কিছু কিছু কথা — দ্বিতীয় পর্ব


ওহাইও সংবাদ প্রকাশের সময় : নভেম্বর ১৪, ২০২২, ১০:৪৯ অপরাহ্ণ /
কিছু কিছু কথা — দ্বিতীয় পর্ব

রাশিদা কামাল

আনার সাথে আমার প্রথম দেখা ২০১৩ সালে। পুরো নাম Ana Arroyo রথীর প্রতিবেশী। আমি আগেও বলেছি সেই আমার প্রথম এদেশে পদার্পণ। কামালের অনুপস্থিতি আমাকে বিপর্যস্ত করে তুলেছিলো। ওর অসংখ্য স্মৃতি এভাবেই জড়িয়েছিলো যে কে বলবে কামাল নেই! টিভি লাউঞ্জে বসলে মনে হয় এখনই টিভি অন করে খবর দেখা শুরু করবে। রকিং চেয়ারে বসে দুলে দিলে খবর দেখবে আর চা খাবে। এ কারণেই রথী চাইলো গরমের ছুটিটা ওর সঙ্গে যেন কাটাই।
আমার যাবার প্রস্তুতি শুরু হলো। অ্যামবেসিতে গেলাম। একটা মেয়ে আমার ইন্টারভিউ নিলো। স্পষ্ট বাংলায় মেয়েটা বলল ,
তুমি কার কাছে যাবে ? কেন যাবে ?
আমি বললাম, ছেলেকে দেখতে যাব।
কতদিন দেখ না ?
দিন না, অনেক বছর দেখি না।
আরও দু একটা মামুলি প্রশ্নের পর বলল, তুমি ভিসা পাবে। তোমার মন খারাপ কেন! যাও ছেলেকে দেখে এসো !

