গ্রন্থনা ও উপস্থাপনা : সারওয়ার খান
মধ্য দুপুরের মিঠে কড়া রোদ গায়ে মেখে ওহাইও বিশ্ববিদ্যালয়ের দৃষ্টি নন্দন ক্যাম্পাসের ম্যাটারিয়েল সাইন্স এন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের লবিতে যথা সময়ে যেয়ে পৌছালাম আমি ও ওহাইও সংবাদ এর সম্পাদক জনাব লিটন কবির। কিছুক্ষনের মধ্যেই ডক্টর শেখ আলী আকবর চলে এলেন আমাদের অভ্যর্থনা জানাতে। আমাদের সাথে করে নিয়ে গেলেন তার বিভাগীয় চেম্বারে।
কুশলাদি বিনিময়ের পর শুরু হলো আলাপচারিতা। ডক্টর শেখ আলী আকবর চলে গেলেন তার ছোটবেলায়। ফরিদপুর জেলার গোপালগঞ্জ এর বড়ফা গ্রামের এক সাধারন পরিবারে ১৯৫৫ সালে জনাব শেখ আলী আকবর এর জন্ম। বাবার চাকরির সুবাদে একদম ছোট বয়সেই চলে আসেন খুলনায়। রুপসা পাড়ের দীঘলিয়া উপজেলার চন্দনিমহলে কেটেছে তার ছেলেবেলা। দারিদ্রতার কষাঘাত অনুভব করেছেন সেই ছোট বেলা থেকেই। প্রাথমিক শিক্ষায় শিক্ষিত পিতা ও নিরক্ষর মাতার নিরলস প্রচেষ্টা তাকে এগিয়ে যাবার সাহস ও উৎসাহ জুগিয়েছে। আর্থিক সীমাবদ্ধতার কারনে তার পিতাকে অতি অল্প বয়সেই সংসারের হাল ধরতে হয়। পিতার পড়ালেখা তাই আর বেশীদুর আগায়নি। জনাব শেখ আলী আকবরের মাতাও প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার সুযোগ পান নাই। তারপরও সন্তান আকবরের শিক্ষায় তারা যথেষ্ট সাহস ও উৎসাহ জুগিয়েছেন। দারিগ্রতাকে জয় করে অদম্য সাহসও মনোবলকে পুজি করে এগিয়ে যাবার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত আমাদের আজকের ডক্টর শেখ আলী আকবর। ছোটবেলার দারিদ্রতা ও স্বল্প শিক্ষিত পিতা মাতার নিরলস প্রচেষ্টা তার জীবনের চলার পথের উল্লেখ যোগ্য পাথেয় ছিল, তা এখনো অকপটে বর্ণনা করে অন্যদেরকেও অনুপ্রানিত করেন।
খালিশপুর হাইস্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাশ করে দৌলতপুর বিএল কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পর্ব শেষে চলে গেলেন ঢাকায়। ভর্তি হলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগে। সদ্য স্বাধীন হওয়া বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা তখন অনিশ্চয়তার নগরী। এরই মাঝে তরুণ শেখ আলী আকবরের লক্ষ্যে পৌছানোর সংগ্রাম। ১৯৭৫ এ পদার্থ বিজ্ঞানে উচ্চতর শিক্ষার লক্ষ্যে চলে গেলেন বুলগেরিয়ায়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালীন সময়ে জনাব শেখ আলী আকবর এর জীবনের ছন্দে আসে অভাবনীয় পরিবর্তন। পরিচয় হয় তাহমিনা পারভীন এর সাথে, শুরু হয় জীবনের আরেক অধ্যায়। প্রয়োজন এর তাগিদে শুরু করেন টিউশনি। ভাল ছাত্রী তাহমিনা পারভীন এক সময় হয়ে যান ভালবাসার পাত্রী। স্বপ্ন বুনতে থাকেন দুজনে। এরি মাঝে বুলগেরিয়ায় উচ্চ শিক্ষার সুযোগ পাওয়ায় ভালবাসাকে প্রতিশ্রুতি দিয়ে পাড়ি জমান অধ্যাবসায়ের তাগিদে। প্রতিশ্রুতি পুরনের সুযোগ আসে আরো পরে ১৯৮১ তে। দুজনে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে শুরু করেন নতুন পথ চলা।
