রাশিদা কামাল :
আমার রুমটা পুবমুখী। সূর্য তখনও ওঠে না। তবে ওর গোলাপি নরম আভাটা ছড়িয়ে পড়ে আকাশের পুবপ্রান্তে। আর সেই গোলাপি আভার ছোঁয়া লাগে আমার জানালার সার্শিতে। তখন হয়তো মৃদুমন্দ বাতাসও বয়ে যায়! হয়তো বলছি এ কারণে গোলাপি কোমল আভাটা আমার চোখে পড়ে না! আমার ঘুম ভাঙে ঘুঘু দম্পতির মিষ্টি আলাপনে। ওদের হালকা ডানা ঝাপটানি আর মৃদু পদচারণায় আমি জেগে উঠি।
আমার জানালার আলসেতে এক ঘুঘু দম্পতি এসে গা ঘেঁষে বসে। কিছুক্ষণের মধ্যেই ডাকতে শুরু করে। আমি পাখি বিশারদ নই। তবু মনে হয় দুজন একসাথে ডাকে না! একজন একজন করে ডাকে।
বাইরেটা তখনও অন্ধকারের রহস্যে ঢাকা! গাঢ় অন্ধকার না! আলোছায়ার রহস্যময় অন্ধকার। এই রহস্যে ঢাকা ভোরবেলাটা আমার খুব প্রিয়! শান্ত স্নিগ্ধ পরিবেশটা আমায় ছুঁয়ে থাকে। এ সময় নামাজ পড়তে, কুরআন পড়তে খুব ভালো লাগে। আরও একটা কাজ ভালো লাগে — লিখতে ইচ্ছে হয় তখন। লিখতে বসেও যাই।
ঢাকায় আমার বাড়ির সামনে একটা নদী আছে। নদী না! তুরাগের একটা শাখা। একসময় স্রোতশীলা ছিলো। এখন নেই। তবুও বর্ষায় যখন যৌবনবতী হয় তখন ভালোই লাগে! আমি জানালার পাশে বসে নদীটাকে সামনে রেখে লিখতে থাকি। নদীর কুঁচিকুঁচি ঢেউ আমাকে লিখতে সাহায্য করে। নদীর পাড়ে একটা মেহগিনি আর কাঁঠাল গাছ লাগিয়েছি। না, ফলের আশায় না — মেহগিনি আর কাঁঠাল পাতার ঘন ছায়ার প্রত্যাশায়। নদীর পাড়ে বাড়ি বলে কিছু পাখি এসে বসে গাছের শাখায়। ঘন পল্লবের স্তুপের আড়ালে ওরাও গা ঘেঁষে বসে! আমি ওদের মুগ্ধ দৃষ্টিতে দেখি! তখনও শহরের ঘুম ভাঙে না। তাই হয়তো নিশ্চিন্তে গা ঘেঁষে বসে।
আমার জানালার ঘুঘু দম্পতি আমাকে দেখে না। আমি ওদের দেখি। একটু দূরে থেকেই দেখি। কাছে গেলে যদি উড়ে যায় ! থাকুক ওরা ওদের মতো করে। মনে হয় আমি একা না! ওরাও আছে আমার কাছে!
দম্পতি — জায়া আর পতি। অর্থাত্ স্বামী ও স্ত্রী। এই ঘুঘু দম্পতির সুরেলা কণ্ঠ নেশাধরা নির্জনতার অবসান ঘটায়। দারুণ লাগে তখন। ডানা ঝাপটায় আর ওদের অস্তিত্ব ঘোষণা করে।
ঘুঘু নাগরিক পাখি। তবুও আমার ধারনা নগরবাসীর ছোঁয়া বাঁচিয়ে ওরা নিজেদের মধ্যে থাকতেই পছন্দ করে! আস্তে আস্তে গোলাপি আভা অপসৃত হয়। পুরো আকাশে প্রতিভাত হয় কমলা রঙের নরম ছটা। একটা কমলা বল সকাল ঘোষণা করে। ওরা হয়তো এই সকালের নরম আলোর প্রত্যাশায় থাকে! হয়তো আমাদের মতো আবেগে কেঁপে ওঠে!