সারোয়ার খান (আমার বেয়াই) তখন সপরিবারে আমেরিকা আসবেন। আমি ওদের সহযাত্রী হলাম। প্লেনে চড়তে আমার ভালো লাগে না! অহেতুক ভয়ে সবসময় সিটিয়ে থাকি। আমাদের গন্তব্য শিকাগো এয়ারপোর্ট। লম্বা এ জার্নির ভয় আর ক্লান্তি দূর করার জন্য অনেক চেষ্টা করেও ব্যর্থ হলাম।
সময় যেন স্থবির হয়ে পড়েছে। এক সময় এক এয়ারহোস্টেজের কাছে জানতে চাইলাম আর কতক্ষণ বাকি!
মেয়েটা আমার কথার উত্তর না দিয়ে চন্দন চর্চিত মুখে আমার দিকে তাকিয়েই রইলো। কাছে এসে নরম সুরে বলল, টিভি দেখবে ? আমি মাথা নাড়িয়ে না বললাম । কিছু খাবে ? এবারও না বললাম । ও আমার দিকে তাকিয়েই রইলো। আমার প্রশ্নের উত্তর দিলো না! মেয়েটা কি আমার মধ্যে ভয় আর ক্লান্তির ছাপ দেখতে পেয়েছিলো! কথাটা জানা হলো না।
এক সময় পৌঁছালাম শিকাগো। সে আর এক কাণ্ড ! লম্বা লাইনে দাঁড়ালাম। স্ক্যানিংডোরের কাছে আসতেই আমাকে আলাদা করে ফেলল। অর্থাত্ লাইনচ্যুত হলাম। একটা মেয়ে এসে আমাকে চেক করে আবার ছেড়েও দিলো। তখন বুঝি নি। পরে বুঝেছিলাম হাতের কয়েকগাছা চুড়ি আর গলার চেন এ জন্য দায়ী।
ওহাইওতে পৌঁছাতেই রথীর সাথে দেখা। অল্প সময়ের মধ্যেই টের পেলাম রথীকে আমি দেখতে পাচ্ছি না! আমার চোখ ঝাপসা। ছোটবেলার মতো কোলের কাছে ধরে রেখে কেবল ওর অস্তিত্ব অনুভব করতে লাগলাম। দুদিন কেটে গেলো গল্প করে আর ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে। দুদিন পর রথী যখন কাজে যাবে তখন ওর সাথে কথা বলতে বলতে ওর গাড়ির পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম। সেই মুহূর্তে পাশের বাড়ির এক মহিলার সাথে দেখা। আমাদের দুজনের দৃষ্টি বিনিময় হলো। আমরা দুজনেই অল্প হাসলাম এ দেশের রীতি অনুযায়ী। মহিলা রথীর কাছে জানতে চাইলো আমি কে! রথী জানালো, আমার মা। সেদিন ওই পর্যন্তই । এরপর মনে হয় আরও দু একবার দেখা হয়েছে। তবে কথা হয় নি। শুধুই হাসি বিনিময়।
একমাস রথীর সাথে কাটিয়ে দেশে ফিরে এলাম। কীভাবে যে একমাস কেটে গেলো তা বুঝতেও পারলাম না। আবার গতানুগতিক কাজে নিজেকে জড়িয়ে ফেললাম।
অনেকটা সময় এভাবেই কেটে গেলো। এরপর আবার মার্কিন মুলুকে এলাম ইমিগ্রেশন ভিসায়। খুশিমনে এদেশে এলেও এবার হিসেবটা মিলল না আমার। এবার আর একমাস না! অনেকদিন থাকতে হবে! আমার এ কথাটা ভাবতে ভালো লাগছে না! হিসেবটা তাই গড়বড়। চলে যাবার জন্য উতলা হলাম। মনে হতো সবকিছু ছেড়ে কেন এসেছি এখানে! কিসের আশায়ই বা পড়ে আছি! রোজ ভোরে সবাই যার যার কাজে চলে যায়। কেবল আমিই একা বসে থাকি এই নির্জন বাড়িতে। কেউ নেই পাশে। নেশাধরা নির্জনতা এক এক সময় অসহ্য লাগতো। রাত আর দিন একাকার হয়ে গেলো। কেউ আমার প্রতীক্ষায় নেই আমারও কারো জন্য প্রতীক্ষা করতে হয় না! কোন কাজ নেই , নেই কোন দায়িত্ব পালনের তাড়াহুড়া। মাঝে মাঝেই মনে হতো আমি বেঁচে আছি তো ! উচ্ছ্বাসহীন, আবেগহীন, অনান্তরিক পরিবেশ আমাকে গ্রাস করতে লাগলো। আমার জানালা বলতে শুধু আমার ফোন। কেউ ফোন করলে ভালো লাগতো। মনে হতো নির্জনতার অবসান ঘটেছে। আমি বেঁচে আছি — কথা বলতে পারছি কারো সাথে। একঘেয়েমি থেকে সেই মুহূর্তে মুক্তি পেতাম। প্রায়ই রথীকে বলতাম আমি চলে যাব। রথী আমার কষ্টটা বুঝতো। নানাভাবে আমাকে বোঝাতে শুরু করতো।
এভাবেই কাটতে লাগলো আমার দিন। লেখালেখির কাজটা বাড়িয়ে দিলাম। আগের চেয়ে অনেক দ্রুত বই লেখা শেষ করতে লাগলাম। এখানে আসার পর আমার সতেরতম বই ‘ বয়ে যায় বেলা ‘ শেষ করলাম। বইটা লিখলাম এ দেশের কথা নিয়ে। ঢাকা গিয়ে বইয়ের মোড়ক খুললাম। ততদিনে এক বছর পেরিয়ে গেছে।
এভাবে মাঝে মাঝেই আনার সাথে দেখা হতো। না , এবার শুধু হাসি বিনিময় না! কথা বিনিময়ও হতো। আনা এদেশের মানুষ। স্বামীর নাম John Hopper . তিন ছেলেমেয়ে।
Ian , Erin , Seth . আনাদের পূর্ব পুরুষ কোন এক সময় স্পেনে বাস করতো। আনা শুনেছে। ও এর বেশি কিছু জানে না।
আনার অভ্যেস বাগান করা। অজস্র ফুল ফোটায় বাগানে। বাগানে কাজ করতে গেলেই ওর সাথে আমার দেখা হতো। কাজ ফেলে চলে আসতো আমার সাথে গল্প করতে। আমাকে দেখে ও এতোটা উচ্ছ্বসিত কেন তা আমি জানি না। কাজ ফেলে ও কেনই বা দৌড়ে আসে তাও জানি না। জানতে চাইলে আনা কেবল হাসে আর বলে তুমি আমার বেস্ট ফ্রেন্ড। তোমার কাছে ছুটে আসব না!
আমি ওর আবেগটা বুঝি। বন্ধুত্বের আবেগ। অনেক সময় আমি কথা না বলে ওর দিকে তাকিয়ে থাকি! সে সময় মনে হয় আমি এখানে একা না! আমার একজন বন্ধু আছে। সময় পেলে প্রায়ই চলে আসে আমার কাছে। ও এলে আমার অলস সময় মুখরতায় ভরে ওঠে। কত রকম গল্প যে করি আমরা! আনার গল্পই বেশি । ওর ছোটবেলা থেকে শুরু করে জনের সাথে পরিচয়, প্রেম, বিয়ে কিছুই বাকি রাখে না। অনেক কথা বলে আমাকে যা কেবল বন্ধুর কাছেই বলা যায়। আর আমি সেই বন্ধু ! সত্যিই আমি এ বয়সে বন্ধুত্বের শক্ত বন্ধনে জড়িয়ে পড়লাম। মাঝে মাঝে আনা বলে, তুমি শুধু আমার বন্ধু নও, তুমি আমার বোন। মনের ভেতরটা তখন নাড়া খায়! নির্মল বন্ধুত্ব দেশ কালের বিভেদ মানে না! এর কাছে সব ভাবনাই মুখ থুবড়ে পড়ে। এতোদিন পরে কথাটা নতুন করে অনুভব করলাম। কোভিডের সময় একটু দূরে দূওে থাকলাম। একদিন ওর সাথে দেখা। ও কোভিডের পরোয়া না করে আমাকে আগের মতোই জড়িয়ে ধরলো। জড়িয়েই থাকলো অনেকক্ষণ। আমি বললাম, ছফুট দূরত্বের কথা কি ভুলে গেলে ?
তোমার বেলায় ভুলে গেলাম। এই দূরত্ব আমাদের জন্য না!
কথাটা বলে ও হাসলো। আমার বুকের ভেতরটা আবার নাড়া খেলো। নাড়া সব সময়ই খায়।
বাগান করার পাশাপাশি ও শনিবার রবিবার চার্চে যায়। চার্চ পরিষ্কার করে , হোমলেসদের খাবার দেয়। বয়স্ক মানুষদের বিভিন্ন কাজে সাহায্য করে। অনেক সময় খাবার ডেলিভারি করে। সারাদিন নিজেকে ব্যস্ত রাখে নানা কাজে।
ফুল-পাখি, জোছনা, সকাল-বিকেলের নরম রোদ আমার যেমন প্রিয় তেমনি আনাও আমার খুব প্রিয়। ও কাছে এলে আমার একাকীত্ব কেটে যায়। ভোরের আলো না ফুটতেই আমার জানালার আলসেতে বসা ঘুঘুদম্পতির মতোই আনা আমার কাছে পরম কাঙ্ক্ষিত একজন মানুষ — একজন বন্ধু ।