লালন নূর (ক্লিভল্যান্ড থেকে) ওহাইও সংবাদ : বাংলাদেশ এসোসিয়েশন অফ নর্থইস্ট ওহাইও (বানিও)’র আয়োজনে হেমন্তের রঙিন আবহে গত ১৫ অক্টোবর (রবিবার) ক্লিভল্যান্ডে হয়ে গেলো দুই বাংলার কবিতা ও গান নিয়ে ‘হেমন্তের শেষ, শীতের শুরু’ শীর্ষক আবহমান বাংলার সম্মিলনী উৎসব। প্রকৃতির রঙিন চেতনায় বাঙালি পরিচয়ে জেগে উঠেছিলো একখণ্ড বাংলাদেশ। উৎসবের রঙ আর হেমন্তের মৃদু শীতল আমেজের সুরেলা আবহে মেতে উঠেছিলো সবাই।
চিরায়ত বাঙালি মননে হেমন্ত যেন জীবনে হৈ হৈ উদযাপন। চারিদিকে নতুন ফসলের আগমনী সংবেদ। বাংলাদেশে হেমন্ত আসে পূর্ণতার প্রতীকে। আসে নানান ফুলের মৌ মৌ গন্ধের আবহ নিয়ে। গাছের পাতায় বহুবর্ণিল সুর। প্রকৃতি সজ্জিত পূর্ণতার প্রতীকে, রঙের আবাহনী গান বেজে উঠছে চারিদিকে। বোধের ডানা মেলে আসে রোদের কুশল। গাছে গাছে গুঞ্জরিত জীবনের কোলাহলমুখরতা। ধাবমান স্বপ্নবাসনাগুলো বিকশিত আমাদের রঙিন আকাঙ্ক্ষার উঠোনে।
আমেরিকায় হয়তো নেই গন্ধরাজের গরিমা, মল্লিকার মোহনীয় সুর, শিউলির সুরেলা শুভ্রতা, কামিনীর কোমল কান্তি, হিমঝুরি বা আকাশনিমের হলুদ মসৃণতা, দেবকাঞ্চনের দীঘল দীপ্তি, রাজ অশোকের অপলক অনুভব, ছাতিমের ছায়ানিবিড় গুচ্ছ, বকফুলের বিস্তীর্ণ বিহার। তবে আছে সকালের শিশিরভেজা ঘাস আর হালকা কুয়াশায় স্নাত প্রকৃতির অপরূপ আভা। আর আছে প্রকৃতির বহুবর্ণ উপভোগের অবাধ বিস্তার। আছে ঝরাপাতার মোহনীয় মর্মর, আছে মৃদুমন্দ বাতাসের কোমল ছোঁয়া। গাছের পাতায় পাতায় যেন দুলে ওঠে থোকা থোকা বাহারি রঙের ফুল। প্রতিটি পাতাই যেন বহুবর্ণের এক একটি ফুল।
প্রতিদিন লক্ষ্যহীন লক্ষ্যে অন্তহীন ছুটে চলা আমাদের প্রবাস জীবন। বরণ-বর্জন ভুলে আত্মনিমজ্জণ আচ্ছন্ন করে রাখে প্রাপ্তির প্রশ্নবোধক বিষ্ময়। অজান্তেই পায়ে পায়ে মারিয়ে পেরিয়ে আসি বহু বছরের বেষ্টনী। পেছনে অজানাই থেকে যায় দেনা-পাওনার অসম সমীকরণ। তবু মিলনের মোহনায় আমরা সবাই এক হয়ে মেতে উঠি। সংস্কৃতিই একমাত্র উঠোন যেখানে ধুলায় মিশে যায় জাতি, ধর্ম, বর্ণ, ভূগোল, আর সীমান্তের সীমা-পরিসীমা। শাক দিয়ে ঢেকে রাখি ভাতের গভীরে লুকানো মাছ; আমরাই যেন হয়ে উঠি সংস্কৃতির অপার সারল্য নির্ঝর – যেখানে সদা বহমান আমাদেরই চেতনার আসল অস্থি-মজ্জা।
ছোট একটি হলঘরে মিলিত মানুষের বহুবর্ণীল উপস্থিতি যেন আবার মনে করিয়ে দিচ্ছিলো ‘হেমন্তে কোন্ বসন্তেরই বাণী পূর্ণশশী ওই-যে দিল আনি/বকুল ডালের আগায় জ্যোৎস্না যেন ফুলের স্বপন লাগায়। কোন্ গোপন কানাকানি পূর্ণশশী ওই-যে দিল আনি’ (রবীন্দ্রনাথ)। এমনই পূর্ণতায় কানায় কানায় হলঘরে সবার মনে নেচে উঠেছিলো হেমন্তের রঙিন বাঁশি।
আয়োজনের শুরুতেই দুপুরের খাবারে ছিলো মুগ ডালের খিচুরি, মুরগীর মাংস, ডিম, আলুভর্তা, আর আচার। শেষে ছিলো বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী বগুড়ার দই। সঙ্গে ছিলো চা। মধ্যাহ্নের খাবারের পর দুপুর দুইটায় শুরু হয় মূল অনুষ্ঠান। একটানা তিন ঘন্টার এই আয়োজন ছিলো মনোমুগ্ধকর। আয়োজনে স্বরচিত কবিতা পাঠ করেন মঈনউদ্দীন মুনশি, সুজয় দত্ত, অরুপ চট্টোপাধ্যায়, মিতালী সিং ও বর্ষণজিৎ মজুমদার। কবিতা আবৃত্তি করেন লীনা চক্রবর্তী, সুষ্মিতা দে, জহুরুল হক, তিতাশ মাহমুদ, শায়লা চৌধুরী, মনজুর ইলাহী, প্রবর ঘোষ, রিপা নূর ও লালন নূর। গান পরিবেশন করেন অমীয় ব্যানার্জী, সুগাতা চট্টোপাধ্যায়, সিমলি বড়ুয়া, ফাহিমা রহমান পলিন, শফিউল ভূঁইয়া, মুনমুন চৌধুরী, জাহিদুল ওয়াহাব রুবেল এবং মিনহাজ উদ্দীন। অপার আনন্দে নৃত্য পরিবেশনায় সবাইকে মুগ্ধ করে ছোট সোনা-নেহা। গানের শিল্পীদের যন্ত্রে সঙ্গত করেন গীটারে নোমান হাসান, তবলায়, মানবেন্দ্র ভুলু এবং হারমোনিয়ামে মৌসুমী লায়লা।
শেষে সবার মঙ্গল কামনা করে যুদ্ধহীন শান্তির পৃথিবীর প্রত্যাশায় সবাই যখন ফেরার পথে, তখন প্রকৃতির বহুবর্ণ ধারণ করে ঝরাপাতার মতো জ্বলজ্বল করছিলো পড়ন্ত বিকালের লাল সূর্য। সূর্যটা হয়তো জানান দিচ্ছিলো আগামী কোন নতুন দিনের প্রত্যাশা। হয়তো অনুষ্ঠানের আর সবার মতো সূর্যটাও বলছিলো-‘কার দিকে তুমি গুলি ছুঁড়ছো হে, এখানে সবাই মানুষ’ (সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়)।
আপনার মতামত লিখুন :