আমেরিকায় আমাদের নতুন প্রজন্ম – মিজান রহমান নিউইয়র্ক


ওহাইও সংবাদ প্রকাশের সময় : নভেম্বর ৯, ২০২৩, ১০:৩৮ অপরাহ্ণ /
আমেরিকায় আমাদের নতুন প্রজন্ম – মিজান রহমান নিউইয়র্ক
ধারাবাহিক- ৩১
আমার গত সপ্তাহের ইমিগ্রান্ট পরিবারের আর্থিক পরিকল্পনার পরামর্শের ধারাবাহিকতায় এই সপ্তাহে এবং পরবর্তী কয়েক সংখ্যায় এ বিষয়ে আরো কিছু আলোকপাত করার কথা। আদর্শিকভাবে বলতে গেলে বলতে হয় যে ব্যক্তিগত আর্থিক স্বনির্ভরতা অর্জনের জন্য টাকা-পয়সা উপার্জনের পরপরই প্রথমে তার কিছুটা সঞ্চয় ও বিনিয়োগ করা বুদ্ধিমানের কাজ এবং তারপর প্রয়োজনে ব্যয় করার অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। অবশ্য বাস্তব ক্ষেত্রে এই জাতীয় লোকের সংখ্যা খুবই কম, কেননা বেশিরভাগ মানুষই ভাবে আগে দরকার মত বা শখ-আহলাদের জন্য খরচ করে নিই, তারপর যা থাকবে তা থেকে কিছুটা ভবিষ্যতের জন্য হয়তো জমা করব। এই মানসিকতার কারণেই বেশির ভাগ মানুষ বিপদে-আপদে অথবা কোনো গুরুত্বপূর্ণ প্রয়োজনের সময় আর্থিক দীনতায় ভোগেন। কারণ, নিয়মিত সঞ্চয় করার অভ্যাস গড়াটা সহজ ব্যাপার নয়। তাছাড়া একটা সংসারে টাকা-পয়সা খরচের অজুহাতের কোনো সীমা নেই। সুতরাং আগেভাগে কিছু টাকা জমিয়ে না রাখলে ভবিষ্যতের জন্য টাকা জমানোটা কঠিন হয়ে পড়ে।
তদুপরি নতুন ইমিগ্রান্ট পরিবারগুলোকে সাধারণত বিভিন্ন রকমের বিড়ম্বনায় ভুগতে হয় এবং অনেক ধরণের বাড়তি দায়িত্ব বহন করতে হয়। যেমন নিজ দেশে রেখে আসা আত্মীয়-স্বজনদের আর্থিকভাবে সাহায্য করা। যার প্রেক্ষিতে তারা হয়তো এদেশে আগমনের শুরু থেকে অনেক দেরি পর্যন্ত যথাযথ সঞ্চয় ও ট্যাক্স সেভিংসের সুযোগ নিতে অপারগ হন। তারা অনেক সময় ব্যক্তিগত বা পারিবারিক আর্থিক পরিকল্পনার ঝুঁকি-লাঘবে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে দ্বিধান্বিত থাকেন। যেমন উপার্জনক্ষম কর্তাব্যক্তির ভবিষ্যৎ উপার্জন রক্ষার্থে লাইফ ইন্সুরেন্স (জীবন বীমা) বা ডিজ্যাবিলিটি ইনকাল ইন্সুরেন্স (অসুস্থতা বা কোনো দুর্ঘটনাজনিত কারণে সে ব্যক্তি যদি তার পেশাগত কর্মক্ষমতা হারায় সেক্ষেত্রে যাতে পরিবারটি আর্থিক দীনতায় না ভোগে) করার ব্যাপারে গড়িমসি করেন। তারা কিন্তু আইন অনুযায়ী এবং প্রয়োজনীয় অন্য সব ধরণের বীমা ঠিকই করেন- যেমন গাড়ি-বীমা, বাড়ি-সীমা, দায়গত-বীমা, ব্যবসায়িক-বীমা অথবা প্রফেশনাল ম্যালপ্রাকটিস-ইন্সুরেন্স ইত্যাদি।
