একটু বোস – রাশিদা কামাল


ওহাইও সংবাদ প্রকাশের সময় : আগস্ট ১৭, ২০২৩, ১০:৫৩ অপরাহ্ণ /
একটু বোস – রাশিদা কামাল

ছোটগল্প
হালকা অন্ধকার নেমে আসা বিকেলে মুখোমুখি বসে আছে ফারহান আর জয়ীতা। মুখোমুখি বসে থাকলেও কেউ কারো দিকে সহজভাবে তাকাতে পারছে না! সুসজ্জিত অফিসের বদ্ধ কক্ষে এ মুহূর্তে আর কারোর প্রবেশাধিকার নেই। বদ্ধ দরজার বাইরে এমার্জেন্সি লাল আলোটা জ্বলছে। তার মানে ভেতরে জরুরি মিটিং চলছে। দুজনের সামনেই ব্ল্যাক কফির মগ। একটু আগেও কফি থেকে ধোঁয়া উঠছিলো। তাপ ছড়িয়ে ধোঁয়া এখন উধাও। তবে কফিটা ঠাণ্ডা কী গরম সেদিকে কারোরই খেয়াল নেই। ওরা দুজনেই চলে গেছে অনেকদিন আগে ফেলে আসা স্মৃতিমেদুর দিনগুলোতে। যে দিনগুলি ছিলো রঙিন ফিতেয় মোড়া।

জয়ীতা মনে মনে বলল, কতদিন আগের কথা! না, ভুল হলো! ওকে তো ভাবতে হয় না! গুণতেও হয় না! কত বছর, কত মাস, কত দিন তা ও এক লহমায় বলে দিতে পারে! ও মনে করতে না চাইলেও দিনগুলি ওর সামনে এসে দাঁড়ায় ওরই মতো বিষণ্ণতা নিয়ে। অথচ আজকের দিনটা অন্যরকম। কত্তদিন পর দেখা ফারহানের সাথে!
ফারহান আগের মতোই আছে। শুধু সামান্য মেদ জমেছে শরীরে। তাতে মন্দ লাগছে না! ওর মুখে ব্রনের দাগ ছিলো। এখন আর সেটা নেই! নীলচে গালদুটো নিটোল আর উজ্জ্বল।
সামনের চুলগুলো পাতলা হলেও তাতে পাক ধরে নি! বরং চেহারায় পরিপূর্ণতা এসেছে।
ফারহান তখন কাছে এলেই কড়া সিগারেটের গন্ধ পেতো। আজ তাও পাচ্ছে না। রুমে ঢুকেই মিষ্টি একটা গন্ধ পেয়েছিলো। সেটাই ওকে ছুঁয়ে আছে। বউ তাহলে একটা ভালো কাজ করেছ! সিগারেটটা ছাড়িয়েছে!
ও সে সময় কত নিষেধ করতো! শুনতো না! উল্টে বলতো,
‘তোমার কাছে এলেই আমার সিগারেটের তেষ্টা বহুগুণ বেড়ে যায়!’
জয়ীতা গম্ভীরমুখে বলতো,
‘বেড়ে যায় কেন! আমার সাথে এর কী সম্পর্ক!’
কথাটার উত্তর না দিয়ে ফারহান তখন জয়ীতার দিকে তাকিয়ে হাসতো।
‘হাসছ কেন! বলো কী সম্পর্ক!’
ফারহান দুহাত বাড়িয়ে জয়ীতাকে কাছে টানতো! ওর নাকের ডগা ছুঁয়ে দিতো! আর গভীর দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে থাকতো। আবেগে জয়ীতার দুচোখ তখন বন্ধ হয়ে আসতো। আরও কিছুক্ষণ পর ফারহানের গাঢ় গলা শোনা যেতো।
‘দুটোই তো নেশা জয়ী!’
আপনা থেকেই চোখের পাতা খুলে যেতো জয়ীতার। ফারহানের চোখে চোখ রেখে ও বলতো,
‘আমি নেশা! ‘
‘নেশাই তো! সিগারেটের চেয়েও বড় নেশা।’
‘কী বলছ এসব ফারহান!’
এ কথারও কোন উত্তর দিতো না ফারহান। শুধু ওর হাতদুটো নিজের হাতে নিয়ে মৃদু চাপ দিতো।
‘নেশা বলব না তো কী বলব বলো! তোমাকে দেখার জন্য, কাছে পাবার জন্য, তোমাকে ছোঁয়ার জন্য আমি তো সারাদিন হতাশাগ্রস্ত থাকি! তুমি তা জানো না! বোঝ না!’
