ধারাবাহিক-১১৩
এই সংখ্যায় এদেশে আমাদের নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের মধ্যে বিয়ে বা সম্পর্ক তৈরি করার চ্যলেঞ্জ নিয়ে কিছুটা আলোচনা করব। এদেশে আমাদের নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা বেড়ে ওঠার ক্ষেত্রে নিজস্ব সংস্কৃতি, পারিবারিক মূল্যবোধ, ধর্মীয় এবং সামাজিক ঐতিহ্যের অনেক বৈশিষ্ট্য ধরে রাখতে চায় বা বাধ্য হয়। যেমন পারিবারিক সমষ্টিগত চিন্তাধারা, তাদের মিডল স্কুল বা হাইস্কুল থাকাকালীন ডেটিং করার ব্যাপারে বা বয়ফ্রেন্ড-গার্লফ্রেন্ড সম্পর্ক স্থাপনের ক্ষেত্রে পারিবারিক বিধিনিষেধ থাকা, বা নিরুৎসাহিত করা, যথাযথ শিক্ষাগত যোগ্যতা অর্জন নিশ্চিত করাসহ তাদের কাঙ্খিত পেশায় উন্নীত হওয়ার ক্ষেত্রে যাতে কোন রকমের বাধার সৃষ্টি না হয়, ইত্যাদি মেনে চলতে হয়। তাদের পরিবারের বিভিন্ন সদস্যের প্রত্যাশাগুলি পূরণের লক্ষ্যে কাজ করার প্রেক্ষিতে প্রেম-ভালোবাসার সম্পর্ক স্থাপনে তারা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পিছিয়ে থাকে। বিশেষত ধর্মীয় বিশ্বাস অনুযায়ী অথবা নিজ নিজ সিদ্ধান্তে অনেকেই তাদের কুমারীত্ব রক্ষায় বদ্ধপরিকর থাকে, অথবা বিয়ের সম্পর্কে যাওয়া অবধি তা রক্ষা করতে চায়। ফলে পরবর্তীতে তাদের অনেকেই রোমান্টিক সম্পর্ক স্থাপনের ক্ষেত্রে অনেকটা আনাড়ি হয়।
যদিও বাংলাদেশসহ উপমহাদেশে এখনো প্রায় ৯০% (শতাংশ) বিয়ে ঘটছে এরেঞ্জ ম্যারেজ বা ম্যাচ-মেকিং-এর মাধ্যমে, যাকে আমরা ঘটকালি বলে জানি। দেশ, গোত্র, সমাজ বা ধর্ম নির্বিশেষে মানুষের জীবনে বিয়ে করাটা বিরাট আনুষ্ঠানিক ও ব্যয়বহুল ঘটনা। যেমন ২০২০ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী কেবলমাত্র ভারতেই প্রতিবছর ১২ মিলিয়ন বিয়ের অনুষ্ঠানের জন্য ব্যয় হয়েছে প্রায় ৫৭ বিলিয়ন ডলার।
তবে ম্যাচ-মেকিং বা ঘটকালির ব্যাপারে অনেক ধরনের পরিবর্তন ঘটেছে, বলা যায় আধুনিকীকরণ হয়েছে, যাকে এখন আর আসলে ঘটকালি বলা যায় না। যেমন ঐতিহ্যগত বা প্রথাগত ধারায় অতীতের মত করে ঘটকালি বা পাতানো বিয়েটা এখন শুধুমাত্র কোন মধ্যম-ব্যক্তির বা ব্যক্তিবিশেষের মাধ্যমেই ঘটে তা কিন্তু নয়। বরঞ্চ এই ডিজিটাল যুগে অধিকাংশ ঘটকালি বা পাত্র-পাত্রীর যোগাযোগ ঘটে বিভিন্ন এ্যাপের মাধ্যমে এবং সরাসরি। তারা নিজ নিজ প্রোফাইল ফটোসহ কোন ম্যাচ-মেকিং এ্যাপে নিজেদের পরিচিতি পোস্ট করে এবং সম্পর্কের জন্য তারা কী ধরনের পার্টনার (স্বামী বা স্ত্রী) খুঁজছে তার কিছুটা বর্ণনা দেয়। যখন দুই পক্ষ একজন আরেকজনের প্রোফাইলের বর্ণনা এবং ফটো দেখে পছন্দ করে তারা নিজেদের মধ্যে প্রাথমিক যোগাযোগ করার উদ্যোগ নেয়। তারা অনলাইনে কিছু সময় পরস্পরের সাথে আলাপচারিতা চালায়, ফোনকল বা ভিডিও কল করে, পরবর্তীতে হয়তো দেখা সাক্ষাতের জন্য সম্মত হয়। এসবের মাধ্যমে তারা পরস্পরকে ভালোভাবে জানার বা বোঝার একটা সুযোগ পায়। এই পর্যায়ে তাদের মধ্যে অনেকটা প্লেটোনিক সম্পর্ক সৃষ্টি হয়। তারা তাদের পরিবারের অন্য সদস্যদের বিশেষত মা অথবা বাবা এমনকি উভয়কেই এবং ভাই বা বোনকেও তাদের সম্ভাব্য লাভ-ইন্টারেস্টের কথা জানায় তাদের সম্মতি বা সমর্থন পাওয়ার জন্য। তারা তাদের ঘনিষ্ট বন্ধু-বান্ধবীর কাছেও তাদের লাভ-ইন্টারেস্টের কথা বলতে পারে তাদের মতামত জানার জন্য। তবে তারা মূলত নিজেরাই এব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে।
