আসমা-উল-হুসনা
আমি ছোট বেলা থেকেই গৃহিণী হতে চাইতাম। রান্না বান্না, ঘর দোর পরিস্কার আর ছেলেমেয়ে মানুষ করা- এই হবে আমার কাজ। ইচ্ছে ছিল অনেকগুলো ছেলে মেয়ে হবে, অন্তত একটা ফুটবল টিম গঠন করার মত তো হতে হবেই। তাদেরকে বকা ঝকা করে সন্ধ্যার সময় লাইন ধরে পড়তে বসাবো, সকালে আবার। স্কুলে পাঠিয়ে বিশাল হাড়িতে রান্নাবান্না।
আর আমার তিনি হবেন একজন পাক্কা কৃষক যার অনেক জমি থাকবে। আমাদের বাড়িটা হবে অনেকখানি জায়গা নিয়ে, পাশে থাকবে বিরাট বড় পুকুর। হাস মুরগি, গরু ছাগল পালবো। শাক-সবজি, ফল-মূল ফলাবো, ঘর ভর্তি মানুষ জন থাকবে, শষ্যে ভর্তি থাকবে আমাদের গুদাম। তিনি বাহির সামলাবেন আর আমি ভিতরে তদারকি করব আর করব ছেলেমেয়ে মানুষ। কিছুটা আমার মায়ের মত, তার চার ছেলে মেয়ের সবাই মোটামুটি ভালো মানুষ হয়েছে, প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
আমার মা আমাকে পড়াশুনা নিয়ে বকা দিত আর আমি বই নিয়ে পড়তে বসে ভাবনার রাজ্যে চলে যেতাম যে হাস মুরগি পালছি, মাছ চাষ করছি এই সব আবোলতাবোল।
একদিন ক্লাসে শিক্ষক জিজ্ঞেস করলেন কার কি হবার ইচ্ছে – কেউ বলছে ডাক্তার, কেউ ইঞ্জিনিয়ার আর কেউবা শিক্ষক। পুরো ক্লাসে আমিই একজন বললাম গৃহিণী হতে চাই, ক্লাস শুদ্ধ সে কি হাসি! সেদিন কেমন যেন লজ্জা পেয়ে গেলাম, এরপর থেকে আমিও বলতাম ডাক্তার হতে চাই।
আস্তে আস্তে বিভিন্ন কারনে দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন হলো, বুঝতে পারলাম মেয়েদের আত্ম নির্ভরশীল হওয়া জরুরী, অর্থনৈতিক স্বাধীনতা মেয়েদের সবচেয়ে বড় হাতিয়ার। সেই উদ্দ্যেশে ছুটে চললেও একটা স্বপ্ন সব সময় থেকে গেল-ঘর ভর্তি বাচ্চাকাচ্চার। তাই দেরি না করেই বিয়ের পর পর নেমে গেলাম সেই পক্রিয়ায়, আমার তিনি যতই বুঝায় একটু পরে বাচ্চা নেই, লাইফটাকে ইনজয় করে নেই। আমি দৃঢ় প্রতিজ্ঞ বাচ্চা নিয়েই ইনজয় করব। কিন্তু তিন বছর হয়ে গেল আমার ফুটবল টিমের প্রথম জনেরই দেখা নাই। প্রতিমাসেই পিরিয়ড এর সময় আমি হতাশ হই আবার আশায় বুক বাধি, হাসবেন্ড এর সাথে রাগারাগি করি যে সে চাচ্ছিল না বলেই এরকম হচ্ছে। প্রথম দিকে সে হাসাহাসি করলেও আমার কষ্ট তাকেও ছুঁয়ে যায়, তারও মন খারাপ হয়। আমাকে বুঝায় আল্লাহ যখন দিবে তখন হবে এত অস্থির হয়ো না, ধৈর্য ধর, কিন্তু আমার ধৈর্যের বাধঁ ভেংগে যায়। প্রায় প্রতিমাসেই বাথরুমে যেয়ে কানাকাটি করি। বাহিরে আমি ভীষণ ফিটফাট, স্মার্ট, ভালো চাকুরী করি, ঘরদোর টিপটপ, সাজানো গোছানো সংসার, আড্ডা দেওয়া, বন্ধুবান্ধব, আত্মীয় স্বজন সবার সাথে মেলা মেশা সব ঠিক মত চলে।
