাশ করতে পারবো না। সত্যিই আমি একজন ভাগ্যবতি নারী!এখনো আমার বাচ্চারা আমার সাথে থাকে, আমার কাছে আব্দার করে আর আমার গলা জড়িয়ে আদর করে এবং আদর নেয় …. ।
যখনই আন্তর্জাতিক নারী দিবস আসে তখনই আমি সেই নারীদের কথা চিন্তা করি, যেই নারীরা মা হয়েও মাতৃত্বের স্বাদ নিতে পারেনি। হ্যাঁ, আমি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ এবং পাকিস্তানের যুদ্ধে যে সব নারীরা পাকিস্তান আর্মি দ্বারা নির্যাতিত হয়েছিল এবং যারা এই নির্যাতনের ফসল হিসাবে সন্তান প্রসব করেছিল, যে সন্তান তারা প্রসব করতে চায়নি এবং যে সন্তানকে তাঁরা প্রসবের পর একবারের জন্যও চোখের দেখা দেখতে চায়নি আজ আমি বিশ্ব নারী দিবস উপলক্ষে সে হতভাগ্য নারীদের কথা লিখতে চাচ্ছি ….
১৯৭১ সালে বাংলাদেশ এবং পাকিস্তানের মধ্যে যখন যুদ্ধ শুরু হয়েছিল তখন পাকিস্তান আর্মিরা আমাদের দেশের নারীদের উপর যে অকথ্য নির্যাতন চালিয়েছিল তা ভাষায় প্রকাশ করার মত না। মা তার সন্তানের সামনে, মেয়ে তার বাবা ও ভাইয়ের সামনে, স্ত্রী তার স্বামীর সামনে পাকিস্তান আর্মি দ্বারা নির্যাতিত হয়েছিল, এই ইতিহাস আমাদের সবার কম বেশী জানা।
আমি গত কয়েক বছর ধরে এই বিষয়টি নিয়ে খুব চিন্তা করছি। কারণ আমি একটি বই লিখেছি ১৯৭১ সালের বাংলাদেশ পাকিস্তান যুদ্ধের উপর। বইটি লিখতে গিয়ে বাংলাদেশের জন্মাবার ইতিহাস আমাকে পড়তে হয়েছিল। বাংলাদেশের জন্মাবার ইতিহাস কখনই সম্পুর্ণতা পাবে না যদি আমরা বীরাঙ্গনা নারীদের কষ্টের কথা না লিখি বা না চর্চা করি ।
আমি গত চোদ্দ বছর ধরে বাংলাদেশের জন্মের ইতিহাস বাংলাদেশি আমেরিকান বাচ্চাদের জানাবার জন্য বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস উপলক্ষে অনুষ্ঠানের আয়োজন করে আসছি। এই সব অনুষ্ঠানে আমি আমাদের বাংলাদেশি আমেরিকান বাচ্চাদেরকে নিয়ে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করি, সেই সব অনুষ্ঠানে আমি আমাদের দেশের ইতিহাস পাঠ করি যাতে আমাদের বাংলাদেশি আমেরিকান বাচ্চারা বাংলাদেশের জন্মাবার প্রকৃত ইতিহাস জানতে পারে।
আমি বাংলাদেশের জন্মাবার ইতিহাস জানার জন্য যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত বীরাঙ্গনা নারীদের নিয়ে যখনই ড়াশুনা করি বা ওনাদের নিয়ে লেখালিখি করি তখন আমার খুব কষ্ট হয়। যে বিষয়টা আমাকে সব সময় পীড়া দেয় তা হলো, যে দিন বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছিল সেদিন যখন সমগ্র বাঙালী জাতি যে যেখানে ছিল আনন্দ উল্লাসে মেতে উঠেছিল তখন শুধু বীরাঙ্গনা নারীরা কোন আনন্দ করতে পারেনি। আমরা কি কখনও তাদের সেই কষ্টের মুহূর্তগুলোকে নিয়ে ভেবে দেখেছি? যখন বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছিল