বাকো প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি সনৎ বুড়য়ার প্রয়াণে শোক গাঁথা


ওহাইও সংবাদ প্রকাশের সময় : আগস্ট ১৮, ২০২৩, ৯:৪০ অপরাহ্ণ /
বাকো প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি সনৎ বুড়য়ার প্রয়াণে শোক গাঁথা

ওহাইও সংবাদ : ১১ই ফেব্রুয়ারি ১৯৩৪ সাল। বাংলা পঞ্জিকায় ২৮ মাঘ। বসন্ত এলো বলে। এই দিনের এক রৌদ্র করোজ্জল প্রভাতে মা প্রেমাঙ্গীনির কোল আলোকিত করতে জন্মনিল ফুটফুটে সুন্দর এক শিশু পুত্র। আদর করে মা তাঁর প্রথম সন্তানের নাম রাখলেন টুটু। পাড়ার সবাই এলেন সুন্দর এই নজাতককে দেখতে। বাবা বিনয় ভূষণ বড়ুয়া যুক্ত ভারতে বৃটিশ সরকারের কর্মচারী, বন বিভাগের রেঞ্জ অফিসার। বিভিন্ন বনাঞ্চলেই তাঁর কর্মস্থল। সৌভাগ্যক্রমে সস্ত্রিক তিনি তখন চট্টগ্রামে। বেশ ঘটা করে প্রথম পুত্র টুটুর পোষাকী নাম হলো সনৎ কুমার বড়ুয়া।

দিনে দিনে সনত কৈশর পেরিয়ে যৌবনে পৌছেছেন। ৬ ফুট সুদর্শন যুবক। চট্টগ্রাম থেকে ১৯৫১ সালে মেট্রিক (HSC) এবং ১৯৫৩ সালে ইন্টারমিডিয়েট (SSC) কৃতিত্বের সাথে পাস করে একই বছর ভর্তি হলেন আহসান উল্লাহ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং ক্লাশে। দারুণ মেধার অধিকারী সনত কৃতিত্বের সাথে পাস করে হলেন বাস্ত প্রযুক্তিবিদ (Civil Engineer)। অতীতের সেই আহসান উল্লাহ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের কালের প্রবাহে প্রথমে East Pakistan University of Engineering & Technology (EPET) যা স্বাধীনতার পর নাম বদলে হয়ে গেল Bangladesh University of Engineering & Technology.

পাস করার সাথে সাথেই আকর্ষণীয় বেতনে চাকরি পেলেন ঢাকায় অবস্থিত Persons Engineering Consutants নামের এক আমেরিকান সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানীতে। সালটা ১৯৫৭। মেধা ও দক্ষতার সাথে এই মার্কিন কোম্পানীতে চাকুরি করলেন ১১ বছর কোম্পানির ঢাকা অফিসে। একদিন ঢাকা অফিসের প্রধান বললেন, সনৎ তোমাকে আমেরিকাতে বদলি করা হলো। তোমার কর্মস্থল ওহাইও অঙ্গরাজ্যের রাজধানী কলম্বাসে। সানন্দে রাজি হলেন তিনি। এর মধ্যে চাকরিতে যোগদানের ৮ বছর পর পরিণয় সূত্রে আবদ্ধ হলেন ঢাকা মেডিকেল কলেজের মেট্রন নার্স ইন্দু প্রভা বুড়য়ার সাথে। এই যুগলের একমাত্র কন্যা সন্তার জন্ম ঢাকায়। সানন্দে সনত রাজি হয়ে গেলেন। স্বপরিবারে পাড়ি দিলেন কলম্বাসের উদ্দেশ্যে।

কলম্বাসে তিনি এলেন ১৯৬৯ সালে। সেই থেকে নভেম্বর ১৯৮২ সাল পর্যন্ত পার্সনসে কর্মরত ছিলেন। একই বছরের ডিসেম্বরে যোগ দিলেন ওহাইও রাজ্য সরকারের Environmantal Protection Agency (EPA) তে। মেধা ও কর্মদক্ষতায় তিনি EPA এর একটি Division এর Section Chief পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। প্রায় তিন যুগ পর ২০১২ সালের ডিসেম্বরে রাজ্য সরকারের চাকরি থেকে অবসর নিলেন।