সবই বুঝতো জয়ীতা। তবুও না বোঝার ভান করতো! হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে বলতো,
‘কই! কত্ত সাধ্যি সাধনা করে তবে তোমার দেখা পাই!’
‘সাধ্যি সাধনা তো অন্য কারণে! ছোট শহর। কোথায় দেখা করব বলো! আমাদের একসাথে দেখলে সবাই জেনে যাবে এ সম্পর্কের কথা! তখন প্রেমে আসবে বাধা। সেটা তো আমি চাই না! তুমি চাও বলো!’
চায় না কথাটা মুখে বলতো না জয়ী। তবে আবেশে ওর চোখ আবারও বুজে আসতো। উত্তরটা তখন বন্ধ চোখের পাতায় ফুটে উঠতো। আর তখনই আলতো করে ওর বন্ধ চোখের পাতায় ঠোঁট ছোঁয়াতো ফারহান। বাঁধা দিতো না জয়ী। অনেকক্ষণ ওভাবেই চোখ বন্ধ করে থাকতো! চোখ খোলার কথা ওর মনেই হতো না! অদ্ভুত একটা অনুভূতি ওকে তখন ঘিরে ধরতো। ও ভালোলাগার আবেশে কেবল কেঁপে কেঁপে উঠতো। কখনও কখনও মনে হতো কাঁপনটা সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়েছে। না, চোখ খোলা কেন আর কোন কথাই ওর মনে থাকতো না!
আজ বন্ধ ঘরে ফারহানের মুখোমুখি বসে জয়ীতার হঠাৎই মনে হলো সেই হারিয়ে যাওয়া অনুভূতিটা কি ফিরে আসতে চাইছে! অনুভূতিরাও তো স্মৃতি! ওরাও তো ফিরে আসতে পারে!
নিজেকে সামলালো জয়ীতা। দমচাপা কষ্টটা আর ভালো লাগছে না! ও এখানে অফিসের কাজে এসেছে। ব্যক্তিগত অনুভূতিকে জাগিয়ে তুলতে না! তবুও কেন যেন এই মুহূর্তে ওর বুকের ভেতর প্রায় শুকিয়ে যাওয়া মৃতপ্রায় নদীটাতে হঠাৎ জলের তোড় অনুভব করছে। তাহলে কি শুকায় নি নদীটা! ক্ষীণ স্রোতধারা নিয়ে এখনও নিঃশব্দে বয়ে চলেছে! হয়তো চলেছে বা চলছে! তা না হলে এতদিন পর ফারহানকে দেখে কেন ওর সেই ঠোঁট ছোঁয়ানোর অনুভূতিটা ফিরে এলো!
‘কেমন আছ জয়ী?’
তাকালো জয়ীতা ফারহানের দিকে। কেমন আছে কথাটার উত্তর ও দিতে পারছে না। দিতে হয়তো পারবেও না। জলের তোড়টা বুক ছাপিয়ে চোখে আসতে চাইছে। স্মৃতিরা এখন পায়ে পায়ে কাছে এসে দাঁড়িয়েছে। ও ওদের তাড়াতে পারছে না! অদ্ভুত কষ্টে ছেয়ে যাচ্ছে মন। পুরো পরিবেশটাই ঘোলাটে মনে হচ্ছে। ও সাবধানে চোখ নামিয়ে নিলো। যে প্রশ্নটা ফারহান করেছে তার উত্তর তো ওর জানা নেই। আসলেই তো কেমন আছে ও! অন্ধকার নেমে আসা বাইরের দিকে তাকিয়ে কথাটা ভাবলো ও।
‘জানতে ইচ্ছে করছে না আমি কেমন আছি?’
প্রশ্নটা করে ফারহান সরাসরি তাকালো জয়ীতার দিকে। এবার একটু সময় নিলো জয়ীতা।
‘তুমি ভালোই আছ। তাই জানতে চাই নি।’
‘কী করে বুঝলে?’
‘তোমায় দেখে!’
‘দেখে সবটা বোঝা যায়?’
‘সবটা না হলেও কিছু তো বোঝা যায়! বড় চাকরি করছ! ঘরে আছে সুন্দর স্ত্রী। বড়লোক শ্বশুর। গাড়ি বাড়ি সবই আছে! সুখের উপকরণের তো অভাব নেই! তাই বলছি ভালো আছ।’
‘এ সব কি সুখের উপকরণ!’