একটি সুন্দর বাড়ির স্থিতিশীলতা ও মজবুতী যেমন সেই বাড়ির ভিত্তিপ্রস্তরের ওপর নির্ভর করে, এদেশে তেমনি একটি পারিবারিক আর্থিক পরিকল্পনার ভিত্তিপ্রস্তর সেই পরিবারের কর্মক্ষম ব্যক্তির জীবনের ওপর আর্থিক-ঝুঁকি লাঘবের কৌশলগুলি কার্যকরের ওপর অনেকটা নির্ভর করে। আমার পঁচিশ বছরের পেশাগত অভিজ্ঞতায় নতুন ইমিগ্রান্টদের সাথে আমার কথাবার্তা চলাকালীন, তাদের জীবন-বীমা-ভিত্তিক বা ট্যাক্স-বেনিফিট-ভিত্তিক আর্থিক বিকল্পগুলি বাস্তবায়নের পরিকল্পনা বিলম্বিত করাব বা বাদ দেওয়াকে একটা সাধারণ ব্যাপার বলে মনে হয়েছে। তারা সাধারণত যে সমস্ত বিষয়গুলো কারণ হিসেবে দেখান বা বলেন তার কিছু নমুনা নিচে উল্লেখ করা হলো-
আমার ইমিগ্রেশন স্ট্যাটাসটা এখনো অনিশ্চিত : সাম্প্রতিক ইমিগ্রান্টরা স্থায়ী অথবা অস্থায়ী উভয় ধরণের অভিবাসন (পার্মানেন্ট অথবা টেম্পোরারি ইমিগ্রেশন স্ট্যাটাস) নিয়েই এদেশে আসেন। যেমন, এফ-ওয়ানবি ভিসা, জে-ওয়ান ভিসা, এইচ-ওয়ান ভিসা, ও-ওয়ান ভিসা, এল-ওয়ান ভিসা বা অন্যান্য পারিবারিক অথবা এসাইলাম ভিসা নিয়ে এদেশে আগমন ঘটে। অনেকেরই হয়তো বেশ সময় লাগে আমেরিকার স্থায়ী রেসিডেন্সি (গ্রিনকার্ড) পেতে অথবা ইউএস সিটিজেনশীপ স্ট্যাটাস পেতে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সব ধরণের বৈধ ইমিগ্রান্টরাই এদেশে স্থায়ী আবাসের সুযোগ পান, যা কিনা সময়ের ব্যাপার। ধৈর্য সহকারে এবং আইনসম্মতভাবে তাদের কার্যকলাপ ও আচার-ব্যবহারের পরিপ্রেক্ষিতে যেকোনো ভিসা ক্যাটেগরির একজন সাম্প্রতিক ইমিগ্রান্ট ও তার পরিবার এদেশে স্থায়ীভাবে থাকার সুযোগ পেয়ে থাকেন। একই সময়কালীন তারা নিজ নিজ পেশায় কাজ করে পর্যাপ্ত পরিমাণ টাকা-পয়সাও আয় করেন। অনেকে বাড়ি-গাড়ি কেনেন, তাদের ঘরে নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের জন্ম হয়, ছেলেমেয়েদের স্কুল-কলেজে পাঠান। তারা নিয়মিত তাদের বার্ষিক আয় অনুযায়ী আইআরএসকে ইনকাম-ট্যাক্স দেন, বছর শেষে ট্যাক্স রিটার্ন ফাইলও করেন।
যদিও অধিকাংশ বাংলাদেশী সাম্প্রতিক ইমিগ্রান্টরা শিক্ষিত এবং এদেশে উচ্চ আয় সম্পন্ন পেশাজীবী হিসেবে কাজ করেন। কিন্তু তারা অনেকেই ট্যাক্স- সেভিংস বা ট্যাক্স-ডেফারিং, ইনভেস্টমেন্ট (ব্যক্তিগত জমানো টাকার বিনিয়োগ) অথবা লাইফ ইন্সুরেন্স অথবা একটা রিটায়ারমেন্ট সেভিংস প্ল্যান শুরু করা, অথবা তাদের ঘরে জন্ম নেয়া নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের জন্য একটা কলেজ-ফান্ড খোলা, এগুলো করতে দ্বিধায় ভোগেন। যার দীর্ঘ মেয়াদি ফল হিসেবে তারা একটা বিরাট অংকের অর্থ সঞ্চয় করা বা সম্পদ আহরণের সুযোগ থেকে নিজেদের বঞ্চিত করে রাখেন।
