ভাঙ্গন


ওহাইও সংবাদ প্রকাশের সময় : অক্টোবর ৩০, ২০২২, ১১:০০ অপরাহ্ণ /
ভাঙ্গন

আসমা-উল-হুসনা

-ক্রিং ক্রিং ক্রিং
– হ্যালো, লাবণ্য বলো
– কি কর?
– কি আর করব, বাচ্চাদের সাথে সময় কাটাচ্ছি।
– বাহ, বেশ মজায় আছ মনে হচ্ছে।
– হু আছি, তা তুমি ফিরবে কখন?
– প্রতিদিনের মতই, সাড়ে পাচটা। রাব্বী আজকে তো তুমি বাসায়ই আছ, চল না বিকালে কোথাও ঘুরতে যাই, আজ আমরা ডেটিং এ যাব।
– হো হো করে হেসে উঠল রাব্বী, তাই নাকি? ঠিক আছে।
বিকালে বাসার সামনে এসে লাবণ্য কল দিল রাব্বীকে,
– আমি বাসার নিচে, নেমে এস।
– আসছি বলেই ফোন কেটে দিল রাব্বী
একটু পরেই সবাই নিচে নেমে আসলো। ছেলে-মেয়ে, রাব্বী, ননদ হৈ চৈ করতে করতে গাড়িতে উঠে পরল। লাবণ্যর একটু মন খারাপ হয়ে গেল। সে খুব চাচ্ছিল সে আর রাব্বী একা কিছু সময় কাটাতে। কতদিন তারা নিজেরা আলাদাভাবে সময় কাটায় না। লাবণ্য একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল।
রাতে ডিনার সেরে বাসায় ফিরে কাপড় চেঞ্জ করতে করতে লাবণ্য বলল
– বললাম আমরা ডেটিং এ যাব, আর তুমি সবাইকে নিয়ে রেডি হলে?
– তো, ওদেরকে ছেড়ে কিভাবে যাব? তাছাড়া ওদেরকে কি বলতাম কোথায় যাই?
– কি আশ্চর্য, সব সময়তো না বলেই বাইরে যাও। বলতে পারতে আমাকে নিয়ে বাইরে যাচ্ছ, কাজ আছে, না পারলে আমাকে বলতে, আমিই না হয় বলে দিতাম।
– আরে কি অবাক? ওরাতো তোমার নিজেরই বাচ্চা, ওদেরকে নেওয়ায় এত রিয়াক্ট করছো কেন?
– সব সময়তো ওদেরকে নিয়েই যাই, আজকে শুধু তোমার সাথে একা সময় কাটাতে চাচ্ছিলাম।
– প্রতিদিনতো বাসাতেই ফিরি, তোমার সাথেই থাকি, আলাদা করে সময় কাটানোর কি হল?
– কেন আমরা কি শুধু দুজন কিছু সময় কাটাতে পারি না? আগেতো আমরা প্রতিদিনই কোথাও না কোথাও ঘুড়তে যেতাম।
– লাবণ্য তুমি বাচ্চাদের মত কথা বলছ। তোমাকে বুঝতে হবে এখন সংসার বড় হয়েছে। আমাদেরও বয়স বেড়েছে, এই সব নাটক এখন আমাদের মানায় না।
– নাটক? সংসার বড় হয়েছে, বয়স হয়েছে তাই বলে কি মনও মরে গিয়েছে? আমি অনেকদিন ধরেই দেখছি আমার কোন কিছুই তোমার ভালো লাগে না। সত্যি করে বলত তুমি কি আমাকে আর ভালোবাসো না?
