ধারাবাহিক-৩০
অন্য যে কোন অভিবাসীরা যেমন, তেমনি বাংলাদেশী তথা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সাম্প্রতিক অভিবাসীরাও এদেশে এসে যে বিষয়ে সর্বপ্রথম তাদের পেশাগত সহায়তা গ্রহণ করেন, তা হলো তাদের ইমিগ্রেশন স্ট্যাটাস ঠিক রাখার জন্য একজন ইমিগ্রেশন অ্যাটর্নির সঙ্গে যোগাযোগ করেন। দ্বিতীয় যে বিষয়ে তাদের পেশাগত সহায়তার প্রয়োজন পড়ে তা হলো প্রতি বছর শেষে তাদের ইনকাম ট্যাক্স রিটার্নের জন্য একজন একাউন্ট্যান্ট বা সি.পি.এ. বা ট্যাক্স প্রিপেয়ারের। যদিও এই দুই পেশাজীবীদের সহযোগিতা পাওয়া বা নেয়া একজন নতুন ইমিগ্র্যান্ট এবং তাদের পরিবারের জন্য অনস্বীকার্য তবে অধিকাংশ অধিবাসী, বিশেষত বাংলাদেশী ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সাম্প্রতিক ইমিগ্রান্টরা একজন আর্থিক-পরামর্শদাতার (ফাইনান্সিয়াল এডভাইজরের) পরামর্শ নেয়ার ব্যাপারটাকে ততটা গুরুত্ব দেননা অথবা যোগাযোগে বিলম্বিত করেন। তারা অনেক সময় ভুলে যান যে এদেশে এমন অনেক বিষয়ে মনোযোগ দিতে হয় যা কিনা তাদের স্বদেশে হয়তো প্রয়োজন পড়েনি। যেমন, তারা হয়তো বিভিন্ন পেশায় কাজ করে বার্ষিক একটা বড় অংকের অর্থ আয় (ইনকাম) করেন এবং মনে করেন তারা নিজেরাই সেই আয় অনুযায়ী তাদের দৈনন্দিন জীবন পরিচালনা করবেন ও প্রয়োজনীয় সঞ্চয় করবেন। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তারা তা একটা শৃঙ্খলার মধ্যে করতে অসমর্থ হন। অথবা তাদের তা অনুধাবন করতে অনেক বছর পেরিয়ে যায়, যে সময়ের মধ্যে তারা হয়তো অনেক ধরনের আইনগত সুযোগ-সুবিধা বা সঞ্চয় করার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়ে পড়েন ।
তাদের এটা বোঝা উচিত যে একটি ব্যক্তিগত বা পারিবারিক আর্থিক-পরিকল্পনা আয়ের স্তর নির্বিশেষে তাদের আর্থিক জীবনের আরও ভাল নিয়ন্ত্রণ রাখতে সক্ষম করে তুলতে পারে। এটি একজন ব্যক্তি ও তার পরিবারকে তাদের আয়কর (ইনকাম ট্যাক্স) পরিকল্পনা, সঞ্চয়, সম্পদ আহরণ, ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা এবং ভবিষ্যৎ উত্তরাধিকার পরিকল্পনার জন্য সেরা কৌশল বাতলে দিতে পারে। একটি পুঁজিবাদী দেশ হিসেবে আমেরিকার সমাজ ব্যবস্থায় ভোগবিলাসিতার সুস্পষ্ট উপস্থিতি অনেক ক্ষেত্রেই সাধারণ মানুষকে সাচ্ছন্দ্যময় ও বিলাসিতার জীবনযাপনে কাঙ্খিত করে তোলে। যে তাড়না অনেক ক্ষেত্রেই কোনো ব্যক্তি বা তার পরিবারকে আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি’ বা অপরিকল্পিত জীবন চালনায় প্ররোচিত করতে পারে। এদেশের সহজ ঋণ ব্যবস্থা অনেক সময় সাম্প্রতিক ইমিগ্র্যান্ট ও তাদের নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের বিশ্বের এই বৃহত্তর সেবন-সমাজে মর্যাদা ও খ্যাতি অর্জনের জন্য অসচ্ছল বা অসামর্থ্য হিসাবে প্রদর্শন করার মাধ্যমে ভুল পথে যেতে প্রলোভিত করতে পারে।
