একটু বোস – রাশিদা কামাল


ওহাইও সংবাদ প্রকাশের সময় : সেপ্টেম্বর ১৪, ২০২৩, ১২:০৩ পূর্বাহ্ণ /
একটু বোস – রাশিদা কামাল

(পর্ব —- দুই)
(আগের কথা —–
বাই দ্যা ওয়ে ফারহান, আমি এখানে অফিসের কাজে এসেছি। আমাকে উঠতে হবে।)
ফারহানের গলায় অনুনয়,
‘ আর একটু বোস জয়ী! ‘
‘ বসলে কী হবে ? ‘
জয়িতার মনে হচ্ছে হারিয়ে যাওয়া স্মৃতি ওকে নাড়া দিচ্ছে!
ওর মনের ভার বাড়াচ্ছে!
জয়িতার দিকে তাকিয়ে ম্লান হাসলো ফারহান।
‘ তোমাকে খুব ছুঁতে ইচ্ছে করছে আগের মতো! ‘
দৃঢ় গলা জয়িতার,
‘ না, তুমি একজন বিবাহিত পুরুষ! ‘
‘ তো! বিবাহিতদের কি কোন ইচ্ছে থাকতে নেই? ‘
‘ ইচ্ছে থাকতে নেই বলি নি! তবে যে ইচ্ছের কথা বলছ তা থাকতে নেই! তাই কিশোর বয়েেসর সেই চঞ্চলতা ফিরে পাবার চেষ্টা কোর না।’
‘ জয়ী, একটা কথা জানতে ইচ্ছে করছে। তুমি বিয়ে কর নি কেন?’
‘ কাউকে ঠকাতে চাই নি! তাছাড়া আমার বিশ্বাসের ভিতটা
খুব নড়বড়ে হয়ে পড়েছিলো। তাকে আর মেরামত করতে ইচ্ছে হয় নি! জানো তো ফারহান, ইচ্ছেরাতো সব কথা শোনেও না! এদের কোন আকার হয় না! তাই এদের স্পর্শ
করাও যায় না! কখনও কখনও তারা অধরাই থেকে যায়! ক্ষয়াটে ভালোবাসাকে পুননির্মান করতে চাই নি! ‘
জয়িতা আর স্নেহা ছোটবেলার বন্ধু। স্নেহার মাধ্যমে ওর বড়ভাই ফারহানের সাথে জয়িতার পরিচয়। আর পরবর্তীতে ঘনিষ্ঠতা। সে ঘনিষ্ঠতা যে প্রেম পর্যন্ত গড়াবে তা কেউ ওরা বুঝতে পারে নি। রহস্যময় আবেগটা কখন ঘনীভূত হয়ে দানা বেঁধেছে তা কেউ টের পায় নি! দুজনেরই বয়স তখন কম।
জয়িতা এক সময় টের পেলো স্নেহার চেয়ে ফারহানের সাথেই কথা বলতে ভালো লাগে—-ভালোলাগে ফারহানের উপস্থিতি। ব্যাপারটা শুধু ওরা দুজনেই জানতো। তাই স্নেহার উপস্থিতির জন্য ওদের একান্ত কথাগুলি আর বলা হতো না। দুজনই দুজনকে কাছে পেতে চাই তো। ছোট্ট শহরে তা ছিলো প্রায় অসম্ভব!
