আমেরিকায় আমাদের নতুন প্রজন্ম-মিজান রহমান নিউইয়র্ক


ওহাইও সংবাদ প্রকাশের সময় : সেপ্টেম্বর ১৪, ২০২৩, ১:২৬ পূর্বাহ্ণ /
আমেরিকায় আমাদের নতুন প্রজন্ম-মিজান রহমান নিউইয়র্ক

ধারাবাহিক-১১৪
এদেশে জন্ম নেয়া আমাদের নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের বিয়ে বা সম্পর্ক স্থাপনের ক্ষেত্রে তারা যে সমস্ত বিভিন্ন ধরনের জটিলতা বা চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয় গত সংখ্যায় তা নিয়ে লিখেছিলাম। এই সংখ্যায় এবিষয়ে আরো কিছুটা আলোকপাত করব। গত সংখ্যায় আরো উল্লেখ করেছিলাম যে এদেশে আমাদের নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের মধ্যে যারা নিজেরাই নিজেদের পছন্দ মত কারো সাথে প্রেম বা পারস্পরিক ভালোবাসার সম্পর্ক স্থাপনের পর একসময়ে বিয়ে করার সিন্ধান্ত নেয় বা নিতে পারে তাদের নিয়ে এখানে আলোচনা করার বিষয় নয়। বরং তাদের নিয়েই এখানে আলোচনা করছি যারা বিভিন্ন কারণে বয়ফ্রেন্ড-গার্লফ্রেন্ড বা রোমান্টিক কোন সম্পর্কে জড়ায়নি তাদের হাইস্কুলে থাকাকালীন বা কলেজে পড়াকালীন। এমনকি তাদের লেখাপড়া শেষেও যার যার পেশাগত জীবনে পদার্পণের পরও যখন কিনা তারা অবিবাহিত জীবন যাপন করছে তাদের বিয়ে দেয়ার বা করার ব্যাপারে যে চ্যলেঞ্জগুলোর সম্মুখীন হতে হয় তা নিয়ে এবং সেগুলো উত্তরণের সম্ভাব্য কিছু কৌশল নিয়েই এই লেখা।

এদেশে বাংলাদেশী-আমেরিকান সহ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ান বা এশিয়ান আমেরিকান টিপিক্যাল একটি ইমিগ্র্যান্ট পরিবারে সাধারণত ছেলেমেয়েরা মেইনস্ট্রিম আমেরিকার অন্যান্য পরিবারের ছেলেমেয়েদের তুলনায় অনেক বেশি আদর-যত্ন পেয়ে এবং একই সাথে কঠোর শাসনের মধ্যে বেড়ে ওঠে। তারা যখন তাদের পড়াশুনায় মনোযোগী হয় তখন তাদেরকে সাধারণত সংসারের দৈনন্দিন কোন কাজকর্ম তেমন একটা করতে হয়না। বিশেষত ছেলেরা এব্যাপারে অনেকটা যেন একটা ফ্রি-পাস পেয়ে বেড়ে ওঠে। পরিবারগুলো অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তাদের ছেলেমেয়েদের আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রেখে অথবা নজরদারীর মধ্যে রেখে বড় করে তুলতে চায়।

যার ফলে তারা দৈনন্দিন জীবন যাত্রার জন্য পরিবাবের ওপর, বিশেষত তাদের মায়েদের ওপর, নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। নিজেদের বিছানাপত্র গুছানো থেকে শুরু করে, নিজেদের কাপড়-চোপড় লন্ড্রি করা, খাওয়ার পর ডাইনিং টেবিল পরিষ্কার করা বা থালাবাসন ধোয়া, ইত্যাদি কোনকিছুই তাদের করতে হয়না। বাড়িঘর পরিষ্কার-পরিচ্ছিন্ন রাখা, বাড়ির গ্যারাজ বা আঙিনা পরিপাটি রাখা বা গাড়ি ধোয়া-মোছা করা, ছোটখাটো রান্না-বান্না শেখা ইত্যাদি কোনকিছুই প্রায় তাদের ঘরোয়া কর্তব্যের মধ্যে পড়েনা। যদিও অনেক সময় হয়তো মেয়েদের এইসব ব্যাপারে কিছু কিছু ঘরের কাজ বা টুকটাক রান্নাবান্না শিখতে দেখা যায়, কিন্তু ছেলেদের বেলায় অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নিজেদের বিনোদনের, যেমন ভিডিও গেম্স্ খেলা ছাড়া আর কিছুই করতে দেখা যায় না।