আমাদের স্মরণ রাখা উচিত যে যুক্তরাষ্ট্রে কঠোর ট্যাক্স কাঠামোতে অনেক সুযোগ সুবিধা দেয়া আছে আইনগতভাবে ইনকাম ট্যাক্স দায়ভার কমানোর। সেই সুযোগগুলো প্রতি অর্থবছরের জন্য নির্ধারিত থাকে। এ ব্যাপারে একজন ট্যাক্স প্রফেশনালের সাথে সাথে একজন আর্থিক পরামর্শদাতার (ফিনান্সিয়াল এডভাইজরের) পরামর্শও নেয়া অত্যন্ত প্রয়োজন। ইমিগ্র্যান্ট পরিবারগুলোকে এটাও মনে রাখতে হবে যে আমেরিকার আইনকানুন ও অর্থনৈতিক মেরুদন্ড (ব্যক্তি-বিশেষের জন্য) চারটি প্রধান বিষয়কে কেন্দ্র করে চালিত হয়- (১) ট্যাক্স (আয়কর ও অন্যান্য কর), (২) ইন্টারেস্ট অন ডেট অর লোন (সুদ, ঋণের ওপর বা কর্জকৃত অর্থের ওপর বা অপরিশোধিত ক্রেডিট কার্ড ঋণের উপর), (৩) বীমা (সব ধরনের বীমা) এবং (৪) সঞ্চিত টাকার ওপর আয় বা ক্ষতি/লোকসান (ইন্টারেস্ট আর্নিংস, গেইন অর লস ইন এন ইনভেস্টমেন্ট অর সেভিংস)। একটি আর্থিক পরিকল্পনা আপনাকে আপনার স্বল্পমেয়াদী ও দীর্ঘমেয়াদী আর্থিক লক্ষ্যগুলো নির্ধারণে এবং সেই লক্ষ্যগুলি পূরণের জন্য একটি ভারসাম্যপূর্ণ পরিকল্পনা তৈরি করতে সহায়তা করতে পারে।
এদেশের স্কুল বা কলেজে ব্যক্তিগত আর্থিক ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে ছেলেমেয়েদের তেমনভাবে শিক্ষা বা অনুশীলন দেয়া হয় না। সুতরাং ইমিগ্রান্ট বাবা-মায়েরা যদি তাদেরকে পরিমিত ও সাচ্ছন্দময় পারিবারিক আর্থিক কাঠামোর জীবনযাত্রা চালনার অভিজ্ঞতা দিতে ব্যর্থ হন তাহলে তাদের ঘরে জন্ম নেয়া নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা একটা ভুল ধারণা নিয়ে নিজেদের ভবিষ্যৎ অর্থনৈতিক জীবন ভুল পথে নিয়ে যেতে পারে। ব্যক্তিগত বা পারিবারিক আর্থিক পরিকল্পনা প্রক্রিয়ার ৬টি মূল পদক্ষেপ বা পদ্ধতি রয়েছে: (১) আপনার বর্তমান আর্থিক পরিস্থিতি সম্পর্কে ওয়াকেবহাল হওয়া, (২) আপনার ও পরিবারের আর্থিক লক্ষ্যগুলো বিকাশ ও চিহ্নিত করা, (৩) লক্ষ্য অর্জনের জন্য বিকল্প পদ্ধতিগুলো সনাক্ত করা, (৪) বিকল্পগুলো মূল্যায়ন করা, (৫) একটি আর্থিক কর্ম পরিকল্পনা তৈরি করা এবং তা বাস্তবায়ন সুনিশ্চিত করা এবং (৬) পর্যায়ক্রমে পরিকল্পনাটি পুনর্র্নিমাণ এবং প্রয়োজনে সংশোধন করা। আমি এ বিষয়গুলোর বিভিন্ন দিক নিয়ে আরো কিছুটা বিস্তারিত আলোকপাত করার চেষ্টা করব আমার লেখার পরবর্তী কয়েকটা এপিসোডে।
আমেরিকা একটি স্বপ্নের দেশ এবং ইমিগ্র্যান্ট পরিবারগুলো তাদের অনেক স্বপ্ন পূরণের আশায় এখানে আসেন। মূলত তাদের ছেলেমেয়েদের জন্য এবং তাদের ভবিষ্যৎ বংশধরদের জন্য আরো সুখকর জীবনযাপনের স্বপ্নকে বাস্তবায়নে তারা অপরিসীম পরিশ্রম করেন এবং এদেশের আইনকানুন মেনে চলেন। মানুষ হিসেবে আমদের জীবনকে যথাযথভাবে উপভোগ করে তোলার জন্য এবং অর্থনৈতিকভাবে সচ্ছল থাকার জন্য এই স্বপ্নের দেশ আমেরিকাতেও আমাদেরকে তিনটি মূল জিনিস শর্ত হিসেবে মেনে নিতে হবে এবং কার্যকর রাখতে হবে। (১) মানুষ হিসেবে