শেষ পর্যন্ত উপায় খুঁজে পেলো ফারহানই। শহরের শেষ প্রান্তে মধুমতি নদীর পাড় ঘেঁষে একটা রাস্তা দক্ষিণ দিকে চলে গেছে। ওদিকে লোক চলাচল নেই বললেই চলে। একটা বালিয়াড়ি আছে ওখানে। তার পেছনে দেখা করা যেতে পারে।
প্রস্তাবটা শুনে অবাক জয়িতা।
‘ এতোদূর যাব কী করে! রাস্তাটাও না কি খারাপ! ‘
‘ আরে সেজন্যই তো প্রেম করার উপযুক্ত জায়গা! ‘
জয়িতার চোখে আবেগের ছোঁয়া।
‘ কিন্তু এতোদূর যাব কী বলে ? ‘
‘ আমাদের বাসার কথা বলে যাবে! ‘
‘ যদি কেউ দেখে ফেলে? ‘
‘ বলছি তো কেউ দেখবে না! তাছাড়া প্রেমের জন্য এটুকু ঝুঁকি তো নিতেই হয়! ‘
দেখা হতো দুজনের। ওই বালিয়াড়ির পেছনেই। কত দুর্লভ মুহূর্ত কেটেছে ওদের ওখানে ! পেছনে মধুমতি নদী আর সামনে শান্ত ধানখেত—–ওরা ভুলেই যেতো যে ওরা পালিয়ে দেখা করতে এসেছে! চোখে চোখ রেখে, হাতে হাত রেখে গা ঘেঁষে বসতো দুজন! বিকেলের নরম আলো ছুঁয়ে থাকতো ওদের! মাঝে মাঝে শুধু জয়িতা বলতো,
‘ যদি কেউ দেখে ফেলে! ‘
‘ তো! কী হবে ! সত্যিকথা বলব তখন! ‘
‘ সত্যিকথাটা কী ? ‘
প্রশ্ন করে জয়িতা তাকিয়ে থাকতো ফারহানের দিকে। ওর শরীরটা তখন আবার কেঁপে উঠতো। ফারহান তখন ওকে খুব কাছে টেনে নিতো। চোখের পাতায় ঠোঁট ছোঁয়াতো। তারপর ফিসফিস করে আবেগী সুরে বলতো ,
‘ সত্যিকথাটা কী তা তুমি জানো না ? ‘
জয়িতা ওর বুকে আঁকিঝুঁকি কাটতে কাটতে ওর শরীরের সাথে লেপটে থাকতো।
এরও বেশ পরে ফারহান ঢাকা চলে গেলো পড়াশোনার কারণে। যাবার আগে কথা দিলো সপ্তাহে দুটো করে চিঠি দেবে যাতে জয়িতার মনে হয় ফারহান ওর কাছেই আছে! ওকে আগের মতোই ছুঁয়ে আছে!
ছুটি হলেই ফারহান চলে আসতো! আর দেখা করতো সেই বালিয়াড়ির পেছনে। ওরা দুজনেই তখন অ্যাডাল্ট। দুজন অ্যাডাল্ট মানুষ ইচ্ছে করলেই সম্পর্ক গড়তে পারে! পারে সে সম্পর্ককে অনেকদূর পর্যন্ত টেনে নিতে! তাই সম্পর্কটাকে টেনেও নিয়েছিলো ওরা! প্রতিদিনের চেনা বৃত্তের বাইরে পৌঁছেছিলো সে সম্পর্ক।
প্রথম কয়েক বছর ফারহান কথা রেখেছিলো। তারপর ? না, তারপরেরও একটা তারপর থাকে! জয়িতার বাবার ক্যান্সার ধরা পড়লো। ওর পরিবারের তখন দিশেহারা অবস্থা। মা একেবারেই ভেঙে পড়েছিলো!
