একটু বোস – রাশিদা কামাল (শেষ পর্ব)


ওহাইও সংবাদ প্রকাশের সময় : অক্টোবর ১৯, ২০২৩, ১০:৫১ অপরাহ্ণ /
একটু বোস – রাশিদা কামাল (শেষ পর্ব)

(আগের কথা : জয়িতা করুণ গলায় বলল, ‘ ভুলে যাব! ‘
– এছাড়া আর কী বলতে পারি! কতদিন তুমি অপেক্ষায় থাকবে!
তোমাদের সংসারে এখন ক্রাইসিস চলছে! এ অবস্থায় আমিও থাকছি না! তাই আমাকে ভুলে গিয়ে অন্য কাউকে বিয়ে কর। তাতে তোমারই শুধু লাভ হবে না, তোমার পরিবারও লাভবান হবে! বেঁচে যাবে তোমরা।)
অন্ধকার নামছে মন্থর গতিতে। পাখিরা কুলায় ফিরে গেছে। আকাশের লালচে রঙটায়ও কালোর ছোপ। জয়িতার বুকের ভেতরের পাখিরাও আর ডাকছে না! ওর মনে হচ্ছে ওরাও উড়ে যাবার প্প্রস্তুতি নিচ্ছে। অন্ধকার নেমে আসা আকাশের দিকে তাকালো জয়িতা। তারপর নৈঃশব্দ ভাঙলো।
— তুমি বলেছিলে চাকরি হলে আমাকে তোমার কাছে নিয়ে যাবে! ‘
— বলেছিলাম! কিন্তু তখন তো ভাবি নি এতো দিনের জন্য বিদেশে চলে যাব! ‘
— ভাবতে! আমাকে অপেক্ষা করতে বলতে পারতে! এতো সহজে অধিকার ছেড়ে দিলে! হার মানলে ! এতো দিনের ভালোবাসা অস্বীকার করলে! ‘
— প্রয়োজনে কত সিদ্ধান্ত বদলাতে হয় জয়িতা! তুমি ভেবে দেখ! তোমরা দুবোন। বাবা নেই সংসারে! আমিও থাকছি না! ভাবতে পার কী হতে পারে তোমাদের! আমি তোমাদের ভালো চাই বলেই এ সিদ্ধান্ত নিয়েছি।’
— যতো কিছুই হোক! তাই বলে তুমি আমাকে ছেড়ে চলে যাবে! যেতে পারবে! আমাকে ছুঁয়ে বলো ফারহান, সত্যিই যেতে পারবে! ‘
ব্যাকুলতা ঝরে পড়েছিলো সেদিন জয়িতার গলায়। পায়ে পায়ে ও এগিয়ে গিয়েছিলো ফারহানের খুব কাছে। বুকের ওপর মাথা রেখে ও কান্নায় ভেঙে পড়েছিলো। ফারহান সেদিন ছিলো নিস্পৃহ। কান্নারত জয়ীকে দুহাতে বুকের কাছে টেনে নেয় নি —– ওর ঠোঁট স্পর্শ করে নি জয়িতার ভেজা চোখের পাতা। কিছুক্ষণ পর শান্ত গলায়
বরং ফারহান বলেছিলো,
— সন্ধে হয়ে গেছে জয়ী। বাড়ি ফিরে যাও। কেউ আমাদের হয়তো দেখে ফেলতে পারে! ‘
বুকের ওপর থেকে মাথা তুলে জয়িতা অবাক চোখে তাকিয়ে
ছিলো। ‘ কেউ দেখে ফেলবে ‘ এ কথাটা তো ও আগে কতবার বলেছে! তখন তো ফারহান ভয় পায় নি! বরং ওর নাকের ডগা ছুঁয়ে কত কথা বলতো! আজ ভয় পাচ্ছে। তাই চলে যেতে চাইছে! ভাবছে ওপরে ওঠার সিঁড়িটা যদি সরে যায়! যদি ভেঙে যায়! সেদিন আর দেরি করে নি ও। চোখদুটো মুছে নিয়ে চলতে শুরু করেছিলো। কষ্টটা আর বাইরে নয়, অনেক চেষ্টায় বুকের ভেতর চাপা দিয়েছিলো! একবারও পেছন ফিরে দেখার ইচ্ছে হয় নি ফারহান কী করছে! ও সেদিন ফারহানকে মুক্তি দিয়ে গিয়েছিলো।
সেই শেষ দেখা। তবে আরও একবার ওই মধুমতির পাড়ে, ওই ভেজা বালিয়াড়ির কাছে জয়িতা একা গিয়েছিলো। ফারহানের লেখা চিঠিগুলো পানিতে ভাসিয়ে দেবার জন্য। কোন চিহ্নই আর রাখবে না! যে হারিয়ে গেছে তার সবকিছুই হারিয়ে যাক! শুধু বহতা নদীর দিকে ঝাপসা চোখে তাকিয়ে মনে মনে বলেছিলো এই নদীকে সাক্ষী রেখে যে সম্পর্ক গভীরতা পেয়েছিলো তা আজ নদীর স্রোতে বিলীন হয়ে যাক! মনে মনে এ কথাটাও বলেছিলো এই নদীর মতোই নির্মল স্রোতধারা বুকে নিয়ে ও বয়ে চলবে। থামবে না—-কারণ থামা মানেই হেরে যাওয়া! থামা মানেই মুখ থুবড়ে পড়ে যাওয়া!
