এক চিলতে নস্ট্যালজিয়া-রাশিদা কামাল


ওহাইও সংবাদ প্রকাশের সময় : নভেম্বর ৯, ২০২৩, ১০:১৩ অপরাহ্ণ /
এক চিলতে নস্ট্যালজিয়া-রাশিদা কামাল

( প্রথম পর্ব )
একটা আবেগ তাড়িত শব্দ নস্ট্যালজিয়া। সে আবেগটা হতে পারে সুখের, হতে পারে দুঃখের। অথবা সুখ-দুঃখের মিশ্রণে জারিত এক সূক্ষ্ম অনুভূতি! সুখ বা দুঃখ যাই হোক না কেন তা গ্রথিত থাকে মনের গভীরে। এই সূক্ষ্ম অনুভূতি নষ্ট হয় না —–হারিয়েও যায় না! পাহাড়ি ঢালে
লোকচক্ষুর অন্তরালে বেড়ে ওঠা
লতাগুলি-গুল্মের মতো মানুষের ঘুমন্ত সত্তাকে একান্তভাবে জড়িয়ে ধরে বেঁচে থাকে। কখনও কখনও কোন বিশেষ কারণে সেই ঘুমন্ত সত্তা ঝাঁকি খায়, জেগে ওঠে! তারপর চুপি চুপি নিজের অস্তিত্ব
ঘোষণা করে! তখন জল ঝরে সেখান থেকে। সেই জলকণার ছোঁয়া অনুভব করি আমরা! স্মৃতিরা পায়ে পায়ে এগিয়ে আসে, জীবন্ত হয়, কথা বলে! মনের ভেতরের প্রায় শুকিয়ে যাওয়া নদীটা দুলে ওঠে! আর আমরা তখনই গৃহকাতর অথবা স্মৃতিকাতর হয়ে পড়ি। স্মৃতিরাই তখন বর্তমান হয়ে ধরা দেয়।
ছেলেবেলাটা আমার কেটেছে শান্ত স্নিগ্ধ এক শহরে। যে শহরের পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে ‘মধুমতি’ নদী। এই নামটার সাথেই আমার শৈশবের আবেগ জড়িয়ে আছে। নদীটা তখন ছিলো বিশাল। এ পাড় থেকে ওপাড়ের সব কিছুই ছিলো আবছা। তবুও দিগন্তরেখার দিকে তাকিয়ে নদীর পাড় খুঁজতাম । এখন নদীটা সংকীর্ণ হয়ে গেছে। আগের মতো যৌবনবতী নেই! বর্ষার প্রবল জলোচ্ছ্বাস নদীটার বুকে ঢেউ তোলে না—-তাই এ নদীর জল স্ফীতও হয় না। তবে আমি যখনই মনে করি নদীটার কথা
তখনই ছেলেবেলার সেই তরুণী,
সেই যৌবনবতী নদীটাই আমার মনের মধ্যে ধরা দেয়। আমি আমার অনেক উপন্যাস আর গল্পে ‘মধুমতি’ নদীর কথা তুলে ধরেছি। নদীটা আমার বুকের ভেতর বয়ে গিয়ে আমার মধ্যেও তারুণ্যের ঢেউ তোলে। আমার হৃদপিণ্ডের মধ্যে তখন একটা চেনা সুর বেজে ওঠে। আমি ফিরে পাই আমার প্রিয় শহরকে—–আমার শৈশবকে। আর তখনই মনে হয় বুকের ভেতরের চেনা পাখিরা উড়ে যায় নি! ছুঁয়েই আছে আমাকে! আমার সর্বস্ব জুড়ে ওদের অস্তিত্ব ঘোষণা করছে!