জয়িতা কথাটা জানালো ফারহানকে। বিচলিত ফারহান তখনই আসতে চাইলো। জয়িতা জানালো এখন আসতে হবে না। ওরা বাবাকে পিজিতে দেখাবে। ফারহান যেন ওখানে থাকে।
পিজিতে দেখা হলো ফারহানের সাথে। বাবাকে দেখে ডাক্তার জবাব দিয়ে দিলো। ঢাকা থেকে ফিরে এলো ওরা। চোখের সামনে ঘনীভূত অন্ধকার। বাবাহীন জীবনের কথা ভাবতেও পারছে না কেউ। এই ঘোর অন্ধকারে আলোর বিন্দু হয়ে ফারহান তখন কাছে এসে দাঁড়াতো। ওই আলোর বিন্দুই ছিলো ওর কাছে একমুঠো রোদ। ওর মনে হতো ফারহান যেন ওকে বুকে টেনে নিয়ে বলছে,
‘ ভেঙে পড়ো না জয়ী। আমি তো আছি! চাকরিটা হলেই তোমাকে আমার কাছে নিয়ে যাব। আর তোমার পরিবারের দায়িত্ব তখন আমার! ভেবো না! ‘
কথাগুলি ভাবতে ভাবতে জয়িতা দেখতো ওর দুচোখ ছাপিয়ে পানি পড়ছে। ভালোবাসার অদেখা বন্ধনটা ওকে অনেকক্ষণ ঘিরে থাকতো। আর মন খারাপের অনিশ্চয়তা থেকে মুক্তি পেতো।
বাবা চলে গেলো। ঘোরের মধ্যে দিনগুলি কাটছিলো ওদের। তবুও এর মধ্যেই ফারহানের সাথে ঠিকমতো যোগাযোগ করতো। তবে ফারহান আগের মতো আর যোগাযোগ করছে না! বড় অদ্ভুত লাগলো জয়িতার! এ রকম তো হবার কথা না! ফারহান কি ব্যস্ত না ওর জন্য মন খারাপ! এই অনাকাঙিক্ষত একাকীত্ব ওর আর সহ্য হচ্ছিলো না! ও ছুটলো স্নেহার কাছে। কায়দা করে জানতে চাইলো ফারহানের খবর। স্নেহার গলায় উচ্ছ্বাস!
‘ জানিস, ভাইয়ার একটা সুখবর আছে! ভাইয়া আগামি মাসেই চাকরিতে জয়েন করবে! খুব বড় চাকরি! একটু থেমে স্নেহা ওর কাছে এসে বলল,
‘ আরও একটা খবর আছে! ‘
জয়িতার নিঃশ্বাস বন্ধ হবার যোগাড়। পরের খবরটা কী হতে পারে! ফারহান বলেছিলো চাকরি হলেই ওকে ফারহানের কাছে নিয়ে যাবে! তার মানে——
এতো কষ্টের মধ্যেও জয়িতা শরীরে শিহরণ অনুভব করলো।
প্রথম দিকের সেই কিশোরীর চঞ্চলতা ফিরে এলো যেন!
‘শোন জয়িতা, অন্য খবরটা মা এখন বলতে বারণ করেছে! তবুও তোকে তো সবই বলি! ভাইয়া চাকরিতে জয়েন করেই বিয়ে করবে। বিয়েটা করবে বলেই চাকরিটা পেয়েছে। আমার খুব আনন্দ হচ্ছে রে! একই সাথে দু দুটো খুশির খবর!
আমি তো এখন থেকেই মনে মনে ড্রেস ঠিক করে ফেলেছি!
বিয়ের দিনের জন্য একটা জমকালো ড্রেস বানাবো আর বৌভাতের জন্য——-
না কিছুই আর শুনতে পারছে না জয়িতা! ফারহানের বিয়ে! ও তো কথা দিয়েছিলো চাকরি পেলেই ওকে কাছে নিয়ে যাবে! তাহলে! সব মিথ্যে! সব! সেই আলোর বিন্দু যেন একটু একটু করে হারিয়ে যাচ্ছে! একমুঠো রোদ ওকে আর হাতছানি দিচ্ছে না। ফারহান সত্যিই কি ভুলে গেছে!
‘ এই জয়িতা! কী হয়েছে তোর?
শরীর খারাপ! পানি খাবি? ‘
উদ্বিগ্ন গলা স্নেহার।
জয়িতা কোনরকমে বলল,
‘ না! বাসায় যাব। শরীরটা ভালো লাগছে না! ‘
‘ আংকেল চলে যাবার জন্যই এ রকম হচ্ছে। তুই একা যেতে পারবি না আমি আসব? ‘
‘ একাই পারব। ‘
ফারহান যোগাযোগ করছে না বলেই আজ ও খবর নিতে এসেছিলো! ও কত্ত বোকা! নিজেকে সেদিন শুধু বোকা নয় নিঃস্বও মনে হয়েছিল ! বিশ্বাসের ভিতটা প্রচণ্ড নাড়া খেয়ে ভেঙে পড়েছিলো!