বাবা-মায়ের পরিবারের প্রথম সন্তান ছিলেন তিনি। তাঁর পরে পরিবারে সংযোজন হয়েছে আরও দুই ভাই ও পাঁচ বোন। বড় বর্ণময় কর্মজীবন ছিল তাঁর। পারিবারিক জীবনে যেমন দায়িত্ববান ছিলেন তেমনি সুখীও ছিলেন। ৫৮ বছরের দাম্পত্য জীবনে স্ত্রীর প্রতি দায়িত্ব পালনে তিনি অবিচল ছিলেন। মৃত্যুর দুই সপ্তাহ আগে অবধি নিজের শারীরিক কষ্ট থাকা সত্ত্বেও তিনি তার প্রিয়তমা স্ত্রীকে গাহানার এক বিশেষায়িত Health Facility তে নিয়ত দেখে আসতেন।
গত পাঁচ বছর ধরে তাঁর স্ত্রী ইন্দুপ্রভা দুরারোগ্য ব্যধি স্মৃতিভংস (Dimentia) তে ভুগছেন। ইদানিং তিনি কাউকেই চিনতে পারেন না।

ভাই-বোনদের অভিভাবক হিসেবে তিনি অত্যন্ত দায়িত্ববান ছিলেন। ১৯৭৬ সালে ছোট ভাই সম্বিত বড়ুয়াকে ডাক্তারি শাস্ত্রে উচ্চতর শিক্ষা গ্রহণের জন্য ইউএসএ নিয়ে আসেন। সম্বিত একজন প্রতিষ্ঠিত Anesthesiologist হিসেবে তিন যুগের বেশি কলম্বাসে কর্মরত। আরেক ভাই শরৎ বড়ুয়াকেও সপরিবারে দেশ থেকে নিয়ে কলম্বাসে স্থায়ী থাকার কাজে সাহায্য করেন। ছোট বোন তন্দ্রাকে ১৯৮৬ সালে দেশ থেকে কলম্বাস নিয়ে আসেন এবং স্থায়ীভাবে সপরিবারে থাকার ব্যবস্তা করেন।

একজন আদর্শ পিতা সনত বুড়য়া। তাঁর একমাত্র কন্যা শান্তা প্রতিষ্ঠিত পেশাজীবি। স্বামী গৌতম ও দুই কন্যা রোমিনা, মিলানাকে নিয়ে শান্তা তাঁর পিতার বাড়ির খুব কাছে থাকেন। একই দূরত্বে ছোট ভাই সম্বিত এর পরিবারের বসবাস। তাঁর বার্ধক্যজনিত অসুস্থতার কারণে ছোট ভাই ও কন্যার পরিবার তাঁর সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রাখতেন।
যুবা বয়স থেকেই সনত বড়ুয়া বিভিন্ন সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সাথে যুক্ত ছিলেন। তিনি বাংলাদেশ বৌদ্ধ যুব পরিষদের প্রতিষ্ঠাতা। তাঁর ৬৩ বছরের প্রবাসকালে তিনি বাংলা সাংস্কৃতির সাথে নিবিড় ভাবে যুক্ত ছিলেন।

৭০-৮০ এর দশকে Ohio State University এর Bangladesh Students Association এর সাথে নিবিড়ভাবে যুক্ত ছিলেন। বাংলা ভাষি ভারতীয় বাঙালিদের সংগঠন Bengali Cultural Association ও কোবকার সাথেও আমৃত্যু যুক্ত ছিলেন। এই সব সংগঠনগুলির সকল কর্মকাণ্ডে তাঁর উপস্থিতি ছিল নিয়মিত। ১৯৯৮ সালে তিনি ও কয়েকজন বাংলাদেশী মিলে কলম্বাসের বাংলাদেশীদের প্রয়োজনে একটি সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগ নেন। ফলস্বরূপ সৃষ্টি হয় Bangladesh Association of Central Ohio (BACO)। বাকো এর জন্মলগ্ন থেকে আমৃত্যু প্রায় ২৬ বছর ধরে সংগঠনের সকল কর্মকাণ্ডে তাঁর উপস্থিতি ছিল লক্ষ্যনীয়।

অজাতশত্রু এই কর্মবীরের প্রয়ান ও অন্তোষ্টিক্রিয়ায় বাকোসহ অন্যান্য সংগঠন, তাঁর প্রাক্তন সহকর্মীগণ, পরিবার ও কলম্বাসের বন্ধু শুভানুধ্যায়ীদের শোকের সাগরে ভাসিয়ে ৫ আগস্ট তিনি না ফেরার দেশে চলে গেছেন। (অনুলিখন শহীদ মাহমুদ)