আমাদের বাসাটা শহরের কেন্দ্র বিন্দুতে অবস্থিত। ছোট শহরটা এখন কত্ত বড় হয়েছ ! বাসাটা অবশ্য কেন্দ্রবিন্দুতেই আছে। মার কাছে শুনেছি দাদাজান বিয়ে করে দাদিকে এ বাড়িতেই তুলেছেন। বাসার সামনেই ছিলো বিশাল খোলা মাঠ। পরবর্তীতে সেটা হয়েছে স্টেডিয়াম। এখানে সারা বছরই ফুটবল আর ক্রিকেট খেলা চলতো। আমরা সেদিকে মন দিতাম না। তবে যখন কালীপূজার মেলা বসতো মাঠে তখন আমাদের খুব আনন্দ হতো। এই মেলার কথাও আমি অনেক জায়গায় লিখেছি। আমার বেশ মনে আছে ভোর রাতে টুপটাপ শিশির পড়তো। সেই শিশিরে মিশে থাকতো শারদীয় গন্ধ। শারদীয় বাতাসের নিজস্ব একটা গন্ধ থাকে। আমার মনে হয় শীতকালেও গন্ধটা হারায় না। প্রকৃতির সাথেই লেপটে থাকে।
লেপের ওমে নিজেকে জড়িয়ে সেই শিশির পতনের শব্দ শুনতাম আর শারদীয় গন্ধ নিতাম। মনে মনে ভাবতাম কখন জানালা দিয়ে আকাশের নরম আলোটা চোখে পড়বে! নরম গোলাপি আলোটা চোখে পড়লেই বিছানা ছাড়তে পারব! আসল উদ্দেশ্য কিন্তু বিছানা ছাড়া না—-আসল উদ্দেশ্য বেলা বাড়ার সাথে সাথে মেলার মাঠও জেগে উঠবে। খাবারের দোকান থেকে ধোঁয়া উঠবে আর তেলেভাজার গন্ধ ছড়িয়ে পড়বে চারদিকে। আমাদের বাসার সামনে একটা শিউলি ফুলের গাছ ছিলো। গাছটা আমিই লাগিয়েছিলাম। শিউলির মিষ্টি গন্ধ আর তেলেভাজার গন্ধ এক হয়ে মিশে যেতো। কী অদ্ভুত সে গন্ধ! নেশা ধরে যেতো! নেশাধরা দিনগুলি আমাকে এখনও হাতছানি দেয়। নেশাগ্রস্থ আমি পৌঁছে যাই আমার ইচ্ছের কাছে! মনে মনে আলিঙ্গন করি ইচ্ছেগুলিকে। প্রিয় শৈশবকে!
বাড়ির সামনে মেলা হতো বলে যখন ইচ্ছে তখন যেতে পারতাম না! যাবার সময়টা মা ঠিক করে দিতো। মেলা থেকে যে কত্তকিছু কিনতে ইচ্ছে করতো! যা দেখতাম তাই ভালো লাগতো! মনে হতো পুরো মেলাটাই বাড়িতে নিয়ে আসি! না, তা তো আর সম্ভব ছিলো না! তবে মাটির হাঁড়ি-পাতিল আর নানা রকম পুতুল কিনতাম। বাসায় এসে সেগুলি বার বার দেখতাম, ধরতাম, নাড়াচাড়া করতাম। বর-বউয়ের পুতুল ছিলো সবচেয়ে আদরের। এক সময় মা বলতো হাঁড়িপাতিলে রান্নাবান্না কর! মার কথায় হাসি ফুটতো! পাড়াতুতো বন্ধুদের দেরি না করে খবরটা জানাতাম। ওরাও চলে আসতো ওদের সদ্য কেনা হাঁড়িপাতিল নিয়ে। চলতো রান্নার আয়োজন। নুরু, পুষি, আয়েশা, শফিদের মতো
আমরাও বিনে আগুনে রান্না করতাম! মা তখন বলতো তোমরা তোমাদের মতো রান্না করো। আর তোমাদের খাবারের আয়োজন আমি করছি। বিপুল উদ্যমে রান্নাবাটি খেলতে শুরু করতাম। লাল খোয়া দিয়ে মাংস, বালি দিয়ে পোলাও আর নানা রকম গাছের পাতা দিয়ে তরকারি রান্না করতাম। রান্না শেষে মিথ্যে মিথ্যে গোসল করতাম। তারপর মিথ্যে মিথ্যে খেতে বসতাম। কী যে মজা লাগতো তখন তা আজ আর ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব না! মা
ততক্ষণে খাবার সাজিয়ে আমাদের ডাকতো। মার দেওয়া সেই খাবারটা তখন খেতাম। সত্যি কথা বলতে কী মার সত্যি খাবারটা ছাপিয়ে মিথ্যে খাবারের আবেশটাই আমাদের জড়িয়ে থাকতো।
মাঝে মাঝে পুতুল বিয়ে দিতাম।
তখনও মা বলতো তোমরা বিয়ের আয়োজন কর আর আমি খাবারের আয়োজন করছি। মনে মনে বড় হতে চাইতাম তখন! বড় হলে সব আয়োজনই নিজেরা করতে পারতাম! ছোটবেলায় এ রকম কত দুর্লভ মুহূর্ত পার করেছি তার ইয়ত্তা নেই।
নিজের ইচ্ছের কারণে নয়, প্রকৃতির নিয়মেই বড় হলাম। তখন কতবার বন্ধুদের সাথে বনভোজনে গিয়েছি! কিন্তু কেন যেন মনে হতো শৈশবের ইটের খোয়ার মাংস, বালির পোলাও আর লতাপাতার তরকারির বনভোজনটাই ভালো ছিলো!