আত্মীয় স্বজন, বন্ধু বান্ধব, সহকর্মীরাও জিজ্ঞেস করে কি ব্যপার খুশির খবর কবে দিবে? হেসে বলি আরে এত তাড়াহুড়োর কি আছে? সময় হলেই নিব কিন্তু ভিতরে ভিতরে ক্ষত বিক্ষত হই, ফুলের কুড়ি দেখলে আমার মায়া লাগে, রাস্তার পাশে কুকুরের বাচ্চা খেলে সেটা দেখলেও মায়া লাগে, যাওয়া আসার পথে স্কুলের সামনে আমার গাড়ী স্লো হয়ে যায়, ছোট ছোট বাচ্চাদের দেখতে বড়ই মায়া লাগে, পিছনের গাড়ীর হর্ণের শব্দে আমি আগাই।
অনেকেই বলে এত ক্যারিয়ারস্টিক হওয়া ভাল না বাচ্চা নেওয়াটা জরুরী, আর কতদিন লাভ বার্ড হয়ে থাকবে? সংসারটাকে আগে বাড়াও। আত্মীয়রা বলে বাচ্চা নিয়ে নাও আমরা বড় করে দিব তোমাদের এত চিন্তা করতে হবে না কিন্তু আমার ভিতরটা কাউকে দেখাতে পারি না? এভাবে সময় চলে যায়, আমাদের বেতনের অনেকাংশ চলে যায় চিকিৎসার জন্য সাথে শারীরিক ও মানুষিক কষ্টতো আছেই। ধীরেধীরে সবাই জানতে পারে আমাদের বাচ্চা নেই মানে হয় না। সবার চেহারায় কেমন একটা ভাব, অনেকে সহানুভূতির সুরে জানতে চায় কার সমস্যা, আমার না আমার হাসবেন্ড এর? কেউ কেউ বিভিন্ন উপদেশ দেয়, ঘটনা বলে কে কোথায় যেয়ে কি উপকার পেয়েছে। আমাদের সামাজিক মেলামেশায় কথার ধরন পরিবর্তন হয়ে যায়, তাই গুটিয়ে নেই নিজেদেরকে। আমরা একজন আরেকজনকে সান্তনা দেই আমরাতো আছি একজন আরেকজনের জন্য। কারো কারো দৃঢ় ধারনা আমার জন্যই বংশ আগে বাড়ছে না, অথচ আমার মধ্যে কোন ভ্রুক্ষেপ নেই, ফ্যাশন করে ঘুরে বেড়াই, বাচ্চাকাচ্চা নেইতো তাই সংসারের কোন কাজ করতে হয় না তাই এত ফ্যাশন। এত ঠাটবাট, টাকা পয়সা দিয়ে কি হবে? মা না হতে পারলে মেয়ে হবার কোন মানে হয়? এটা যেন তাদের চিন্তার একটা বড় বিষয়। মা হতে পারছি না অথচ চেহারায় বেচারা ভাব না নিয়ে সাজগোজ করে ঘুরে বেড়াচ্ছি, ভালোভাবে চাকুরী করে বেড়াচ্ছি, সামাজিক স্ট্যাটাস বজায় রাখছি এও যেন এক বড় অপরাধ। আমি পরিচিত কত জনকে দেখেছি ধীরেধীরে মা হয়ে উঠতে, দেখেছি তাদের মধ্যে মাতৃত্বের প্রকাশ হতে, আমিও বাসায় ফিরে যখন একা থাকি তখন মত্ত হয়ে উঠি এক অন্য খেলায়। আয়নায় নিজেকে দেখি, অনুভব করার চেষ্টা করি তলপেটে প্রজাপতির নাচ, কখনো কখনো কথা বলি পেটের ভিতর অনুভব করা না থাকা বাচ্চার সাথে, কাপড়ের নিচে বালিশ নিয়ে বুঝতে চেষ্টা করি প্রেগন্যান্ট হলে আমাকে কেমন দেখাত, এ আমার অন্য জগৎ। একদিন আমার হাসবেন্ড দেখে ফেলল আমাকে, কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে সে আবার বাইরে চলে গেল, আমি কান্নায় ভেংগে পড়ি আমার সব স্বপ্নই তো চলে গেছে এ স্বপ্ন আমাকে কেন প্রতিনিয়ত কষ্ট দেয়।