সকাল বেলা আমি নস্টালজিক হয়ে পড়ি। ঘুঘুদম্পতির মতো নদীটাও আমার মনে এসে ধরা দেয়। ছায়াঘন কাঁঠাল আর মেহগিনি গাছের সবুজ পাতা আমাকে হাতছানি দেয়। মৃদুমন্দ বাতাসে দুলছে গাছের শাখা। পাখিরা দোল খায় সে শাখায় বসে। বহতা নদী, নদীর ওপর নীলাকাশ, পাড়ের মেহগিনি আর কাঁঠাল গাছ, নদীর ওপারের দিগন্তরেখা আমায় নস্টালজিক করে!
কখনও কখনও খুঁজে ফিরি আমার শৈশবকে! সে একটা দারুণ সময় ছিলো! ছোট ছোট শহরগুলিতে তখন বিদ্যুত ছিলো না! ছিলো না টিভি ! রেডিওই সম্বল। সিনেমা শুধু বড়দের জন্য! ছোটরা তা ভাবতেও পারতো না! তবে মেলা বসতো। সেখানে থাকতো আনন্দের নানা উপকরণ ! কালীপুজোর মেলায় যেতাম তখন। কতকিছু যে কিনতাম! বাঁশি কেনা ছিলো একটা নেশা। আর পুতুলনাচ ছিলো আমার প্রিয় আইটেম। নিঃশ্বাস বন্ধ করে দেখতাম পুতুলের নাচ! নাগরদোলায় ভয়ে চড়তাম না। রাতে দেখতে যেতাম সার্কাস। জোকারদের খুব ভালো লাগতো! এসব দেখে খুশিমনে বাসায় ফিরতাম। ফাঁকে ফাঁকে বাঁশিতে সুর তুলতাম। মেলায় বাতাসা নামের একটা মিষ্টি খাবার পাওয়া যেতো। এখন আর হয়তো পাওয়া যায় না! তবে হাওয়াই মিঠাই এখনও আছে। ‘কী চমত্কার দেখা গেল’ নামে বাক্সে চোখ লাগিয়ে বায়োস্কোপ দেখতাম। মুড়ি-মুড়কি ছিলো অঢেল। ঝালমুড়ি আর ফুচকার
প্রচলন শুরু হয় নি তখনও । এখন অবশ্য মেলায় এ দুটি খাবারই প্রধান আকর্ষণ!
মেলার কটা দিন খুব ভালো কাটতো! সময়ের সাথে সাথে কতকিছু পাল্টে যায়! তবুও আমি খুঁজে ফিরি শৈশবের ফেলে আসা সেই সোনালি দিনগুলি! তালপাতার পাখা আর বাঁশি পাওয়া যায় কিনা জানি না! আমি কিন্তু খুঁজি সেই বাঁশি যার ভেতরে আমার শৈশবের মধুর সুর লুকিয়ে আছে! খুঁজি হাওয়াই মিঠাই, বাতাসা, ‘কী চমত্কার দেখাগেলো’ র বায়োস্কোপ। জানি খোঁজা বৃথা! তবুও জীবনের ফেলে আসা রঙিন দিনগুলির কথা ভুলি কী করে! এখনও সেসব স্মৃতি মনে ঢেউ তোলে। তাই আমি নস্টালজিক হই বার বার!
আমার ধারনা আমার মতোই ফেলে আসা স্মৃতিমেদুর দিনগুলি অনেকেই খুঁজে ফেরেন! নস্টালজিক হন আমারই মতো। হয়তো হারিয়ে যান সেই ফেলে আসা দিনগুলিতে। স্মৃতিরা হয়তো পায়ে পায়ে এগিয়ে আসে। স্মৃতিরাও তো ভালোবাসার অংশ! লেপটে থাকুক তারা আমাদের প্রাত্যহিক জীবনের সঙ্গে ।
লেখক : শিক্ষক , কথা সাহিত্যিক
আপনার মতামত লিখুন :