তাদের প্রোফাইল বা বায়োডাটায় প্রথাগতভাবে অতীতের মত করে বয়স, উচ্চতা, জন্ম-তারিখ বা জন্মস্থান, গায়ের রং, রাশিফল, বর্ণ, গোত্র, ধর্ম, পেশা, শিক্ষা, মেয়ে রান্না করতে পারে কিনা, বা অন্যকোনো গুণ আছে কি নাই, পিতামাতার পেশা এবং পারিবারিক বিবরণের ঐতিহ্যগত সূত্রের ওপর তত গুরুত্ব না দিয়ে বরঞ্চ তাদের স্বতন্ত্র ব্যক্তিত্ব, বিভিন্ন বিষয়ে পারস্পরিক পছন্দ-অপছন্দ, শখ বা হবি, শারীরিক ও মানসিক আকর্ষণ, স্বপেশায় তৃপ্তিবোধ, পরিবার পরিচালনার ক্ষেত্রে দৈনন্দিন জীবন-যাত্রায় অংশগ্রহণের মনোভাব, অংশীদারিত্ব ইত্যাদির ওপর বেশী গুরুত্ব দেয়া হয়।
তবে অনেক এ্যারেঞ্জড ম্যারেজের প্রাথমিক যোগাযোগ এখনও সম্ভাব্য পাত্র- পাত্রীর বাবা-মা বা পরিবারের অন্য মুরুব্বিদের উদ্যোগেই ঘটে থাকে। অবশ্য এ ব্যাপারে তারা তাদের ছেলেমেয়েদের (পাত্র-পাত্রীদের) অবগত রাখে বা তাদের সম্মতিতেই উদ্যোগ নেয় বা নেয়া উচিত। এদেশেও অনেক এ্যারেঞ্জড ম্যারেজ ঘটতে দেখা যায়, যদিও এদেশে জন্মগ্রহণ করা আমাদের নতুন প্রজন্মের কাছে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ‘বিয়ের উদ্দেশে পরিচিতি’ এই ধারণাটা অনেকটা বেখাপ্পা একটা বিষয় এবং অধিকাংশই এতে অসম্মত হয়।
তবে এদেশে আমাদের নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের মধ্যে যারা নিজেরাই নিজেদের পছন্দ মত কারো সাথে প্রেমের সম্পর্ক স্থাপনের পর একসময়ে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নেয় বা নিতে পারে তাদের নিয়ে আমাদের এখানে আলোচনা করার বিষয় নয়। বরং তাদের নিয়েই এখানে আলোচনা করছি যারা বিভিন্ন কারণে বয়ফ্রেন্ড-গার্লফ্রেন্ড বা রোমান্টিক কোন সম্পর্কে জড়ায়নি তাদের হাইস্কুলে থাকাকালীন বা কলেজে পড়া-কালীন। এমনকি তাদের লেখাপড়া শেষে যার যার পেশাগত জীবনে পদার্পণের পরও যখন কিনা তারা অবিবাহিত জীবন যাপন করছে তাদের বিয়ে দেয়ার বা করার ব্যাপারে যে চ্যলেঞ্জগুলো মোকাবেলা করছে এবং সেগুলো থেকে উত্তরণের সম্ভাব্য কিছু কৌশল বা সম্ভাবনা নিয়েই এই সংখ্যার আলোচনা।
এখন দেখা যাক কি কি কারণে তারা যাদের বয়স তাদের বিশের-শেষের দিকে বা তিরিশের-প্রথম দিকে পৌঁছে অনেকটা অপারদর্শী হয় একটি রোমান্টিক সম্পর্ক বা কমিটেড রিলেশনশিপ স্থাপনের ক্ষেত্রে- (১) এই ধরনের সম্পর্ক গড়তে সময় লাগে। প্রায় কয়েক বছরও লাগতে পারে; (২) এদেশে সাধারণত হাইস্কুল এবং কলেজ জীবনে এই ধররের সম্পর্ক সৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা বেশি যা তারা পেরিয়ে এসেছে; (৩) বয়সের পরিপক্কতায় এবং পেশাগত জীবনের ব্যস্ততায় তাদের সময় কম এই জাতীয় নতুন সম্পর্ক সৃষ্টিতে সময় দেয়ার বা মনোযোগ দেয়ার; (৪) ভুল মানুষের সাথে যোগাযোগ সৃষ্টির ভয় বা সংশয়; (৫) যাদের হয়তো পছন্দ হয় তারা ঐ বয়সে এসে অধিকাংশই কোন না কোন সম্পর্কিত জীবন যাপন করছে, যেমন তাদের হয়তো বয়ফ্রেন্ড বা গার্লফ্রেন্ড আছে বা তারা বিবাহিত। (৬) সম্ভাব্য যোগাযোগের সূত্রপাত ঘটলেও তাদের পেশাগত জীবনের অমিল অথবা ভৌগোলিক অবস্থানের দূরত্বের কারণে, যেমন একজন হয়তো ইস্ট-কোস্টে এবং আরেকজন হয়তো ওয়েস্ট-কোস্টে, এবং দুজনের একজনও রাজী নয় মুভ করতে বা পেশার কারণে বা পরিবারের কাছ (বাবামায়ের কাছ) থেকে অনেক দূরে কোথাও চলে যেতে, অথবা তাদের পরিবার হয়তো রাজি নয়।