এর প্রায় তিন মাস পর আমার হাসবেন্ড আমাকে বলল তোমাকে এক জায়গায় নিয়ে যাব রেডি থেক, ইদানীং কাজ ছাড়া কোথাও যেতে ভাল লাগে না তবুও ওর গলার স্বরে কিছু ছিল যে না করলাম না, সেদিন সে আমাকে নিয়ে আসল এক এতিমখানায়, একটু অবাক হলেও কিছু বললাম না ভাবলাম হয়তো এতিম বাচ্চাদের জন্য কিছু করতে চায়, মনে মনে আমিও কিছুটা আগ্রহী হয়ে উঠলাম। আমাদের অফিস কক্ষে বসানো হল। আমার হাসবেন্ড কিছু ফর্মালিটি পালন করে পেপারে সাইন করে আমাকে সাইন করতে দিলেন। আমি কিছুটা ঘোরের মধ্যে ছিলাম। এদিকওদিক কত বাচ্চা দেখা যাচ্ছে-এরা সবাই এতিম!! অথচ আমার….আমি কোনকিছু জিজ্ঞেস না করেই সাইন করে দিলাম। একটু পর দুজন যমজ বাচ্চাকে নিয়ে আসা হল- আহা কি মায়া বাচ্চা দুটোর চেহারায় আর কত ছোট!! আমার হাসবেন্ড বললেন কি হলো তোমার বাচ্চা দুটোকে ধর, আজ থেকে তুমি ওদের মা আর আমি বাবা। আমি কিছু বুঝতে পারছি না কিন্তু তোয়ালে দিয়ে প্যঁচানো দুই বাচ্চাকে দুই হাতে সাবধানে নিয়ে বুকে জড়িয়ে নিলাম। তুলতুলে গাল, ছোট ছোট হাত পা। বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরতেই কি হল জানি না বুকের মধ্যে, তোলপাড় হচ্ছে, চোখ ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে, গলার মধ্যে দলা পাকিয়ে যাচ্ছে। বাচ্চা দুটো শক্ত করে বুকে জড়িয়ে ধরি যেন কেউ নিয়ে নিবে। হাসবেন্ড বলে উঠে আস্তে ওদের বয়স মাত্র ৭ দিন, আমি থতমত খেয়ে তার দিকে তাকালে সে হেসে একজনকে নিয়ে বলল চল এভাবে দাঁড়িয়ে থাকলে এদেরকে মানুষ করবে কিভাবে? আরে তাইতো একটু পরেই ওদের ক্ষুধা লাগবে, বাথরুম পাবে, জামা কাপড়, থাকার ব্যবস্থা কত কিছু করতে হবে, সময় একদম নেই। যেতে যেতেই বললাম আগে বললে না কেন? এখন এতসব এত তারাতারি কিভাবে হবে? তিনি হেসে বললেম তুমি চিন্তা কর না, আমি আছি না!! সব ব্যবস্থা করা আছে, আমিও তো বাবা হয়েছি, আমরা দুজন মিলেই আমাদের বাচ্চাদের মানুষ করব। আমি পরম মমতায় তাদের বুকে জড়িয়ে দৃঢ় পদক্ষেপে এগিয়ে চলি, সামনে আমার অনেক কাজ পড়ে আছে।
আপনার মতামত লিখুন :