আমাদেরকে বেঁচে থাকতে হবে, (২) শারীরিক ও মানসিক/আধ্যাত্মিক ভাবে সুস্থ থাকতে হবে এবং (৩) আমরা যে পেশায় পারদর্শী বা পেশাগতভাবে যোগ্যতা অর্জন করেছি সেই পেশায় উপার্জনক্ষমভাবে কর্মরত থাকতে হবে। এর যে কোনো একটির অবর্তমানে আমাদের পারিবারিক জীবনে একটা অপ্রত্যাশিত ট্র্যাজেডি বা বিপর্যয় বয়ে আনতে পারে। একজন কর্মক্ষম আপনজন দীর্ঘমেয়াদী অসুস্থতা বা ডিসেবিলিটিতে ভুগলে বা অকালে মারা গেলে সেই পরিবারকে অনেক অনাকাঙ্খিত দুর্গতির মধ্য দিয়ে যেতে হয়। অর্থনৈতিক দুর্গতি সেই অবস্থায় ‘মরার উপর খাড়ার ঘা’ হয়ে দেখা দেয় সেই পরিবারের সদস্যদের ওপর। তবে সেই কর্মক্ষম পেশাজীবী ব্যক্তি যদি পারদর্শিতা দেখিয়ে আগাম আর্থিক পরিকল্পনা করেন তাহলে সেই ব্যক্তি বা তার পরিবার কোন রকমের অর্থনৈতিক দুর্দশায় ভোগা থেকে রেহাই পেতে পারেন।
সাম্প্রতিক ইমিগ্র্যান্ট পরিবারের কর্ণধার উপার্জনকারীকে এটা বুঝতে হবে যে পরিবাবের আর্থিক পরিকল্পনার দায়ভার তার ওপরেই বর্তায়- অর্থনৈতিকভাবে পরিবারের অন্যান্য সদস্যরা হয়তো তার উপার্জনের ওপর নির্ভর করে জীবন ধারণ করার প্রয়াস পায়। সুতরাং তার মধ্যে যদি অদূরদর্শিতা থাকে আগাম পরিকল্পনার ব্যাপারে, তার ভোগান্তি হয়তো ঐ সমস্ত নির্ভরশীলদের জীবনে সুদূরপ্রসারী অপ্রয়োজনীয় বা অনাকাঙ্খিত সংগ্রামের ভার হয়ে আসে। আমাদের এটাও মনে রাখতে হবে যে আর্থিক পরিকল্পনা নিশ্চিত করার জন্য কোন বাধাধরা সময় নির্ধারণ নেই, তবে যত তাড়াতাড়ি এই ব্যাপারে মনোযোগ দেয়া যায় ততই মঙ্গল। কোনো কোনো আর্থিক-প্রকল্পনা যেগুলো লাইফ-ইন্সুরেন্স বা ডিসেবিলিটি-ইনকাম ইন্সুরেন্স অথবা লং-টার্ম-কেয়ার ইন্সুরেন্স বা ক্রিটিক্যাল বা ক্যাটস্ট্রোফিক ডিসেবিলিটি বা সম্ভাব্য-অসুস্থতার আওতায় পড়ে সেগুলো অনেক ক্ষেত্রেই সেই কর্মক্ষম/উপার্জনকারী ব্যক্তির বয়স, সুস্বাস্থ্য ও আর্থিক সঙ্গতির ওপর নির্ভর করে। সুতরাং নিজ পেশায় উপার্জন করার সক্ষমতা অর্জন করার সাথে সাথে বা যত তাড়াতাড়ি সেই ব্যক্তি তার এবং তার পরিবারের সম্ভাব্য আর্থিক পরিকল্পনার কাজটা শুরু করা শ্রেয়। আমাদের এটাও মনে রাখতে হবে যে আর্থিক-পরিকল্পনা একটা অব্যাহত-প্রক্রিয়া এবং কোনো একক ঘটনা নয় যে একবার একটা কিছু করলেই তা শেষ হয়ে গেল। কেননা আমাদের জীবনে চলার পথে অনেক ধরনের পরিবর্তন আসতে পারে, পারিবারিক ক্ষেত্রে বা পেশাগতভাবে বা কোনো কোনো অনাকাঙ্খিত ভালো বা মন্দ যা কিছু। আবার এদেশের ট্যাক্সের নিয়মনীতিতে অহরহ পরিবর্তন ঘটছে। সুতরাং আমাদের আর্থিক পরিকল্পনাগুলো সেই সমস্ত পরিবর্তিত পরিস্থিতির সাথে খাপ খাইয়ে মিলিয়ে দেখতে হবে বিভিন্ন সময়ে। এবং একজন পেশাজীবী আর্থিক পরামর্শদাতার (ফিনান্সিয়াল এডভাইজরের) ভূমিকা, একজন দিক-নির্দেশক হিসেবে ফলপ্রসূ হবে বলে আমি মনে করি। সূত্র: সাপ্তাহিক বাঙালী, নিউইয়র্ক, এপ্রিল ৩, ২০২১
আপনার মতামত লিখুন :