– ধুর তোমার এসব পেঁচাল আর একদম ভাল লাগে না। আমি তো সব কিছু বাচ্চাদের জন্যই করছি। ভাল না বাসলে কি এগুলো করতাম।
– সে তো তুমি বাচ্চাদের জন্য করছ? কিন্তু আমি?…।।
– আরে কি কথা!ওরা তো তোমার থেকেই এসেছে, ওদেরকে ভালোবাসা মানেইতো তোমাকে ভালোবাসা তাই না? তোমার মন এত ছোট কেন? নিজের ছেলেমেয়েকেও হিংসা?
এই বলেই সে রুম থেকে বের হয়ে যায়। লাবণ্য জানে রাব্বী আজ আর এ রুমে আসবে না। আগে লাবণ্য যেত অনেক সরি টরি বলে মানাত। এখন আর ইচ্ছে করে না। রাব্বীও আর আসে না। চোখের কোনে পানি জমে লাবণ্যর, দীর্ঘশ্বাস ফেলে বার বার। আহা কি চিন্তা করল আর কি হল? কি সুন্দরই না হতে পারত আজকের দিনটা। অথচ যাবার আগে কি কথাটাই না বলে গেল। সে নিজের ছেলে মেয়েকে হিংসা কর? কিভাবে বলতে পারল রাব্বী? সে কি জানে না লাবণ্য কি না করে বাচ্চাদের জন্য।
লাবণ্যের বয়স চল্লিশের কাছাকাছি। আত্মীয় স্বজন, বন্ধু বান্ধব, স্বামী, ছেলে মেয়ে নিয়েই তার জীবন। ছেলে মেয়ে ভালো স্কুলে পড়াশুনা করে, স্বামী উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তা সে নিজেও যথেষ্ট শিক্ষিত এবং ভাল একজন চাকুরীজীবী। আত্নীয়তা, সামাজিকতা, দেশ বিদেশ ঘোরা সব মিলে চমৎকার সাজানো এক সংসার। জীবনের বহু চড়াই উৎরাই পেরিয়ে আজ সমাজে এক অবস্থান তৈরী করেছে।
কিন্তু লাবণ্যের মধ্যে কোথায় যেন এক হাহাকার, কাউকে বলতে গেলে সে নিশ্চয়ই হাসবে, বলবে সুখে থাকলে ভুতে কিলায়। বিয়ের শুরুতে তাদের মধ্যে বেশ প্রেম ছিল কিন্তু সে প্রেম যে কিভাবে রঙ বদলালো, ফিকে হয়ে গেল, তারপর কি হারিয়েই গেল? লাবণ্য সব ধরনের চেষ্টা করে দেখেছে কিন্তু কেন এমন হচ্ছে কিছুই তার মাথায় আসে না।
এইতো কয়েক দিন আগের কথা লাবণ্য ঘুমাতে গিয়ে রাব্বীকে জড়ীয়ে ধরেছিল। সাথে সাথে রাব্বী বলে উঠল সরে ঘুমাওতো গরম লাগে। অথচ এই রাব্বী কি না করত আগে। পাশ ফিরে ছুয়েছিল লাবণ্য, নিরবে চোখের পানি ফেলেছিল অনেক। কিন্তু পরেরদিন এমন স্বাভাবিক ব্যাবহার করল রাব্বী যেন কিছুই হয় নি। তাই মাঝে মাঝেই লাবন্য কনফিউজড হয়ে পরে। এরকম ঘটনা প্রায়ই হয় কোন না কোন ভাবে রাব্বী লাবণ্য কে আহত করে। লজ্জা, অপমানে ছোট হয়ে যায় সে। কি বলবে, কি করবে, কেন এমন হচ্ছে এসব ভাবতে