এত কিছুর পরেও তাদের বাবামায়েদের পক্ষ থেকে আরো অনেক ধরনের বাছবিচারের নখরা থাকে, যেমন, (১) মেয়ে বা ছেলে কোথাকার, শিক্ষাগত বা পেশাগত যোগ্যতা কি যা তাদের মনোপুত হতে হবে; (২) ছেলে লম্বা কিনা বা মেয়ে ফর্সা কিনা; অনেক বাংলাদেশী এখনো একটি মেয়ের সৌন্দর্য তার গায়ের রং দিয়ে বিচার করতে চান; (৩) বাপ-মা ও পরিবারের স্ট্যাটাস; (৪) যদি বাংলাদেশী হয়, জানতে চান কোন বংশের বা কোন অঞ্চলের; (৫) কত টাকা আয় করে; অতি সম্প্রতি এক বাংলাদেশী পেশাজীবী ইমিগ্র্যান্ট দম্পতি আমাকে জানিয়েছেন যে তাদের সুদর্শন লম্বা ছেলে ভালো ইউনিভার্সিটি থেকে পড়াশুনা করেছে যে কিনা গুগল কোম্পানিতে অতি উচ্চ বেতনে কাজ করে তার জন্য বাংলাদেশী আরেকটি পেশাজীবী দম্পতির সুন্দরী উচ্চ শিক্ষিত পেশাজীবী মেয়ের জন্য প্রস্তাব হওয়ার পর মেয়ের মা তাদের প্রাথমিক পরিচয় পর্বটাই নাকচ করে দেন এই বলে যে তার জানা মতে অন্য এক ছেলে গুগল কোম্পানিতে এই ছেলের চেয়েও বেশী বেতনে কাজ করে।
আবার এই ধরনের অনেক বাবামায়েরাই যখন তাদের ছেলে বা মেয়ে কোন সাদা চামড়ার (হোয়াইট ককেশিয়ান) কোন মেয়ে বা ছেলেকে বিয়ে করতে চায় তখন তারা তাদের অনেক চাওয়া-পাওয়াকে কাট-ছাঁট করে অতি সাদরে সেই ফর্সা রঙের ছেলে- বৌ বা মেয়ে-জামাইকে সাদরে গ্রহণ করেন। কোন রকমের উচ্চ-বাচ্য না করেই। কিন্তু বাগড়া ধরেন বা নারাজ হন, এমনকি অনেক ক্ষেত্রে গ্রহণও করতে চাননা, যখন কিনা তাদের কোন ছেলে বা মেয়ে কালো (ব্ল্যাক আফ্রিকান আমেরিকান) কোন মেয়ে বা ছেলের সাথে বিয়ের সম্পর্ক করতে চায়। এমনকি সেই কালো ছেলেটি বা মেয়েটি হয়তো তাদের মেয়ে বা ছেলের সাথে একই পেশায় কাজ করে বা একই ইউনিভার্সিটিতে পড়াশুনা করেছে বা তাদের চেয়েও অধিকতর যোগ্যতাসম্পন্ন বা অধিক উপার্জন করার ক্ষমতা রাখে। শুধুমাত্র গায়ের রং কালো বা আফ্রিকান আমেরিকান হওয়ার কারণে তারা বেঁকে বসেন। আমার আগের লেখার এক পর্বে উল্লেখ করেছিলাম কিভাবে বাংলাদেশী এক মা নিজের বাড়ি ছেড়ে চলে যান যখন তাদের একমাত্র মেয়ে তার সাথে পড়াশুনা করা এবং একই পেশায় এক সঙ্গে কাজ করে এরকমের একটি কালো (আফ্রিকান আমেরিকান) ছেলেকে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নেয়। যাতে মেয়ের বাবা সম্মতি দেয় এবং কেন দেয় সেই কারণে মা রাগ করে বাড়ি ছেড়ে তার বান্ধবীর বাড়িতে গিয়ে ওঠেন।
এদেশে আমাদের নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের বিয়ে বা সম্পর্ক স্থাপনের ক্ষেত্রে আরো কিছু জটিলতা বা চ্যালেঞ্জ নিয়ে পরবর্তী সংখ্যায় আলোকপাত করার ইচ্ছা রইলো। সূত্র: সাপ্তাহিক বাঙালী, নিউইয়র্ক, নভেম্বার ০৫, ২০২২
আপনার মতামত লিখুন :