তখন সমগ্র বাংলাদেশের মানুষেরা খুশীর জোয়ারে হাসছিল, জয় বাংলা বলে উল্লাসে মেতে উঠেছিল আর সেই মুহূর্তে আমাদের দেশের বীরাঙ্গনা নারীরা চোখের জলে ভাসছিল!! কি কঠিন ছিল সেই সময় তাঁদের। বাংলাদেশের ১৯৭১ সালের যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত বীরাঙ্গনা নারীদের কষ্টের কথা লেখার সাধ্য আমার নেই, সাহসও নেই। আমি শুধু জানি বা বিশ্বাস করি সকল বীরাঙ্গনা নারীরা আমাদের দেশের স্বাধীনতার অনের বড় অংশ। তাঁদের অবদান অনেক সিমাহীন কষ্টের। তাঁদের কথা পড়তে গেলে চোখের জল ধরে রাখা যায় না। লিখতে গেলে হৃদয় থেকে রক্তক্ষরণ হয়।
আমি আমার মায়ের কোলে চড়ে ৭১ এর যুদ্ধ দেখেছি। আমার যুদ্ধের সে স্মৃতি নিয়ে আমি একটা বই লিখেছি। লিখতে গিয়ে আমাকে বাংলাদেশের জন্মাবার ইতিহাস পড়তে হয়েছে। আমি যখন বীরাঙ্গনা নারীদের নিয়ে পড়েছিলাম তখন আমি পড়তে গিয়ে মাঝে মাঝে শিউড়ে উঠেছিলাম, মাঝে মাঝে আমার দুচোখ বেয়ে জল ঝড়েছে অঝর ধারায়। মাঝে মাঝে পড়া বন্ধ করেছি বীরাঙ্গনা নারীদের কষ্ট সহ্য করতে না পেরে।
৭১ এর স্বাধীনতার যুদ্ধে আমাদের বাংলাদেশের বীরাঙ্গনা নারীদের যে শুধু শরীর ক্ষতবিক্ষত হয়েছিল তাই না তার চেয়েও তাদের মন বেশী ক্ষতবিক্ষত হয়েছিল। তাঁদের কোথাও যাবার জায়গা ছিল না। তারা অনেকেই আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছিল, অনেকের পরিবার তাদেরকে গ্রহণ করতে অস্বীকার করেছিল। সেই বীরাঙ্গনা নারীদের অনেকেই ফিরে আসার পর তাদের পরিবার দ্বারা নির্যাতিত হয়েছিল, কেউ কেউ আবার খুনও হয়েছিল….. দুঃখ ভারাক্রান্ত অসহায় বাঙালী বীরাঙ্গনা নারী….. !
আমরা আজকাল কত রকমের দিবস পালন করি, যেমনভ্যালেনটাইন্স ডে, মাদার্সডে, ফাদার্সডে, ফ্রেন্ডশিপডে আরো কত দিবস!! আমরা কেন বছরের যে কোন একটা দিনকে আন্তর্জাতিক বীরাঙ্গনা দিবস হিসাবে ধার্য করিনা !!

আমি সব বীরাঙ্গনা নারীদের সন্মান জানাবার জন্য বছরের একটা দিন বীরাঙ্গনা দিবস উদযাপন করতে চাই। শুধু যে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে নারীরা নির্যাতিত হয়েছিল তাই না সমগ্র পৃথিবীর যখন যে দেশে যুদ্ধ হয়েছে সেই দেশের নারীরা নির্যাতনের শিকার হয়েছে। পৃথিবীর যে দেশেই যখন কোন যুদ্ধ হয়েছে সেই দেশের নারীদের যুদ্ধের কারণে শারীরিক এবং মানষিক অত্যাচারের সম্মুখিন হতে হয়েছে। নারীদের উপর এই নির্যাতন চলে আসছে পৃথিবীতে মানব জাতি আগমনের পর থেকেই।
সব শেষে বলতে চাই, যে সকল নারী বিশ্বের প্রতিটা যুদ্ধে নির্যাতনের শিকার হয়েছে, হচ্ছে এবং হবে তাঁদের শ্রদ্ধা এবং সম্মান জানাবার জন্য আমি একটি আন্তর্জাতিক বীরাঙ্গনা দিবস ধার্য করার জন্য পৃথিবীর সকল ক্ষমতাশীলদের কাছে আকুল আবেদন করছি।