এর অনেক পরে সংসারে ঢুকলাম। বাধ্য হয়েই করতাম তখন। আর তখনই মনে পড়তো
মা যদি রান্না করে দিতো! সেই শৈশবে আবার ফিরে যেতে ইচ্ছে হতো।
কী অদ্ভুত বৈপরীত্য! যখন ছোট ছিলাম তখন বড় হতে চাইতাম!
আর যখন বড় হলাম তখন ফিরে পেতে চাইতাম চিরদিনের মতো ফেলে আসা প্রিয় শৈশবকে। যে শৈশব—–যে কৈশোর এখনও আমাকে হাতছানি দেয়! মনের মধ্যে বুনোফুলের গন্ধ ছড়ায়! আমার ধারণা এই আকাঙক্ষা সবার মধ্যেই কিছু না কিছু আছে! তাই বড় হয়ে যাওয়া এই আমরাই আবার ব্যস্ত আর সমস্যাসঙ্কুল
জীবনে খুঁজে ফিরি ফেলে আসা অতীতকে! নিজেকে প্রশ্ন করি কী আছে সেখানে! কেনই বা সুপ্ত স্মৃতিকে ফিরে পেতে চাই! কেনই বা জল ঝরাতে চাই সেখান থেকে! কখনও উত্তর পাই কখনও পাই না! যখন উত্তর পাই তখন একটা কথাই মনে হয় নির্মল আনন্দে মোড়া ছিলো সে দিনগুলি! সেই আনন্দে মোড়া দিনগুলিই হয়তো বুনোফুলের গন্ধ ছড়ায়! মনটা উচাটন হয়! আর সেই সাথে মনে হয় আমি হয়তো এখনও ফুরিয়ে যাই নি!
আমার লেখায় পুরোনো দিনের গন্ধ থাকে—–কথাটা অনেকেই বলে। আমি কথাটা শুনে কিছুই বলি না! শুধু হাসি। আমার ধারণা আমার মতো অনেকেই আমার লেখা পড়ে নস্ট্যালজিক হয়। মনে মনে বলি কী করব! আমার যে এসব কথা মনে পড়ে!
এতক্ষণে অনেকেই হয়তো ভাবছেন আমি কী লিখতে চাইছি! কালীপুজোর মেলার কথা, পুতুল বিয়ের কথা না কি
রান্নাবাটি খেলার কথা! কী যে লিখতে চাইছি তা নিজের কাছেও স্পষ্ট না! তবে লেখার বিষয়বস্তু তো কিছু একটা থাকেই! আজকে না হয় ধান ভানতে শিবের গীত একটু গাইলাম!