বুলগেরিয়ায় তৎকালীন সময়ে সকল শিক্ষার্থীকে এক বছরের ভাষা শিক্ষা কোর্স শেষ করতে হতো। ১৯৭৫ এ বুলগেরিয়ার অধ্যায়ন পর্ব শুরু হলেও ডিগ্রী পেতে ১৯৮০ সাল গড়িয়ে যায়। পরবর্তী অধ্যায় আরো হৃদয় গ্রাহী। বর্ননার সময় ডক্টর আকবরের অভিব্যক্তিতে ফুটে উঠে শিক্ষকের প্রতি ছাত্রের শ্রদ্ধা ভালবাসা। প্রানের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের প্রিয়শিক্ষক ডক্টর শফি চৌধুরীর সহায়তায় যোগাযোগ হয় আমেরিকার ওহাইওর সিনসিনাটি ইউনিভার্সিটির প্রফেসর গুডম্যান এর সাথে। শুরু হলো শিক্ষা জীবনের আরেক অধ্যায়।
১৯৮০ সালের শেষ ভাগে আমেরিকার অজানার উদ্দেশ্যে পাড়ি জমান জনাব আকবর। রোদ্রকোজ্জল এক সকালে এসে নামলেন ওয়াশিংটন ডি সি এয়ারপোর্টে। গন্তব্য ওহাইও অঙ্গ রাজ্যের সিনসিনাটি শহর। বাজেট স্বল্পতার কারনে যাত্রা শুরু হলো ট্রেনে। আমেরিকায় তখন ফল ঋতু। চারিপাশের প্রকৃতি সেজেছে বাহারি রঙে। বিমোহিত জনাব শেখ আলী আকবর এসে পৌছালেন সিনসিনাটি ইউনিভার্সিটিতে। প্রফেসর গুডম্যান এর তত্বাবধানে শুরু হলো শিক্ষা জীবন এর নতুন অধ্যায়। পরবর্তীতে ১৯৮৫ সালে ইন্ডিয়ানা পাড়ডু ইউনিভার্সিটি থেকে প্রফেসর হিরোশী সাটো এর নির্দেশনায় ম্যাটেরিয়াল সাইন্স এন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং এর উপর পিএইচডি ডিগ্রী অর্জন করেন শেখ আলী আকবর।
১৯৮৭ সালে শুরু হলো জীবনের আরেক অধ্যায়, যা এখনো চলমান আছে। ওহাইও ষ্টেট ইউনিভার্সিটির ম্যাটেরিয়াল ইন্জিনিয়ারিং বিভাগে শুরু করেন শিক্ষকতা। অদ্যাবধি ঐ বিভাগেই সুনামের সাথে কর্মরত আছেন। চলতি সেসনে ২০ জন ছাত্র ছাত্রীর পিএইচডির একটি কোর্সে পড়াচ্ছেন ডক্টর শেখ আলী আকবর। এর মধ্যে তিন জন বাংলাদেশী ছাত্র আছে বলে তিনি জানান।
ডক্টর শেখ আলী আকবরের মূল মৌলিক গবেষণা সেন্সর নিয়ে। ২০০৫ ও ২০০৭ সালে সেরা একশ উদ্ভাবনের মাঝে আর এন্ড ডি ক্যাটাগরিতে ডক্টর শেখ আলী আকবর সেন্সর তিনটি সেরা উদ্ভাবনের এওয়ার্ড প্রাপ্ত হয়। ২০০৫ সালে নাসার টিজিআইআর (টারনিং গোল ইনটু রিয়ালিটি) এওয়ার্ড প্রাপ্ত হয় তার সেন্সর গবেষণা।
ন্যাশনাল সাইন্স ফাউন্ডেশন (এনএসএফ) অর্থায়নে ওহাইও ষ্টেট ইউনিভার্সিটির সেন্টার ফর ইনডাষ্ট্রিয়েল সেন্সর এন্ড মেজারমেন্টস (সিআইএসএম) প্রতিষ্ঠা করেন ডক্টর শেখ আলী আাকবর।
ওহাইও ষ্টেট ইউনিভার্সিটির ম্যাটেরিয়াল সাইন্স এন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শিক্ষকতায় অসামান্য অবদানের জন্য ২০১৬ ও ২০১৭ সালে ডক্টর শেখ আলী আাকবরকে ‘মার্স জি ফন্টানা’ পদকে সম্মানিত করা হয়।
তিন কন্যা সন্তানের জনক জননী ডক্টর শেখ আলী আকবর ও মিসেস তাহমিনা পারভীন তাদের পারিবারিক জীবনেও সুখী দম্পতি। ওহাইও ষ্টেট ইউনিভার্সিটিতে পড়তে আসা বাংলাদেশী ছাত্র ছাত্রী সকলের নির্ভর যোগ্য অবিভাবক। ছাত্র ছাত্রী সকলের প্রতি কঠোর পরিশ্রমের পরামর্শ দাতা। ওহাইও এর বাংলাদেশী জনগোষ্ঠীর গর্বের সম্মানিত জন ডক্টর শেখ আলী আাকবর।
আপনার মতামত লিখুন :