বিপর্যস্ত জয়িতার আরও একমাস কাটলো এভাবে। ফারহানের সাথে যোগাযোগের ইচ্ছে হলেও ও যোগাযোগ করলো না। যে মানুষটা ওর মনে, ওর শরীরে ভালোবাসার উষ্ণতা ছড়িয়েছে সেই মানুষটা এভাবে দূরে ঠেলে দিলো! এই অপরিমেয় দূরত্বের কারণ কী! ওরা আজ অসহায় বলে! বাবা নেই বলে! ওর চোখ ভিজে উঠলো। ওই ভেজা চোখে ও স্পষ্ট দেখতে পেলো বিকেলের নরম আলো মাখা বালিয়াড়িটা যা ওর মতোই শূন্য আর নিঃস্ব!
একমাস পর ফারহানের খবর এলো ফারহান ওর সাথে দেখা করতে চায়। একবার ভাবলো দেখা করবে না। আবার ভাবলো যাবে ও দেখা করতে। এমনও তো হতে পারে স্নেহার কথা মিথ্যে!
দেখা করতে গেলো জয়িতা ওই বালিয়াড়ির পেছনে। ফারহান তখনও আসে নি। অন্য সময় ফারহানই আগে আসতো! আর দেরির জন্য ওকে কথা শোনাতো!
বিকেলের আলোয় লালচে নরম ছোঁয়া। পাতা ঝরানো বাতাস বইছে। নীড়ে ফিরে যাওয়া পাখিদের গায়েও লালের ছটা। সেদিকে তাকিয়ে নানান কথা ভাবছিলো জয়িতা কখন ফারহান এসে দাঁড়িয়েছে তা ও টের পায় নি।
‘ জয়ী! ‘
ঘুরে দাঁড়ালো ও। মনে হলো কত্ত যুগ পরে দেখা! ওর বুকের ভেতর আগের মতোই পাখিদের ভিড়। মিথ্যে বলেছে স্নেহা! সম্পর্কের ঘনত্ব বাড়লে যোগাযোগের হিসেবটা তখন মেলে না! ফারহান ওকে ভুলতে পারে না! ওর ইচ্ছে হচ্ছে ফারহানের বুকে ঝাপিয়ে পড়তে! ওর সাথে লেপটে থাকতে! মন বলতে চাইছে,
‘ আমাকে আর অপেক্ষায় রেখো না! অপেক্ষা আমার ভালো লাগে না! ‘
ফারহান বালিয়াড়ির গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ওকে জড়িয়ে ধরে ওর চোখের পাতায় ঠোঁট ছোঁয়ানোর তাগিদ নেই আজ !
‘ ফারহান , কী হয়েছে তোমার? ‘
ফারহানের মুখটা গম্ভীর! তাহলে কি স্নেহার কথাই ঠিক!
‘ জয়ী, তোমার সাথে আমার কিছু জরুরি কথা আছে। ‘
জয়িতার গা গুলোচ্ছে। ও তো জেনে গেছে ফারহান কী বলবে!
‘ আমি একটা চাকরি পেয়েছি।
ট্রেনিংয়ের জন্য বিদেশে যেতে হবে। আর থাকতেও হবে অনেকদিন! ‘
‘ কতদিন! ‘
‘ জানি না ঠিক। তাই বলি কী—-
‘ ভুলে যাব তোমাকে! ‘
‘ এ ছাড়া আর কী বলব! তোমাদের সংসারে ক্রাইসিস চলছে। আমি কবে ফিরব তারও ঠিক নেই। তুমি কতদিন অপেক্ষা করবে বলো! তুমি বিয়ে করলে তোমার আর তোমাদের পরিবারের লাভই হবে। বেঁচে যাবে তোমরা। ‘
চলবে —-