প্রবাসীদের দুর্ভোগের বুঝি শেষ হবে না


ওহাইও সংবাদ প্রকাশের সময় : নভেম্বর ১৮, ২০২২, ৭:৫২ অপরাহ্ণ /
প্রবাসীদের দুর্ভোগের বুঝি শেষ হবে না

প্রবাসীদের দুর্ভোগ নিয়ে লেখালেখি, বলাবলি হচ্ছে এন্তার। কিন্তু দুর্ভোগের সম্পূর্ণ অবসান দূরে থাক, সামান্য উপশমেরও কোনো লক্ষণ নেই। উল্টো বেড়েই চলেছে। সিনেমা-নাটকে যেমন দেখা যায়, একজন প্রেমিকা ভালোবেসে যতই তার প্রেমিকের কাছে যেতে চান, প্রেমিক তার অবহেলা-অবজ্ঞা দেখিয়ে ততই তার থেকে দূরে সরে যান। প্রবাসীদের ক্ষেত্রেও অনেকটা তেমনই। প্রবাসীদের মধ্যে দেশপ্রেম, দেশের জন্য টান যতই প্রবল ও গভীর হচ্ছে, তাদের প্রতি দেশের একশ্রেণির মানুষের অবহেলা ও অনাচার বেড়েই চলেছে। সরকারের দৃষ্টিভঙ্গিও এ বিষয়ে খুব একটা ব্যতিক্রম লক্ষ করা যায় না। প্রবাসীরা সব সময়ই একটা বৈষম্যের শিকার হয়ে আসছেন।
সরকারের দিক থেকে প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের উদাহরণ তো আছেই, সেই সঙ্গে সরকারের কিছু কিছু মন্ত্রী ও এমপির প্রবাসীদের প্রতি তাদের অনৈতিক ও অবাঞ্ছিত মনোভাব যেভাবে প্রকাশ করে থাকেন মাঝেমধ্যেই, তাতেই পরিষ্কার হয়ে যায়, প্রবাসীদের জন্য যে যতই উদার নৈতিকতার কথা মুখে প্রকাশ করেন, তাতে তাদের প্রকৃত মনোভাব লুকিয়ে রাখতে পারেন না। সেই মনোভাব এতটাই প্রকট যে, তার প্রভাব দেশের সাধারণ মানুষ, এমনকি প্রবাসীদের নিকটাত্মীয়-স্বজনের ওপরও এমনভাবে পড়ে যে তারা সেই সব আত্মীয়স্বজনের আক্রোশ, নিপীড়ন ও বঞ্চনার হাত থেকেও রেহাই পান না। সেসব খবর প্রবাসী সংবাদপত্রেই যে শুধু প্রকাশ পায় তা নয়, দেশের জাতীয় মিডিয়া, এমনকি বিদেশি মিডিয়াতেও স্থান পায়।
পাশাপাশি দেশের প্রতি প্রবাসীরা এত সব অবহেলা, বঞ্চনা, লাঞ্ছনা, অসম্মান সত্ত্বেও যে টান, ভালোবাসা অনুভব করেন, তাকেই মূলধন ভেবে কিছু স্বার্থান্বেষী চক্র প্রবাসীদের প্রতারণা করার সুযোগ গ্রহণ করে চলেছে। সব দিক থেকে স্বদেশের মানুষ প্রবাসীদের ঠকানোর চেষ্টা চালাচ্ছে। যে যেখানে যেভাবে সুযোগ পাচ্ছে, সে সুযোগ কেউ হাতছাড়া করছে না। বিমানবন্দর থেকে শুরু করে রাস্তাঘাটে, বাড়িতে, অফিসে, আদালতে সর্বত্রই এই অবস্থা। জীবনহানি থেকে সম্পদহানি, প্রাপ্য সব সুযোগ থেকে বঞ্চিত করার ষড়যন্ত্রÑসবই মেনে নিতে হচ্ছে প্রবাসীদের। স্বজন ঠকাচ্ছে, বন্ধু-প্রিয়জন ঠকাচ্ছে। সরকার, সরকারি কর্মচারীরা ঠকাচ্ছেন, মন্ত্রীরা কথায় কথায় অপমান-অসম্মান করছেন। সরকারি অফিসে কোনো কাজ করতে গেলে প্রবাসী জানতে পারলেই শুরু হয়ে গেল নানা রকম হয়রানি। এক দিনের কাজের জন্য দশ দিন ঘুরতে হবে। দুই হাজার টাকার ঘুষের জায়গায় প্রবাসী জানলে সেই ঘুষের দাবি দুই লাখ টাকায় গিয়ে পৌঁছাবে। প্রবাসীদের যা ন্যায়সংগত অধিকার, সেই অধিকারকে খুব সহজে সংবিধানে ন্যায্য প্রাপ্য হলেও অস্বীকার করা হবে। সাত-পাঁচ বুঝিয়ে দিয়ে ঘুষের পথে ঠেলে দেওয়া হবে এবং সেখানে কাজটি ঠিক সময়ে করিয়ে নিতে মোটা অঙ্কের ঘুষ দিতে হবে।