ভাবতে নিজের জগৎটাই ছোট গেছে তার। তাদের ঘরের চার দেওয়ালের ভিতর ভালোবাসা খেলা করে না। শারিরিক চাহিদা পুরন হয় মাত্র। রাব্বী ভুলেই যায় লাবণ্যও একজন মানুষ, যার জগতের কেন্দ্রবিন্দুই রাব্বী। তারও যে কিছু চাহিদা থাকতে পারে, ইচ্ছে হতে পারে কারো বুকে মাথা রেখে গুটিশুটি মেরে ঘুমাতে। ইচ্ছে হতে পারে কারো কাছে ছোট বড় আবদার করতে। ইচ্ছে হতে পারে কেউ হাতে হাত রেখে বলুক তোমার সাথেই আছি। কিন্তু সেরকম কিছুই হয় না। বরং বলতে গেলেই ঝগরা-ঝাটি, রাগ, বাজে কথা। পরিবার, সমাজের সাথে তাল মিলিয়ে যন্ত্রের মত ছুটছে সে।
অথচ লাবণ্য স্মার্টলি চলাফেরা করে। একটা নামকরা প্রতিষ্টানে কাজ করে। অনেক মানুষের সাথে তাকে মিশতে হয়, তাদের চোখে তার জন্য মুগ্ধতা দেখে। তারা তার কাজের, বুদ্ধির প্রশংসা করে, তার স্মার্টনেসের প্রশংসা করে। কত ধরন পুরুষ সে দেখে, তাদের চোখের দৃষ্টির কত রকম ভাষা।
প্রথমদিকে সে অনেকবার জানার চেষ্টা করে দেখেছে, ভেবেছে হয়ত তার নিজের মধ্যেই কোন কমতি আছে। তাই সে রাব্বীর পছন্দমত সব করার চেষ্টা করে দেখেছে। অফিস থেকে ফিরেই ঘর দোর গুছানো, শ্বশুর- শ্বাশুরীর যত্ন নেয়া, রান্না বান্না, বাজার সদাই সব দিক থেকেই সে একজন ভালো বউ হবার চেষ্টা করেছে। কতবার সে রাব্বীর সাথে খোলামেলা ভাবে কথা বলার চেষ্টা করেছে কিন্তু রাব্বী নিরুত্তাপ। তার এক কথা সবই তো ঠিক আছে। প্রশ্ন করলে রেগে যায় এত প্রশ্ন কর কেন? দেরি করে ফিরলে জিজ্ঞেস করলে বলে কাজে ছিলো । ভিতরে ভিতরে ভেংগে যাচ্ছিল সে, হতাশা দানা বাধছিল মনে। অনুনয়, বিনয়, রাগ, অভিমান, চোখের কান্না কোন কিছুই যেন রাব্বীকে টানে না। সে রাব্বীকে বলেছে চল আমরা আলাদা হয়ে যাই? এভাবে আমি আর পারছি না। তার এক কথা আর কি চাও? আর কি লাগবে তোমার? তোমার এত কিসের চাহিদা? আহা অফিসটা করে বলেই হয়ত এখনও সে সুন্দরভাবে শ্বাস নিতে পারছে।
অফিস করছিল লাবণ্য, ম্যসেঞ্জারে টুং করে উঠতেই লাবণ্য চেক করে দেখল রিশাব,
– হ্যালো
– রিশাব!! কতদিন পর!! কমপক্ষে ১৫ বছর ।
– না, ১
– না, ১৮ বছর ৩ মাস ৯ দিন।
– বাহবা, ছেলেরা আবার দিন ক্ষণ এত মনে রাখে নাকি?
– সব সময় রাখে না কিন্তু …
– কিন্তু কি?
– কিছু না, কেমন আছিস বল?
-হ্যা, ভালই, তোর খবর কি?