অধিকন্তু এদেশে আমাদের নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের সামার- জব করা অথবা পার্টটাইম কাজ করা, ইত্যাদি থেকেও দূরে রাখা হয় বা সে ব্যাপারে তাদেরকে ততটা উৎসাহিত করা হয়না। সুতরাং যেখানে মেইনস্ট্রিম আমেরিকার ছেলেমেয়েরা অধিকাংশই তাদের ছোটবেলা থেকেই কিভাবে স্বয়ংসম্পূর্ণভাবে বেড়ে উঠতে হয় তা শেখে, সেখানে আমাদের ছেলেমেয়েদের সাংসারিক ব্যাপারে অনেকটা অন্য কারো ওপর নির্ভরশীল হয়ে বেড়ে ওঠার একটা প্রবণতা থাকে। যদিও পরিবার ভেদে বা বাবামায়ের দূরদৃষ্টিভঙ্গী ভেদে তা ভিন্নরকম হতে পারে।

আরেকটা উল্লেখযোগ্য ব্যাপার হলো, আমাদের ছেলেমেয়েরা এদেশে একটা জিনিস লক্ষ্য করে বেড়ে ওঠে। তাহলো অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তাদের মায়েরাই ঘরের বা সংসারের সমস্ত বা অধিকাংশ কাজকর্ম করে। রান্না-বান্না থেকে শুরু করে ঘরদোর পরিষ্কার পরিছন্ন রাখা বা গ্রোসারি করা ও শপিং করা ইত্যাদি যেন মায়েদের বা মেয়েদেরই কাজ। এমনকি কোন ফুল-টাইম কাজ করেন বা পেশাজীবী মায়েদের ক্ষেত্রেও তার তারতম্য ঘটেনা।

সম্প্রতি এক পেশাজীবী দম্পতির একজন প্রাপ্তবয়স্ক মেয়ে যে কিনা তার বাবা-মায়ের মতই একই প্রফেশনে কাজ করার উদ্দেশে উচ্চতর শিক্ষায় নিবেদিত, তাকে তার মা যখন বলল একটি বাঙালি ছেলেকে পছন্দ করে বিয়ে করার জন্য, উত্তরে মেয়েটি বলল ‘মোটেই না, সেতো বাবার মত ঘরে এসে ডাইনিং টেবিলে বসে রেডি খাবার খাবে তারপর টিভি দেখবে বা অন্যকিছু করবে। ঘরের কোন কাজই সে করবে না। আর আমাকে তোমার মতই ঘরের সব কাজই করতে হবে। আমি কোন বাঙালি বা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ান ছেলেকে বিয়ে করব না।’

এদেশের মেইনস্ট্রিমের সংসারে সাধারণত স্বামী-স্ত্রী ভাগাভাগি করেই ঘরের কাজগুলো করে। রান্নাঘর থেকে শুরু করে সন্তান প্রতিপালন, সব ক্ষেত্রেই তা প্রযোজ্য। দৈনন্দিন কাজ যেমন, ছেলেমেয়েদেরকে স্কুলে নিয়ে যাওয়া বা নিয়ে আসা থেকে তাদের হোমওয়ার্ক করা বা এক্সট্রা-কারিকুলার এক্টিভিটিস সব ক্ষেত্রেই সাধারণত বাবা-মা দুজনেই সম্পৃক্ত থাকে বা ভাগাভাগি করে নেয়। এখন প্রশ্ন আসতে পারে যে আমরা কি এব্যাপারে আমাদের ছেলেদের দোষ দেবো নাকি আমরা তাদেরকে যেভাবে বড় করে তুলছি তাকে দোষ দেবো? কারণ ছেলেরা ছোটবেলা থেকেই দেখে অভ্যস্ত হয় যে, সংসারের সব কাজ মেয়েরাই করে। কেননা তারা দেখছে তাদের মা-ই সব করছে এবং বাবা ঘরের কোন কাজে তেমন ইনভল্ভড নয়। সুতরাং তাদের চেতনায় এটাই কাজ করা স্বাভাবিক যে তারা ভবিষ্যতে যখন বিয়ে করবে তখন তাদের স্ত্রীই ঘরদোর সামলাবে এবং এটাই যেন স্বাভাবিক।