সম্প্রতি প্রবাসীদের এমন একটি হয়রানির খবর খুব বড় করে প্রকাশিত হয়েছে প্রবাস-সমাজের খুব জনপ্রিয় ও বিশ্বস্ত সংবাদপত্র ঠিকানায়। গত ৫ অক্টোবর সংখ্যা ঠিকানার লিড নিউজে ‘এনআইডি হয়রানিতে প্রবাসীরা’ শিরোনামে তেমনই প্রবাসীদের হয়রানির খবর প্রকাশ করা হয়েছে। মূল শিরোনামের ঠিক নিচেই অপেক্ষাকৃত ছোট করে বলা হয়েছে, ‘দেশে মিলছে না ন্যূনতম নাগরিক সেবা : বিকল্প এনআরবি কার্ড চান ভুক্তভোগীরা’। এভাবেই প্রবাসীরা একেক সময় একেক রকম হয়রানির শিকার হচ্ছেন প্রাণের চেয়ে প্রিয় স্বদেশভূমিতে। তবে কি দেশ ছেড়ে আসাই প্রবাসীদের এমন এক পাপ, যার কোনো ক্ষমা নেই! তা স্বদেশের জন্য প্রবাসীদের মন যতই কাঁদুক। স্বদেশের কল্যাণে, স্বদেশের মানুষের জন্য যতই অবদান রাখুক।
এবার দেখা যাক, এনআইডি নিয়ে কীভাবে প্রবাসীরা হয়রানির শিকার হচ্ছেন, যা ঠিকানার ৫ অক্টোবরের শিরোনাম সংবাদে উঠে এসেছে। প্রতিবেদনটিতে যা বলা হয়েছে তার মর্মার্থ হচ্ছে : ‘দেশে (বাংলাদেশ) যেকোনো নাগরিক সুবিধা পেতে জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) থাকা বাধ্যতামূলক। দুঃখজনক বিষয় হচ্ছে, অধিকাংশ প্রবাসীরই এনআইডি নেই। ফলে দেশে গেলে এনআইডি-বঞ্চিত সব প্রবাসী ন্যূনতম নাগরিক সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। এনআইডি না থাকায় তাদের সম্পত্তি, জমিজমাও বেহাত হয়ে যাচ্ছে। বিক্রিও করতে পারছেন না জাতীয় পরিচয়পত্র না থাকায়। চরমভাবে বঞ্চিত হচ্ছেন পৈতৃক বা নিজের কেনা সম্পত্তি থেকে। এলাকার প্রভাবশালী, টাউট-বাটপার, এমনকি স্বার্থান্বেষী আত্মীয়স্বজনও বেদখল করে প্রবাসীদের ঠকাচ্ছেন।
একাধিক সূত্র থেকে জানা যায়, ইউরোপ, আমেরিকা ও মধ্যপ্রাচ্যের প্রায় ৪০টি দেশে ১ কোটি ৫০ লাখের মতো বাংলাদেশি মাথার ঘাম পায়ে ফেলে যে অর্থ দেশে পাঠান, তাতে দেশের অর্থনীতির চাকা সচল থাকে। তাদের গালভরা পরিচয় ‘রেমিট্যান্স যোদ্ধা’। অথচ দেশে গেলে তারা পরিচয়হীন। এনআইডি কার্যক্রম পরিচালনার জন্য শত কোটি টাকার প্রকল্প নেওয়া হলেও দেশে গিয়ে প্রবাসীরা এর কোনো সুফল পাচ্ছেন না। বেশ কয়েকটি দেশ থেকে অনলাইনে আবেদন করার সুযোগ রাখা হলেও সেই সুযোগ কেউ গ্রহণ করতে পারছেন না নির্বাচন কমিশনের অসহযোগিতার জন্য। এ কারণে অনেকের পক্ষে আবেদন জমা দেওয়াই সম্ভব হয় না। ‘পরিচয়হীন’ প্রবাসীরা দেশের নাগরিক কোনো সুবিধাই ভোগ করতে পারছেন না। অথচ এই ‘পরিচয়হীনদের’ প্রেরিত অর্থই দেশের অর্থনীতির চাকা সচল রাখছে, দেশের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের দ্বিতীয় বৃহত্তম উৎস হিসেবে।