এর পরের কাহিনিটা খুব কষ্টের। মামাবাড়িতে আশ্রয় নিতে হয়েছিলো ওদের। নিরন্তর বয়ে চলার যে প্রতিজ্ঞা ও করেছিলো সে প্রতিজ্ঞা রাখার প্রাণপণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলো। মামারা আপুর বিয়ে দিলো। কিন্তু ও এখন বিয়ে করবে না এ কথাটা জানিয়ে দিলো। ও বুঝেছিলো অভিভাবকহীন মফস্বলের এই মেয়েটাকে আগে নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে! প্রমাণ করতে হবে
বাবা না থাকলে মেয়েরা অসহায় হয়ে যায় না, ফুরিয়েও যায় না!
বাবা নেই বলেই তো ফারহান ওর জীবন থেকে সরে গিয়েছিলো! পেরেছিলো কঠিন হতে! ও কেমন আছে কোথায় আছে কিছুই জানতে চায় নি! জয়িতার জীবনটা হয়ে উঠেছিলো বৈচিত্রহীন, গন্ধহীন।
তখন কোন প্রত্যাশার আলো ওকে ছুঁয়ে যেত না। পুরুষের সান্নিধ্য কামনায় ও ব্যাকুল হতো না!
আজ এতোদিন পর ফারহানের সাথে দেখা! তাও অফিসের কাজে! অডিট টিম নিয়েই ও এখানে এসেছে। একটানা কাজ করে সমস্যাটা ওরা খুঁজে পেলো। চিহ্নিত হলো মানুষটা। মানুষটা আর কেউ না — ফারহান নিজেই! কী করবে জয়িতা! প্রতিশোধ নেবে! নেওয়াই তো উচিত! তবে ও প্রতিশোধ না নিলেও আইন প্রতিশোধ নেবে! ভাবছে জয়িতা। প্রকৃতি এভাবেই প্রতিশোধ নেয় । আর সে প্রতিশোধ মানুষের চেয়েও কখনও কখনও ভয়ংকর হয়! ওর দেওয়া একটা রিপোর্টে ফারহানের জীবন তছনছ হয়ে যেতে পারে! এক সময় ফারহানের কারণেই ওর জীবনে বিপর্যয় নেমে এসেছিলো! জীবনটা হয়ে উঠেছিলো দিকচক্রবালহীন সমুদ্রের মতো!

কাজ শেষে ফিরে যাচ্ছে জয়িতা। নিজের কাজের জায়গায় গিয়ে রিপোর্টটা লিখতে হবে ওকে। কী লিখবে ও! এক প্রেমিকের প্রতারণার কথা!
কাল রাতে ফারহান এসেছিলো ওর কাছে ডাকবাংলোয়। ফারহান বুঝতে পেরেছে ওর আসন্ন বিপদের কথা। অনেকক্ষণ বলেছিলো। রাত হয়ে যাচ্ছিলো দেখে জয়িতা বলেছিলো,
— রাত বাড়ছে। ফারহান, তুমি বাসায় যাও। এতোরাত পর্যন্ত তোমার এখানে থাকাটা ঠিক না। ‘
তাকালো ফারহান। তাকিয়েই রইলো অনেকক্ষণ। তারপর বলল,
— সেদিনের কথাটা ফিরিয়ে দিচ্ছ! ‘
— না, তোমার কাছে আমার কোন প্রত্যাশা নেই। তাই কথা ফিরিয়ে দেবার দায়ও নেই! যা সত্যি শুধু তাই বললাম। তুমি বাড়ি যাও ফারহান! রাত হয়ে গেছে! ‘
জয়িতার মনটা হু হু করছে। অদ্ভুত কষ্টে ছেয়ে গেছে মন। ও কেন রাগ করতে পারছে না!
‘ কেউ দেখে ফেলবে ‘ এ কথাটা বলে একদিন ওকে চলে যেতে বলেছিলো! সেইদিনের সেই অসহায় মেয়েটার ওপর আজ ফারহানের ভাগ্য নির্ভর করছে!
তাই কি ও যেতে চাইছে না! পায়ে পায়ে সে দৃশ্যটা সামনে এসে দাঁড়ালো। ফারহানের বুকে মাথা রেখে ও স্বপ্ন ভাঙার কষ্টে কেঁদেছিলো! ফারহান ভ্রূক্ষেপ করে নি। হয়তো ওপরে ওঠার সিঁড়িটা ভ্রূক্ষেপ করতে দেয় নি!
তাই কত সহজে অতলান্ত খাদের কাছে ওকে টেনে নিতে পেরেছিলো!