এভাবেই কথা এগুতে থাকে। বেশ ভালই লাগে লাবণ্যর। দু একদিন পর পর ই রিশাব খোঁজ খবর নেয়। মাঝে মাঝে ফোনেও কথা হয়। প্রথমে তো তারা দূরত্ব রেখেই কথাবার্তা চালাতে থাকে। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে মুখোশ খসে যায়, একজন আরেকজনের ভিতরের কথা জানতে পারে, বুঝতে পারে, অনুভব করতে পারে। পুরানো কত কথাও মনে পড়ে যায়। সব মনে আছে রিশবের, সব। ইদানিং সেও অপেক্ষা করে রিশবের এস,এম,এস এর। ভালো লাগে তার কেয়ারিং। মনের জানালায় কোথায় যেন ভালোলাগার দরজা খুলে যায়। সে আবার আগের মত চিন্তা করে, রোমান্টিক গান শুনে, নতুন করে সাজতে ইচ্ছা করে, সাজাতে ইচ্ছা করে, হঠাৎ করেই বুঝতে পারে সব শেষ হয়ে যায় নি। বয়স ও ব্যাপার না সে সেই পুরানো দিনের মতই প্রেমকে অনুভব করতে পারে, নতুন করে বাঁচতে ইচ্ছা করে। একদিন রিশব বলল
-একদিন আয় আমরা দেখা করি। এক কাপ কফিতো আমরা খেতেই পারি একসাথে তাই না?
শংকা হয়, ভয় হয়, জড়তা কাজ করে, পিছুটান অনেক কিন্তু চিন্তা করে পুরানো বন্ধুর সাথে রেস্টুরেন্ট এ বসে এক কাপ চাই তো খাবে, এটা এমন কি?
-ঠিক আছে।
কফিসপে দুজনেই কিছু সময় কাটায়, বেশি কথা হয় না। নিজেদের পরিবারের কথা, পুরানো কিছু কথা কিন্তু না বলা অনেক কথা যেন চোখের দিকে তাকিয়েই বুঝতে পারে তারা। ফিরে যায় যার যার গন্তব্যে।
কি ছিল রিশবের চোখে? লাবণ্যকে অত টানে কেন ঐ চোখ? রিশব কিভাবে এত বুঝে ওকে? ভয় হয় তারা আবার তাদের লিমিট ক্রস করে না ফেলে। লাবণ্য ঠিক করে আর কোনদিন সে দেখা করবে না রিশবের সাথে। তার সমাজ, সংসার, বাচ্চা-কাচ্চা, মান-সন্মান, বয়স এগুলোর কথা চিন্তা করে। না শুধু তার ভালোলাগার জন্য, তার জীবনের জন্য কোন কিছুই নষ্ট হতে দেবে না।
সে বাসায় ফিরে রাব্বীর পছন্দমত রান্না করে। বাচ্চাদের সবকিছু গুছ গাছ করে গোসল করে হাল্কা সাজগোজ করে অপেক্ষা করে রাব্বীর। রাব্বী বাসায় ফিরলে বেশ উৎফুল্লতার সাথে কথা বলে, খাবার টেবিলে বসে গল্প করে। কিন্তু রাব্বীর এসব বিষয় যেন নজরেই আসে না।
রাতে ঘুমাতে গিয়ে রাব্বীর গালে আংগুল ছোয়াতে গেলেই হাত সড়িয়ে দিয়ে বলে উঠে হাত সরাওতো, তোমার হাতে রসুন পেয়াজের গন্ধ। অসহ্য। লাবণ্য আর সহ্য করতে পারেনা। তার মনে হল জীবন তো একটাই। একটা ঘন্টা ভাল থাকাও যেন অনেক বড় পাওনা। রিশবের চোখে কি মুগ্ধতা, কি আকুতি!! কত কেয়ারিং, অথচ যার জন্য সব করছে সেই তাকে অবহেলা করে যাচ্ছে অহর্নিশি। আজ আর লাবণ্যর চোখে পানি নেই। তার মনে হয় অনেক সুযোগ সে দিয়েছে সে রাব্বীকে। ভবিষৎ এর চিন্তা সে আর করে না। লাজ লজ্জা, সমাজ, সংসার, মান সন্মানের চিন্তা তার মধ্যে কাজ করে না। সে নিজেই এস, এম, এস পাঠায় রিশবকে আমরা কি দেখা করতে পারি?