অনেকেই প্রবাসীদের পক্ষে অনেক কথা বলেন দেশ থেকে প্রবাসে এসে। এ যেন অনেকটা গাধার সামনে মুলোর আঁটি ঝুলিয়ে রাখার সেই গল্পের মতো। মন্ত্রী-এমপিরা প্রবাসীদের অনেক প্রতিশ্রুতি দেন। নীতির প্রশ্ন তুলে বলেন, প্রবাসীরা জন্মসূত্রে বাংলাদেশি। নাগরিক সুবিধা ভোগ করার অধিকার তাদের সাংবিধানিক অধিকার। অথচ সবার প্রতিশ্রুতিদান সত্ত্বেও প্রবাসীরা সেই অধিকার ভোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। প্রতিশ্রুতিদাতারা বিমানে উঠেই নিজেদের প্রতিশ্রুতির কথা বেমালুম ভুলে যান। কোনো কোনো দপ্তরের দু-একটি কাজ প্রবাসীরা করিয়ে নিতে সক্ষম হলেও তার পেছনে উৎকোচ হিসেবে মোটা অঙ্কের টাকা ব্যয় করতে হয়। এক দিনের কাজের জন্য সাত দিন ঘুরতে হয়।
অন্যদিকে দ্বৈত নাগরিকত্বের বিধান রাখা হলেও প্রবাসীদের কাছে তা সোনার হরিণ যেন। অর্থাৎ প্রবাসীদের সব সুবিধাপ্রাপ্তিই এক অনিশ্চিত ঘটনা। অথচ প্রবাসীদের জন্য সুবিধা নিশ্চিত করতে সরকারের সত্যি সত্যি সদিচ্ছা থাকলে তা খুব সহজেই অবারিত করতে পারা যেত বলে অভিজ্ঞজনদের অভিমত। কোন কোন সুবিধা কোন কোন পদ্ধতিতে মিলবেÑসরকারিভাবে একটি জনবিজ্ঞপ্তি বিভিন্ন দেশের দূতাবাস, হাইকমিশন কিংবা কনস্যুলেটে টাঙিয়ে দিলে এবং সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা তা মেনে চলছেন কি না, তা কঠোর পর্যবেক্ষণে রাখলে এসব প্রাপ্তির বঞ্চনা অনেকটাই লাঘব হয়ে যেত। আরো সহজ হয়ে যেত বিভিন্ন দেশের কনস্যুলেটেই যদি সেসব দেশের প্রবাসীদের এনআইডি ইস্যু করার বিষয়টি নিশ্চিত করা হয়। কিন্তু বিড়ালের গলায় ঘণ্টা বাঁধার কেউ নেই।
এ কথা সবাই স্বীকার করবেন, স্বদেশে প্রবাসীদের সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি এবং প্রাপ্তির পথ প্রসারিত ও সহজ করলে বাংলাদেশ সরকারই লাভবান হবে। প্রবাসীরা সব সময় বাংলাদেশকে বুকে নিয়ে চলেন। বাংলাদেশের উন্নয়ন এবং দেশের মানুষের কল্যাণ ও মঙ্গল সাধনে এতটুকু কুণ্ঠা নেই প্রবাসীদের। বাংলাদেশে প্রবাসীদের যেভাবে হয়রানি ও বঞ্চিত করা হচ্ছে, তাতে আদতে দেশটাই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। আমরা সবাই আশা করব, প্রবাসীদের সব দুর্দশা, হয়রানি, বঞ্চনার অবসান ঘটাতে যা যা করণীয়, তার ব্যবস্থা নিতে সরকার বিলম্ব করবে না দেশের স্বার্থেই। এ ব্যাপারে ত্বরিত ব্যবস্থা না নিলে হয়তো সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দেশপ্রেম নিয়েই প্রশ্ন উঠবে।