আরও অনেক পরে ফারহান উঠে দাড়িয়েছিলো। খুব কাছে এসে জড়িয়ে ধরে আগের মতো চোখে চোখ রেখে গাঢ় গলায় বলেছিলো ,
— জয়ী আমি এখন একা! ভীষণ একা! তুমি আসবে আমার জীবনে? Will you be mine? ‘
অবাক চোখে তাকিয়ে জয়িতা উত্তরে বলল,
— কেন তোমার সংসার! তোমার বউ! ‘
— কেউ নেই আজ। ও আমাকে ছেড়ে চলে গেছে! ‘
— কেন যেতে দিলে! ও তো আমার মতো মফস্বলের সাধারণ মেয়ে ছিলো না! ছিলো না আমার মতো বাবাহীনও! তাহলে
———-
—– সে অনেক কথা! ওর এক সময়ের প্রেমিকের সাথে চলে গেছে। ‘
— তাই আমার কাছে এসেছ! জড়িয়ে ধরার চেষ্টা করছ! ফিরে পেতে চাইছ এক সময়ের চরম অবহেলায় ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া প্রেমকে! কী ভেবেছিলে! সেই ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া মেয়েটা হারিয়ে গেছে! অথবা মুখ থুবড়ে পড়ে আছে মফস্বলের ছোট্ট গণ্ডিতে! ফারহান আমিও এক সময় তোমাকে জড়িয়ে ধরেছিলাম! কান্নায় বুক ভাসিয়েছিলাম! তুমি সেদিন ছিলে নিস্পৃহ! মনে আছে তোমার? ‘
এ কথার উত্তর নেই ফারহানের কাছে।
পরের দিন ওকে বিদায় জানাতে এসেছে ফারহান। এটা অফিস ডেকোরাম। কিন্তু জয়িতার মন
অন্যকিছু ভাবছিলো। কেন যেন ফারহানের দিকে তাকাতে পারছিলো না! ওকে খুব নিঃস্ব মনে হচ্ছিলো! অনেকদিন পর ফারহানের গায়ে লেগে থাকা সেই কড়া সিগারেটের গন্ধ পাচ্ছিলো ও। গন্ধটা যেন ওকে ছুঁয়ে যাচ্ছে! সেই ফারহান যে ওকে ভালোবাসার অলিগলি চিনিয়েছিলো, সেই ফারহান যে ওকে নিষ্ঠুরভাবে ছুঁড়েও ফেলেছিলো! কোন মানুষটা সত্যি!
জয়িতার বুকের ভেতরের শুকিয়ে যাওয়া নদীটা যেন দুলে
উঠতে চাইছে। নতুন করে জলের তোড় অনুভব করছে ও।
এক বুক কান্না চেপে জয়িতা গাড়িতে উঠলো। ফারহানের দিকে তাকালো। ফারহানের দৃষ্টিতে শূন্যতা। ওর মনে হচ্ছে ফারহান ওর সাথে যোগাযোগ করবে। ও কী করবে! ও কি প্রায় শুকিয়ে যাওয়া নদীটাকে প্রশ্রয় দেবে! না কি ভুলে থাকার চেষ্টা করবে!
গাড়ি চলতে শুরু করেছে। কাঁচের ফাঁক দিয়ে আরও একবার দেখলো ফারহানকে। জলের তোড়টা হু হু করে বুক থেকে চোখে নেমে আসতে চাইছে। ও বাঁধা দিতে পারছে না! ভালোবাসার কী অদ্ভুত শক্তি! কী অদ্ভুত কেমিস্ট্রি! এতো কিছুর পরও তাকে মুছে ফেলা যায় না! বুনোফুলের মতো তীব্র গন্ধ নিয়ে ফিরে আসে বার বার! ও হয়তো এখনও বুকের ভেতরে বয়ে বেড়াচ্ছে ফারহানকে! যা কুয়াশার পাতলা চাদরে ঢাকা!
আজ এতোদিন পর কুয়াশা কেটে গিয়ে অনেক কিছুই স্পষ্ট হয়ে উঠেছে!
জয়িতাদের বাসার সামনে একটা নিম আর মেহগিনি গাছ ছিলো। বিচিত্র পাখি এসে বসতো সেখানে। ও তখন ফারহানের প্রেমে বিভোর! মুগ্ধ দৃষ্টিতে ও তাকিয়ে থাকতো পাখিদের দিকে। ওর তখন মনে হতো ভেজা বালিয়াড়িটাও যেন
ওখানে আছে। আর তার পেছনে আছে ওরা দুজন। কী ভালো লাগতো তখন!
ভালোলাগার সেই অনুভূতিটা যেন ফিরে আসতে চাইছে এই মুহূর্তে। মনের ভেতর একটা ছোট্ট রঙিন আর নরম প্রজাপতি কোমল ডানা মেলে উড়ছে। জয়িতার ভেজা চোখ সেই প্রজাপতিটাকেই দেখছে অনিমেষ।