এখানে একটা উদাহরণ ব্যবহার করা যেতে পারে-ধরা যাক ৩৫ বছর বয়সের একজন উপার্জনশীল পেশাজীবী ইমিগ্রান্ট বছরে ১০,০০০ ডলার জমা করার এবং নিয়মিত বিনিয়োগ করার সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। তার লক্ষ্য হতে পারে যে তিনি তার বয়স ৬৫ বছর পর্যন্ত তা করবেন, যখন তিনি হয়তো তার রিটায়ারমেন্ট বয়সে পৌঁছাবেন। তার মানে পরবর্তী ৩০ বছরে তিনি মোট ৩০০,০০০ ডলার জমাবেন এবং ধরা যাক তার সেই একাউন্ট বার্ষিক গড়ে ৯% হারে বৃদ্ধি পাবে। সেই হিসেবে তার একাউন্ট ভ্যালু হবে আনুমানিক ১,৩৬৩,০০০ ডলার, যখন কিনা তিনি ৬৫ বছর বয়সে পৌঁছাবেন। এখন তারই সমবয়সী আরেক বন্ধু সিদ্ধান্ত নিলেন যে তিনিও একই প্ল্যান করবেন তবে ৫ বছর অপেক্ষা করে তা শুরু করবেন। মানে তিনি তার বয়স ৪০ থেকে বছরে ১০,০০০ ডলার করে জমা করবেন, এবং তার বন্ধুর মত বার্ষিক গড়ে ৯% হারে বৃদ্ধি পাবে। এবং তিনি সর্বমোট ২৫০,০০০ টাকা জমা করবেন তার বয়স ৬৫ পর্যন্ত। কিন্তু তার একাউন্ট ভ্যালু দাঁড়াবে আনুমানিক ৮৪৭,০০৯ ডলার। পার্থক্য হলো, সে তার বন্ধুর তুলনায় ৫১৫,৯৯১ ডলার কম পাবেন। তার প্রশ্ন হতে পারে, আচ্ছা আমি মাত্র ৫ বছর অপেক্ষা করেছি, এবং মাত্র ৫০,০০০ ডলার কম জমা করেছি। তা হলে আমি কেন এতো ডলার (৫১৫,৯৯১ ডলার) কম পাবো আমার বন্ধুর তুলনায়? এর উত্তর হলো, কারণ দীর্ঘ সময় ধরে বিনিয়োগকৃত অর্থের উপর যৌগিক-হারে উপার্জন ঘটে। এই উদাহরণটিতে ঐ ব্যক্তির প্রতি বছরে সম্ভাব্য ট্যাক্স সেভিংসের যে সম্ভাবনা আছে তা কিন্তু ধরা হয়নি। যেহেতু এটা তার প্রাক-কর (প্রি-ট্যাক্স) সঞ্চয়ী হওয়ার ফলে হ্রাসকৃত কর-বন্ধনীতে ( লোয়ার ট্যাক্স-ব্রাকেট) হওয়ারও সম্ভাবনা আছে। অবশ্যই এ ব্যাপারে তাকে তার ট্যাক্স-প্রফেশনালের (একজন একাউন্টেন্ট বা সিপিএ-এর) সাথে পরামর্শ করতে হবে। অধিকন্তু তারা তাদের ইমিগ্রেশন-স্ট্যাটাস (অবস্থা) নির্বিশেষে এই সুযোগগুলো নিতে পারেন, যদি কিনা তাদের বার্ষিক একটা উপার্জন (ইনকাম) থাকে।
পরবর্তী সংখ্যায় ইমিগ্রান্ট বাবামায়েরা আরো যে সমস্ত অজুহাত দেখান, পারিবারিক আর্থিক পরিকল্পনা না করার জন্য, তার কিছু কিছু নমুনা তুলে ধরব। মোদ্দা কথা হলো, আমারা যত বেশি উদার মন নিয়ে আমাদের ভবিষ্যতের জন্য পরিকল্পনা করবো ততই মঙ্গল। সূত্র: সাপ্তাহিক বাঙালী, নিউইয়র্ক, এপ্রিল ১০, ২০২১