গত দশ সেপ্টেম্বর বিপুল উৎসাহ আর আনন্দের সাথে এখানে পালিত হলো’ বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সেন্ট্রাল ওহাইও'(বাকো) এর বার্ষিক বনভোজন। ওখানে দেখা হলো ‘ওহাইও সংবাদ ‘এর বার্তা সম্পাদক মাহবুবুর রহমান এর সাথে। ওর সাথে দেখা হলেই খুব মিষ্টি করে হেসে কাছে এসে দাঁড়ায়। আমার তখন মনে হয় খুব আপন কেউ কাছে এসেছে। সেদিনও কাছে এলো। অবশ্য সেদিন মাহবুব ব্যস্ত ছিলো রান্না নিয়ে। মুরগি গ্রীল করতে করতেই স্বভাবসুলভ হাসিমুখে বলল, আন্টি, আমাদের পিকনিকের কথা এবার সুন্দর করে লিখবেন।
কথাটা আমার ভালো লাগলো। আমি বললাম, লিখব—–ভালো করেই লিখব।
মাহবুবের সাথে কথা বলতে বলতে চোখে পড়লো শিবলির দিকে। শিবলিও রান্না নিয়ে ব্যস্ত। ও খুব ভালো রান্না করে। ওর রান্না আমি ওর বাসায় আগেও অনেকবার খেয়েছি। হাঁসের মাংসটা দারুণ হয়! যাকে বলে অতুলনীয়! ওদের মতোই রান্নায় ব্যস্ত ইসমাইল, ইমরান, আজিজ, অনিক আর রাকিবকে। সবাইকে এ কাজে খুব আন্তরিক মনে হলো।
আমরা যখন পিকনিক স্পটে পৌঁছালাম তখনও তেমন মানুষের সমাগম হয় নি। ওখানে পৌঁছাতেই দেখা হলো বনভোজন কমিটির আহ্বায়ক লিটন কবীরের সাথে। আমি আগেও বলেছি লিটনের চেহারায় একটা মন ভালো করার ছোঁয়া থাকে। পিকনিক উপলক্ষে মনটা খুব ভালোই ছিলো। লিটনকে দেখার পর সেই ভালোলাগাটা পূর্ণতা পেলো। ওর সাথে কথা বলতে বলতে আমরা সামনে এগোতে লাগলাম। বিশাল আয়োজন! অনেকটা জায়গা নিয়ে এ আয়োজন! এ দেশে খোলা মাঠ, ঘাট আর সবুজ প্রান্তরের শেষ নেই! এসব প্রান্তর জুড়ে রয়েছে নানা রকম গাছ! যত্নে লাগানো ফুলগাছের পাশাপাশি চোখে পড়ে অজস্র বুনোফুলের গাছ। মাঠ জুড়ে এক ধরনের হলুদ ফুল ফোটে। এগুলোকে আমার কাছে মনে হয় আমাদের সর্ষেফুল। আমি ফুলগুলোর নাম জানতে চাই না। আমার সর্ষেফুল ভাবতেই ভালো লাগে। সূর্যের সোনালি আলো আর এই ফুলের হলুদাভা মিলে মিশে একাকার হয়ে চারদিকটা সোনালি বর্ণ ধারণ করে। দারুণ সৌন্দর্য! আমি কেন এ ফুলের নাম জানতে চাইব! এরা আমার কাছে সর্ষেফুল হয়েই থাক!
এখানে আকাশটা ঘন নীল মনে হয়। ফুলগাছগুলি ঘিরে মৌমাছি আর প্রজাপতিদের ভিড়। নিশ্চিন্তে আর মনের আনন্দে দুলে দুলে নেচে নেচে এ ফুল থেকে ও ফুলে মধু খেতে ব্যস্ত। ওদের ডানার রঙ যেন চুঁইয়ে চুঁইয়ে পড়ে আর রঙের মেলা বসে। এ দৃশ্য আমাকে মাঝে মাঝে কষ্ট দেয়। এ দেশে প্রকৃতির মর্যাদা আছে! যা আমাদের দেশে নেই। ঢাকায় আমার বাড়ির সামনে একটা গোলাপের ঝাড় আছে। গাছে কলি আসে। আমি ফুলের প্রতীক্ষায় থাকি। কলিগুলি যখন ফুটি ফুটি করে তখনই কেউ এসে তা ছিঁড়ে নিয়ে যায়!
শুধু গাছ থেকেই ছেঁড়ে না। ফুলগুলিকেও ছিঁড়ে কুটি কুটি করে। রাস্তায় সেই আহত ফুলের পাঁপড়ি পড়ে থাকে। আমি ভেবে পাই না কী আনন্দ আছে ফুল ছেঁড়ার মাঝে!
একটু এগোতেই দেখা হলো বাকোর সাংস্কৃতিক সম্পাদক তানিয়ার সাথে। দিবা বেয়ানকে এখানেই দেখলাম। আরও অনেকেই ছিলো সবাই ব্যস্ত কথা হলো বাকোর সহ-সম্পাদক লিপিকার সাথে। দেখা হতেই লিপিকা জড়িয়ে ধরলো আমাকে। দারুণ অনুভূতি আমার! আমিও ওকে জড়িয়ে ধরলাম। অনেকক্ষণ এভাবেই থাকলাম আমরা। আমি বা লিপিকা কেউ কাউকে ছাড়তে চাইছি না! আমার মন চাইছিলো অনন্তকাল ওকে এভাবে কাছেই রাখি!
চলবে…