আমাদের ছেলেমেয়েদের অনেকেরই এই অবস্থার কারণে, অর্থাৎ পরিবারের বা মায়ের ওপর নির্ভরশীলতার কারণে তারা তাদের কলেজ- জীবন শেষে, এমনকি কর্মজীবনে পদার্পণ করার পরও নিজ বাড়িতে বাবা-মায়ের কাছে ফিরে আসে। অবশ্য এদের অধিকাংশই যারা সিঙ্গেল এবং তখনও কোন রোমান্টিক সম্পর্কে জড়ায়নি বা ডেটিং করেনা।

সাধারণত যে সমস্ত ছেলেমেয়ে প্রেম বা ডেটিং করে তারা তাদের বাবামায়ের কাছে ফিরে আসে না, যেহেতু তারা প্রাইভেসি চায়। সুতরাং তারা তাদের বাবামায়ের কাছ থেকে দূরে বা আলাদা থাকতে চায়। তবে হয়ত নিয়মিতভাবে বাবা-মাকে ভিজিট করে। এবং তারা অনেকটা বাধ্য হয় সাবলম্বী হতে বা শিখতে।

বাংলাদেশের সমাজ ও সংস্কৃতি অনুসারে এদেশে ইমিগ্র্যান্ট বাবামায়েরা, বিশেষত মায়েরা তাদের ছেলেদের রান্না-বান্না বা রান্নাঘরের কোন কাজে তেমন করে কোন কিছুই শেখান না। যদিও অনেকেই হয়তো তাদের মেয়েদেরকে এবিষয়ে কিছুটা শেখানোর চেষ্টা করেন। অথচ এদেশে রোমান্টিক সম্পর্ক বা বিয়ের ব্যাপারে একটি ছেলের রান্না করার কিছু গুণাগুন বা পারদর্শিতা একটি মেয়ের কাছে অত্যন্ত আকর্ষণীয় একটি ব্যাপার। তা তাদের কাছে একজন পুরুষের পৌরুষত্ব হিসেবে ধরা দেয় এবং তা তাদের শিক্ষাগত যোগ্যতা বা পেশাগত দক্ষতা নির্বিশেষে প্রযোজ্য হয়। সারা পৃথিবীতেই অধিকাংশ কুক বা বিখ্যাত শেফ পুরুষ, অথচ আমাদের কালচারে তা পুরুষদের ক্ষেত্রে হেয় বা দুর্বলতা হিসেবে গণ্য করা হয়। অবশ্য পেশাজীবী কুক ছাড়া ।

এদেশে এমনকি একটি এরেঞ্জ ম্যারেজের ক্ষেত্রেও একটি ছেলের কিছু আইটেম রান্না করার পারদর্শিতা এবং সাংসারিক কাজকর্মে অভ্যাস থাকা তার সম্ভাব্য ব্রাইডের জন্য একটি অত্যন্ত আকর্ষণীয় গুণ হিসেবে ধরা দিতে পারে। সুতরাং একটি বিবাহিত জীবনের দীর্ঘ মেয়াদি সফলতার জন্য এদেশে আমাদের নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়ে উভয়েরই ঘরোয়া দৈনন্দিন সাংসারিক কাজে কিছুটা পারদর্শী হয়ে বেড়ে ওঠাটা শ্রেয়। এব্যাপারে তাদের ইমিগ্র্যান্ট বাবামায়েদের ভূমিকা অনস্বীকার্য। সূত্র: সাপ্তাহিক বাঙালী, নিউইয়র্ক, নভেম্বার ১২, ২০২২