‘তোমার কাছে তো তাই! বড়লোকের মেয়ে বিয়ে করে সুখি হবে বলেই তো তুমি একদিন মফস্বলের এক সাধারণ মেয়েকে, মেয়েটার ভালবাসাকে উপেক্ষা করতে পেরেছিলে! সেই মেয়েটা কেমন ছিলো বা কেমন থাকতে পারে তা তখন জানতে চাও নি! এখন আর তা জানতে চেয়ে লাভ কী! কেন পুরোনো কথা টেনে আনছ!’
‘আমার ভুল হয়েছিল জয়ী! কম বয়সের একটা রঙিন স্বপ্ন আমাকে ভুল করতে বাধ্য করেছিলো। এখন মনে হয় আমি আসলে খুব বোকা! তা না হলে তোমাকে ছেড়ে চলে আসি!’
‘তোমার কোন ভুল হয় নি ফারহান। ভুল তো হয়েছিলো আমার! কম বয়সের উচ্ছ্বাসময় আবেগে আমি তোমাকে চিনতে ভুল করেছিলাম। আবেগ আর বাস্তবতার সংঘাতটা তখন বুঝতে পারি নি!’
ধূমায়িত মগের গায়ে বিন্দু বিন্দু পানি জমেছে। সে দিকে তাকিয়ে ফারহান বলল,
‘আমি জানি তুমি এসব কথা তুলবে। কারণ ভুলটা তো ছিলো আমার!’
‘বার বার ভুল বলছো কেন! তুমি তো সঠিক সিদ্ধান্তই নিয়েছিলে! অভিজাত এলাকার মেয়েকে বিয়ে করে তুমি সেখানেই থিতু হয়েছ। আর পেছনে তাকাতে হয় নি! অথবা তাকাতে চাও নি! শ্বশুরের বদৌলতে কত বড় চাকরি করছ! বিদেশেও গিয়েছিলে! এসব ফেলে কেউ কী পেছনে তাকায় বলো! মফস্বলের সেই সতের আঠারো বছরের আবেগী মেয়েটার কষ্টের অনুভূতি কেন তোমাকে নাড়া দেবে ফারহান! কেন তার কথা জানতে চাইবে!’
‘জানতে চেয়েছি! বিশ্বাস কর জানতে চেয়েছি! অপরাধবোধের কারণে তোমার সাথে যোগাযোগ করি নি!’
‘কেন যোগাযোগ করতে চেয়েছ! ঘরে বউ থাকবে আর বাইরে প্রেমিকা! তাও কিশোর বয়সের প্রেমিকা! তাই ভেবেছিলে নাকি! কী ভাব তোমরা মেয়েদেরকে! খেলার পুতুল! ইচ্ছে হলো সাজালাম, ইচ্ছে হলো ভেঙে ফেললাম! ফারহান, তোমরা পুরুষরা এখানেই ভুল করো! আর এই ভুল তোমাদের জীবনে খারাপ পরিণতি ডেকে আনে। বোকা পুরুষগুলি শেষ পর্যন্ত না পায় বউ না পায় প্রেমিকা! আমার ভাবতে কষ্ট হয় তুমি এদেরই একজন! তুমি ভালোবাসাকে উপহাস করেছ!’
‘উপহাস বলছো কেন! আমি তো বলেছি এটা আমার ভুল ছিলো। ভুল আর উপহাস কি এক!’
‘ভুল তুমি কর নি! আমি জানি ভুল মানুষের জীবনের অংশ। কিন্তু তুমি আবেগকে প্রশ্রয় দিয়ে
ওপরে ওঠার সিঁড়িটাকে সরিয়ে দাও নি। সিঁড়িটাতে পা রেখেছিলে ঠাণ্ডা মাথায়। আর আমি শূন্য দৃষ্টিতে সেদিকে কেবল তাকিয়েই ছিলাম। তাই ভুল করেছ বলে তুমি কী প্রমাণ করতে চাইছ!’
‘ভালোবাসা প্রমাণ করতে চাইছি।’
‘পারবে প্রমাণ করতে ? দেখ, বিশ্বাস ভাঙার যন্ত্রণাটা হয় খুব তীব্র। একে সামান্য মনে করার কোন কারণ নেই! বাই দ্যা ওয়ে আমি এখানে অফিসের কাজে এসেছি! পুরোনো সম্পর্ক ঝালাই করতে নয়! পাঁচটা বেজে গেছে। আমাকে উঠতে হবে।’
চলবে..